Image description

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুর ইউনিয়নে ‘আমি-ডামি’ এমপির চাচাতো ভাই এক আওয়ামী লীগ নেতার পক্ষ হয়ে জনগণের কৃষি জমি ভরাট করতে গিয়ে ধাওয়া খেয়েছেন জামায়াত নেতারা।

সোমবার (২৪ নভেম্বর) দুপুরে উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের পশ্চিম সৈয়দপুর গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। গ্রামবাসী মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ধাওয়া করেন কুমিরা ইউনিয়ন জামায়াত নেতা জসিম উদ্দিন ও পৌর জামায়াত নেতা কমিশনার রেহান উদ্দিনসহ অন্য নেতাদের।

জানা গেছে, পশ্চিম সৈয়দপুর গ্রামে সমুদ্র উপকূলে আওয়ামী লীগ নেতা ও পলাতক ‘আমি-ডামি’ নির্বাচনের সাবেক এমপি এস এম আল মামুনের চাচাতো ভাই আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর হোসেনের ক্রয় করা ১০০ একর কৃষি জমি সাগর থেকে বালু উত্তোলন করে ভরাট করতে গিয়ে গ্রামবাসীর রোষানলে পড়েছেন জামায়াত নেতারা। মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে প্রায় চার পাঁচশত গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে ধাওয়া দিলে জামায়াত নেতা জসিম উদ্দিন ও কমিশনার রেহান উদ্দিনসহ অন্য জামায়াত নেতারাও পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। গ্রামবাসীর ধাওয়া খেয়ে পালানোর সময় কয়েকজন জামায়াত নেতা আহত হয়েছেন বলে জানা যায়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জামায়াত নেতা জসিম উদ্দিন ও কমিশনার রেহান উদ্দিনের নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক লোক সৈয়দপুরের সমুদ্র উপকূলে কৃষি জমি ভরাট করতে যান। সেখানে প্রায় ১০০ একর কৃষি জমি ভরাটের কাজ শুরু করতে চেয়েছিলেন তারা। তবে পরে স্থানীয় কৃষকদের প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। পালানোর সময় কয়েকজন জামায়াত নেতা আহত হয়েছেন। কৃষকরা এলাকার মসজিদে গিয়ে মাইকে ঘোষণা দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, কুমিরা ইউনিয়ন জামায়াত নেতা জসিম উদ্দিন ও পৌর জামায়াত রেহান উদ্দিন গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে সীতাকুণ্ডের কুমিরা, আকিলপুর, বাঁশবাড়িয়া, বাড়বকুণ্ড এলাকায় শত শত ড্রেজার দিয়ে বালু ভরাট করছেন। তাদের কাছে ড্রেজার থাকায় সমঝোতার মাধ্যমে সোমবার প্যাসিফিক জিন্সের মালিক ও এসএম আল মামুনের চাচাতো ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী সৈয়দপুরের পশ্চিম সৈয়দপুর গ্রামে পাঠান। এদিন দুপুরে আড়াইটায় তারা ড্রেজার মেশিন লাগিয়ে উৎপাদিত ফসলের জমিতে বালু ভরাটের কাজ শুরু করেন জামায়াত নেতা রেহান উদ্দিন ও জসিম উদ্দিন। পরে সমুদ্র থেকে তোলার বালুর পাইপ লাগানোর খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় বাসিন্দা ও কৃষকরা জড়ো হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ সময় তারা স্থাপন করা বালুর পাইপ ফেলে দেন এবং জামায়াত নেতা জসিম উদ্দিন ও রেহান উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তারা প্যাসিফিক জিন্সের মালিকের হয়ে বালু ভরাট শুরু করেছেন বলে জানান।

পরে কৃষকরা জানিয়ে দেন, ফসল থাকা অবস্থায় কোনো বালু ভরাট করা যাবে না। বালু ভরাট করতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন দেখাতে হবে এবং তিন মাস আগে স্থানীয়দের জানাতে হবে। কোটি কোটি টাকার উৎপাদিত ফসল মাড়িয়ে বালু ভরাট চলবে না। একপর্যায়ে তারা বাড়াবাড়ি করলে স্থানীয়রা দুই জামায়াত নেতা জসিম ও রেহান উদ্দিনকে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ধাওয়া দেন। পরে তারা কোনোমতে জনরোষ থেকে বেঁচে পালান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সীতাকুণ্ডের সাবেক ‘আমি-ডামি’ নির্বাচনের এমপি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম আল মামুনের চাচাতো ভাই প্যাসিফিক জিন্সের এমডি আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ মো. তানভীর কয়েক বছর আগে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পলাতক সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তাজুল ইসলামের ১০০ একর কৃষি জমি ক্রয় করে নেন। ওই সময় স্থানীয়দের জিম্মি করে সরকারি প্রকল্পের কথা বলে জমিগুলো কৌশলে ক্রয় করে নেয়া হয়। সে সময় তাজুল ইসলাম নিজামী জমির দালালি করে বিপুল অর্থের মালিক বনে যান। স্থানীয়দের আপত্তির মুখে সে সময় ভরাট করতে না পারলেও সম্প্রতি আবারও ভরাট করতে মরিয়া হয়ে ওঠে প্যাসিফিক জিন্স। তারই অংশ হিসেবে সোমবার দুপুরে দুই জামায়াত নেতাকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় সৈয়দপুরে। সেখানে গিয়ে তারা কয়েকটি ড্রেজার সাগর পথে নিয়ে রাখেন সৈয়দপুর পয়েন্টে। কিন্তু পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড শুরু করলে স্থানীয়দের তোপের মুখে পালিয়ে যান।

জানতে চাইলে ওয়ার্ড জামায়াতের সভাপতি মো. মামুন বলেন, “আমাদের জানা মতে, তাজুল ইসলাম নিজামী জমিগুলো কিনতে প্যাসিফিক জিন্সকে সহযোগিতা করেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে তারা ভরাট করতে পারছিল না। আজ তারা ভরাট করতে এলে এলাকাবাসী মাইকে ঘোষণা দিয়ে তাড়িয়েছে। আমাদের দাবি, কোনো কৃষি জমি ভরাট করা যাবে না। এতে স্থানীয়দের জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়বে।”

তিনি আরও বলেন, “সব জমিতে ফসল ছিল। কোনো জমিতে টমেটো, কোনো জমিতে ফুলকপি, বরবটি, লাউ, শিম ইত্যাদি শীতকালীন সবজির এক রাজ্য সৈয়দপুর ইউনিয়ন। এখানকার কয়েকশত একর জমিতে সবজি চাষ হয়। পুরো এলাকায় আড়াইশোর বেশি কৃষক রয়েছে। এভাবে সবার উৎপাদিত সবজি যা সারা দেশের মানুষের রিজিক ধ্বংস করে বালু ভরাটের উদ্যোগ জাহেলিয়াতকেও হার মানায়।”

সৈয়দপুর ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মোহসেন আলী জানান, সোমবার দুপুরে জামায়াত নেতা জসিম ও রেহান উদ্দিন এলাকার কৃষি জমি ভরাটের জন্য সাগর থেকে বালু উত্তোলন করতে এলে এলাকার মানুষ প্রতিরোধ করে।”

তিনি আরও বলেন, “জামায়াত নেতা জসিমের সাথে কথা হলে তিনি আমাকে বিএনপির নেতাকর্মীদের বলতে বলেন, তারা যেন বাধা না দেয়। তারা নাকি কোম্পানির পক্ষ হয়ে কাজ করছে, সব দায়িত্ব নাকি তাদের। আমি বললাম, আমাদের এলাকায় কোনো বালু উত্তোলন ও কৃষি জমি ভরাট চলবে না। এটাই আমাদের সাফ কথা।”

সৈয়দপুর ইউনিয়ন জামায়াতের আমির আব্দুর রহমান বলেন, “শতাধিক একর ফসলি জমিতে শীতকালীন সবজি নষ্ট করে কোনোভাবেই বালু ভরাট করতে পারবে না। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কৃষি জমি ভরাটের অনুমতি ইউএনও, এসি ল্যান্ড কীভাবে দিলেন। উপজেলা জামায়াতের দায়িত্বশীলরা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন কৃষকের ফসলি জমি ভরাটের সাথে জামায়াতের কেউ জড়িত থাকলে তাদের চিহ্নিত করতে।”

তিনি আরো বলেন, “আমাদের এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ জনপদ। কৃষিতে সমৃদ্ধ একটি এলাকা। এখানে শিল্পকারখানা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন ও এসিল্যান্ড আশরাফুল আলমকে ম্যানেজ করে সেসময় কিছু জমি শিল্প শ্রেণিতে পরিবর্তন করিয়ে নেয় প্যাসিফিক গ্রুপ। বর্তমানেও প্রশাসন তাদের হয়ে কাজ করছে। জামায়াতের কেউ জড়িত থাকলে আমাদের সংগঠন ব্যবস্থা নেবে।”

সীতাকুণ্ডের পরিবেশ কর্মী আরাফাত হোসেন বলেন, “কৃষি জমিতে শিল্পকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। অথচ পুরো উপজেলায় হাজার হাজার একর কৃষি জমি ধ্বংসের আয়োজন চলছে। এস আলম, ইনফিনিয়া, বসুন্ধরা এরা সীতাকুণ্ডকে শেষ করে দিয়েছে। এখন প্যাসিফিক শেষ প্যারেক ঠুকছে সীতাকুণ্ডের বুকে। এসব পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড উপজেলা প্রশাসন দেখেও চুপ। আগে ক্রয়কৃত জমিকে শিল্পে রূপ দিতে হবে। তাছাড়াও ঘনবসতিতে শিল্প করার অনুমতি আছে কিনা সরকারের তা নিশ্চিত করতে হবে। আগের মতোই গায়ের জোরে আওয়ামী স্টাইলে সব চলছে।”

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা জামায়াতের আমির আলাদ্দিন সিকদার বলেন, “আমাদের দলের নাম ভাঙিয়ে এগুলো করা হচ্ছে। দল কোনো ব্যবসা করে না। জামায়াত এসবের সাথে জড়িত নয়।”

সীতাকুণ্ড মডেল থানার ওসি মুজিবুর রহমান বলেন, “কৃষকের শীতকালীন সবজির ওপর বালু ঢেলে ভরাটের চেষ্টা করলে মাইকে ঘোষণা দিয়ে গ্রামবাসী তাদের প্রতিরোধ করেছে বলে শুনেছি। তবে গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে এখনো কেউ থানায় মামলা করতে আসে নাই।”

সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাম বলেন, “সমুদ্র থেকে বালু উত্তোলন করে কৃষি জমি ভরাটের কোনো অনুমোদন আমরা দিইনি। এই ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

শীর্ষনিউজ/