রাজনৈতিক দলগুলোতে নির্বাচনী ব্যস্ততা বেড়েছে। গণভোট, সংস্কার, আইনশৃঙ্খলাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছাপিয়ে জোরেশোরে চলছে ভোটের প্রস্তুতি। জামায়াত গত বছর ৫ আগস্টের পরপরই কার্যক্রম শুরু করায় নির্বাচনী আয়োজনের প্রায় সব কাজই গুছিয়ে এনেছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা গণসংযোগ শুরু করলেও এখনও প্রার্থী বাছাই শেষ হয়নি। পোলিং এজেন্ট নির্ধারণ ও প্রশিক্ষণ কাজ শুরু করতে পারেনি। অন্যদিকে এনসিপির ব্যস্ত সময় যাচ্ছে সম্ভাব্য প্রার্থীর সাক্ষাৎকার গ্রহণে
সর্বাত্মক নির্বাচনী প্রচারে নেমেছে জামায়াতে ইসলামী। গত ফেব্রুয়ারি থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা শুরু করে প্রচারে নামে দলটি। জুলাইয়ের মধ্যে ২৯৮ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম জানানো হয়। ইতোমধ্যে আসনভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করেছে তারা। ৪৩ হাজার ভোটকেন্দ্রের প্রায় ৪০ হাজারের জন্য কেন্দ্র কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন চলছে পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ।
নির্বাচনী প্রস্তুতির এসব তথ্য জানিয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম সমকালকে বলেন, পোলিং এজেন্টদের দ্বিতীয় ধাপের প্রশিক্ষণ শুরু হবে শিগগির। অনলাইনে নয়, ঘরে ঘরে ভোটারের কাছে পরিবর্তনের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছে জামায়াত।
আবদুল হালিম বলেন, ‘আমরা বলছি, বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টির শাসন মানুষ দেখেছে। জামায়াতকে একবার দেখুন। ভোটাররা এই প্রচারে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে।’
জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী নির্বাচনে প্রশাসনকে দলের পক্ষে কবজা করার হুঙ্কার দিয়েছেন। তবে আবদুল হালিম বলেন, তারা নির্বাচনে কারচুপির আশঙ্কা করছেন। ভোট জালিয়াতির চেষ্টা হলে জামায়াত বসে থাকবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ভোট রক্ষার প্রস্তুতিও আছে তাদের।
২৫ বছর বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে থেকে রাজনীতি করা জামায়াতের আচরণ, বার্তা এখন ভিন্ন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নির্বাচন থেকে ছিটকে যাওয়ায় জামায়াত প্রথমবার সরকার গঠনের কথাও প্রকাশ্যে বলছে। তবে দলটি অতীতে কখনোই ১২ শতাংশ ভোট এবং ১৮টির বেশি আসন পায়নি।
শোভাযাত্রায় ‘না’, ঘরে ঘরে প্রচারে জোর
জামায়াতের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে বলেন, প্রচারের কৌশল চূড়ান্ত করেছেন তারা। বিতর্ক তৈরি হওয়ায় গাড়িবহর নিয়ে মহড়া, বড় শোভাযাত্রা আর করা হবে না। মোটরসাইকেল মহড়ায় গত কিছুদিনে তিনজন নিহত হয়েছেন। জামায়াত পরিবর্তনের যে বয়ান তৈরির চেষ্টা করছে, এ পরিস্থিতি তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির জন্য যুগপৎ কর্মসূচি পালন করা অপর সাতটি দলের সঙ্গে আসন সমঝোতা করবে জামায়াত। এতে আরও কয়েকটি দল যোগ দিতে পারে। জামায়াত নেতারা জানান, সমঝোতা হলে শখানেক আসন ছেড়ে দিতে হবে। যেসব আসন তারা নিশ্চিতভাবে ছেড়ে দেবেন, সেগুলোতেও সর্বাত্মক প্রচার চালাচ্ছেন জামায়াত প্রার্থীরা।
দলটির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে বলেছেন, শেষ পর্যন্ত সমঝোতা না হলে যাতে পিছিয়ে পড়তে না হয়, তাই ভোটের প্রচারে ঘাটতি রাখা হচ্ছে না। আসন ছাড়ের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে নির্বাচনী তপলিশ ঘোষণার পর।
তরুণ এবং নারী ভোটাররা লক্ষ্য
জামায়াতের দুজন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সমকালকে বলেন, দলের প্রচার কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী সাড়ে তিন কোটি তরুণ এবং নারী ভোটারদের গুরুত্ব দিয়ে। পুরুষ ভোটাররা সাধারণত জাতীয় রাজনীতির ইস্যুগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে ভোট দেন। নারীরা সরকারের জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিকে গুরুত্ব দেন। তরুণরা প্রথাবিরোধী এবং পরিবর্তনকে সমর্থন করেন।
এই দুই নেতা জানান, চার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের বিজয়ে ধারণা করা হচ্ছে, তরুণদের মধ্যে জামায়াতের প্রতি সমর্থন রয়েছে কিংবা বিএনপির প্রতি বিরক্তি রয়েছে। এ সমীকরণ সামনে রেখে ছাত্রশিবির এবং ইসলামী ছাত্রী সংস্থাকে তরুণ ভোটারদের মধ্যে প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিস্তারিত পথনকশাসহ কর্মসূচি থাকবে ইশতেহারে। জামায়াতের প্রার্থী তালিকার অধিকাংশই তরুণ। তরুণদের প্রত্যাশাকে তারাই পূরণ করতে পারবেন।
দলের নেতারা জানান, ছাত্র সংসদগুলোর কয়েকজন ভিপি, জিএসকেও সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী করা হতে পারে। ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েমকে ঢাকা-৮ আসনে প্রার্থী করার বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় আছে। চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ভিপিকেও বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে সাদিক কায়েমকে প্রার্থী করার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত।
প্রথমবার যুব সমাবেশ
অন্যান্য দলের মত জামায়াতের যুব সংগঠন নেই। তার পরও তরুণ ভোটারদের পক্ষে টানতে এবারই প্রথম যুব সমাবেশ করছে জামায়াত। গত রোববার চাঁপাইনবাবগঞ্জে যুব সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি সাদিক কায়েমসহ অন্যান্য ছাত্র সংসদের নেতারা বক্তৃতা করেন।
নজরে নারী
নারী ভোটারদের পক্ষে টানতে জামায়াতের মহিলা শাখা ঘরে ঘরে প্রচার চালাচ্ছে। প্রত্যেক ওয়ার্ডে তারা নারী সমাবেশ করছে। তারা নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার সচেতনতা প্রচার চালাচ্ছে। জামায়াতের নির্বাচনী ইশতেহারে নারীদের জন্য কী কী সহায়তা কর্মসূচি থাকবে, তাও জানাচ্ছে।
দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রীরা যেভাবে শিবিরকে ভোট দিয়েছে, জামায়াতকেও নারীরা একইভাবে ভোট দেবে বলে তাদের আশা।
জামায়াতের ইশতেহারে নারীবান্ধব কর্মসূচি থাকবে বলে জানান হামিদুর রহমান। তিনি বলেন, এটা সময় হলে প্রকাশ করা হবে।
জামায়াতের প্রার্থী তালিকায় নারী থাকে না। দলটির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে জানিয়েছেন, এবার দুই-একজন নারী প্রার্থী দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হয়েছে। ঢাকা-১৮ আসনে বুয়েট ছাত্রী সংস্থার সাবেক সভানেত্রী মারদিয়া মমতাজকে প্রার্থী করা হতে পারে।
আওয়ামী লীগ এবং হিন্দু ভোটার টানতে কৌশল
জামায়াতের ছয়জন কেন্দ্রীয় নেতা সমকালকে বলেন, আওয়ামী লীগের পদধারী নেতাদের ভোট দাঁড়িপাল্লা পাবে না। শেখ হাসিনার কট্টর সমর্থকদের ভোটও পাবে না। কিন্তু সাধারণ পর্যায়ে সমর্থকের ভোট টানতে চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিএনপির অভিযোগ, ভোটের জন্য আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করছে জামায়াত। মামলা পরিচালনা ও জামিনে সহায়তা করছে। একই অভিযোগ বিএনপির বিরুদ্ধেও করছে জামায়াত।
ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) আসনের জামায়াত প্রার্থী কামরুল হাসান মিলন সমকালকে বলেন, আওয়ামী লীগ শাসনামলে অপরাধে জড়িত ছিল না এমন ব্যক্তিদের ভোট দাঁড়িপাল্লায় আসবে। কারণ, ৫ আগস্টের পর জামায়াত তাদের কারও ব্যবসা-বাড়িঘর-জমি দখল করেনি। হামলা-মামলা করেনি। এগুলো করেছে একটি নির্দিষ্ট দলের লোকজন। আওয়ামী লীগের পদধারী নেতারা বিচার থেকে রক্ষা পেতে সেই দলকে ভোট দিতে পারে। কিন্তু নিরপরাধ সাধারণ সমর্থকরা জামায়াতকে ভোট দেবে– তাদের এমনটাই মনে হয়েছে।
দেশের মোট ভোটারের ৮ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের। জামায়াত সাধারণত হিন্দুদের ভোট পায় না। ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে শিবির একচেটিয়া জয় পেলেও ধর্মীয় সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের ভোটের ১ শতাংশও পায়নি। কিন্তু এবার জাতীয় নির্বাচনে তারা হিন্দু ভোট পাওয়ার আশা করছে।
ইতোমধ্যে খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকায় জামায়াত ‘সনাতন সমাবেশ’ করেছে। খুলনা-১ আসনসহ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত একাধিক আসনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে প্রার্থী দিতে পারে জামায়াত।
দলটির একজন নেতা সমকালকে বলেন, সংখ্যালঘু ভোটের ৫-১০ শতাংশ পেলেই যথেষ্ট। জামায়াতকে যাতে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের দল হিসেবে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করাতে না পারে, সে জন্যই সংখ্যালঘুদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবারের ভোটের প্রচারে।
চাঁদাবাজিবিরোধী বার্তায় জোর
৫ আগস্টের পর বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে চাঁদাবাজি, দখলবাজির অনেক অভিযোগ এসেছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে শতাধিক নেতাকর্মীর প্রাণহানি হয়েছে। বিএনপি দলের কয়কে হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে।
এ পরিস্থিতিতে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বিএনপিকে লক্ষ্য করে চাঁদাবাজি, দখলের রাজনীতির বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিচ্ছেন জামায়াতের আমিরসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা। নির্বাচনী প্রচারেও দলটির প্রার্থী নেতারা বলছেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি বাড়বে। তা ঠেকাতে জামায়াতকে ভোট দিতে হবে।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির আগে গত ১৩ নভেম্বর সমকালকে বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ও গণভোট ‘সুশাসন বনাম চাঁদাবাজির’। জামায়াত সংস্কার ও সুশাসনের পক্ষে। অন্যরা কী করছে, তা তো জনগণ দেখছে।
আবার কুমিল্লা, কুড়িগ্রামসহ কয়েকটি এলাকায় জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজি, মামলা বাণিজ্যের অভিযোগ এসেছে। এর পরও জামায়াত কী করে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রচার চালাবে– এমন প্রশ্নে ডা. তাহের বলেছেন, সারাদেশে তিনটি কি চারটি অভিযোগ এসেছে জামায়াতের নিচের দিকের কর্মীদের বিরুদ্ধে। সব ঘটনায় জামায়াত কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।