Image description

অন্যের জন্য কবর খুঁড়লে নিজেকেই সেই কবরে পড়তে হয়। প্রবাদটি ২০২৪ সালের আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশের স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে আবারও সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে তাঁর সরকার উন্নত নজরদারি প্রযুক্তি, বিশেষ করে পেগাসাসের মতো স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সাংবাদিক ও সমালোচকদের ফোনে আড়ি পেতে নজরদারিতে রাখত।
২০২৪ সালের জুলাই মাসের শিক্ষার্থীনেতৃত্বাধীন আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনার কার্যকলাপের ওপর সেই একই নজরদারি ব্যবস্থা তাঁর বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়েছে। ফাঁস হওয়া তাঁর ফোনালাপগুলো তাঁরই বিরুদ্ধে চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে যুক্ত হয়।
গণ-অভ্যুত্থান দমনে হাসিনা মোবাইল ফোনে বিভিন্ন সময় নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তাঁর সেই কথোপকথনই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর ফোনে আড়িপেতে ধারণ করা হয়। উন্নত প্রযুক্তির যে যন্ত্র ব্যবহার করে এসব করা হয়েছে, হাসিনার সরকারই তা বিদেশ থেকে এনেছে। এই যন্ত্রটি ব্যবহার করে ফ্যাসিস্ট আমলে বিরোধী দলের সদস্যসহ সরকারবিরোধী অনেকের মোবাইল ফোনের কথোপকথন ফাঁস হয়েছে। সেই যন্ত্রটি ব্যবহার করেই হাসিনার আন্দোলন দমনের কৌশল আড়িপেতে শুনেছিল ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)।
ফাঁস হওয়া ফোনালাপ থেকে জানা যায়, হাসিনা জঙ্গি তকমা লাগিয়ে গণ-অভ্যুত্থান দমনের কথা বলেছেন। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। ড্রোন দিয়ে অবস্থান শনাক্ত করে হেলিকপ্টার থেকে ওপর থেকে গুলি করাচ্ছেন। যাকে যেখানে পাওয়া যাবে সোজা গুলি করবে—এমন নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, রাজাকারদের মতো আন্দোলনকারীদের ফাঁসি দেওয়া হবে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাসিনার ফোনালাপগুলো গণহত্যায় তাঁর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ট্রাইব্যুনালে হাসিনার যেসব ফোনালাপ শোনানো হয়, সেগুলোকে মামলার ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে প্রসিকিউশন।
আদালতে তিনজনের সঙ্গে হাসিনার চারটি কথোপকথনের রেকর্ড বাজিয়ে শোনানো হয়। হাসিনা গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম মাকসুদ কামাল ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তখন তাঁরা আন্দোলন দমনে বিভিন্ন কর্মকৌশল সম্পর্কে কথা বলেন। যেমন—আন্দোলনকারীদের অবস্থান ড্রোনের মাধ্যমে নির্ণয় করে, হেলিকপ্টার থেকে গুলি, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার, আন্দোলনকারীদের তালিকা করে পাকড়াও করা। এছাড়া, রাজাকার আখ্যা দিয়ে মেরে ফেলা, ছত্রীসেনা নামিয়ে বোম্বিং করা, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা, আগুন লাগানো, জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে প্রচারণাসহ আরো অন্যান্য নির্দেশনা দিয়েছেন হাসিনা।
বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা, প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা সেসময় জানান, এ রকম ৬৯টি কথোপকথন গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর প্রসিকিউশনের হাতে আসে। তদন্তের সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জোহা বিটিআরসি, এনটিএমসি, ডিএমপিসহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তর থেকে বিভিন্ন অডিও ক্লিপ, ভিডিও ফুটেজ, সিডিআর, আইপিডিআর, সিসি ক্যামেরা ফুটেজসহ ডিজিটাল ফরেনসিক বিষয় সংগ্রহ করেছেন।

হাসিনার শাসনামল এবং ডিজিটাল নজরদারির উত্থান
২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাপকভাবে ডিজিটাল নজরদারির ওপর নির্ভর করে মতপ্রকাশ ও বিরোধিতা দমন করে। এ সময় বিদেশ থেকে নানা ধরনের নজরদারি প্রযুক্তি কেনা হয়। ইসরায়েলের সঙ্গে সরকারি কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে সেই দেশ থেকে স্পাই টেক সংগ্রহের অভিযোগ ওঠে। ২০১৫ সালের পর কমপক্ষে ১৯০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এসব প্রযুক্তি কেনা হয়।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের অধীন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) নজরদারি ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ফোন, ডেটা ও যোগাযোগ আটকানো এবং বিশ্লেষণের দায়িত্ব তাদের ওপরই ছিল।
সবচেয়ে আলোচিত প্রযুক্তি ছিল এনএসও গ্রুপের তৈরি পেগাসাস। এই স্পাইওয়্যার ফোনে সংক্রমিত হয়ে গোপনে ডেটা নেয়, কথোপকথন রেকর্ড করে এবং অবস্থান অনুসরণ করে। ২০২১ সালের ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’-এর বিশ্বব্যাপী তদন্তে বাংলাদেশকে এই প্রযুক্তির সম্ভাব্য ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিরোধী নেতা, সাংবাদিক ও অধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে এটি ব্যবহৃত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরও মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের অনুরূপ ইসরায়েলি প্রযুক্তি আনা হয় বলে তথ্য রয়েছে। এসব সক্ষমতা এনটিএমসি-র মাধ্যমে সমন্বিত হয়ে দেশজুড়ে একধরনের ‘ডিজিটাল পুলিশি রাষ্ট্র’ সৃষ্টি করে, যা বিরোধীদের বিরুদ্ধে কথোপকথন ফাঁস, গ্রেপ্তার ও দমনকে আরও সহজ করে তোলে। কিন্তু শেষে নিজের খোঁড়া সেই কবরেই পড়েন শেখ হাসিনা।

২০২৪-এর আন্দোলন ও পরিস্থিতির মোড় ঘোরা
২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কার দাবির আন্দোলন দ্রুতই দেশব্যাপী সরকারবিরোধী গণআন্দোলনে রূপ নেয়। কঠোর দমনে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়। চাপে পড়ে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ২০২৪ ভারতে পালিয়ে যান। পরে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সহায়তায় তদন্ত শুরু হয়।
ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হলো, হাসিনা সরকারের গড়ে তোলা নজরদারি কাঠামোই তখন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। এনটিএমসি তাঁর ফোনালাপও রেকর্ড করে রাখে—বিশেষত আন্দোলনের সময়ে দেওয়া নির্দেশনা। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রসিকিউশনের কাছে ৬৯টি অডিও রেকর্ডিং জমা দেওয়া হয়।
এ রেকর্ডগুলোতে নিরাপত্তা বাহিনীকে ‘লেথাল ওয়েপন বা প্রাণঘাতি অস্ত্র’ ব্যবহার এবং গুলি চালানোর জন্য শেখ হাসিনার নির্দেশ পাওয়া যায়। এ অংশ বিবিসি আই ফরেনসিকস ও সিআইডি যাচাই করেছে। সেই সঙ্গে ড্রোন নজরদারি, হেলিকপ্টার থেকে বোমা হামলা, এবং বিক্ষোভকারীদের ‘জঙ্গি’ বা ‘রাজাকার’ হিসেবে চিহ্নিত করার পরিকল্পনা ফাঁস হয় এই ফোনালাপে।
জানা যায় ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এস এম মাকসুদ কামালের সঙ্গে ইন্টারনেট বন্ধ, গ্রেপ্তার অভিযানসহ বিভিন্ন কৌশল নিয়ে আলোচনা।
২০২৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোয়া চারটি অডিও বিশ্লেষণের প্রতিবেদন জমা দেন। এতে হাসিনার কণ্ঠ শনাক্ত করা হয়। এসব ফাঁস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ ছড়িয়ে দেয় এবং আইসিটি মামলার ‘গুরুত্বপূর্ণ’ প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

আজকের রায়
১৭ নভেম্বর ২০২৫ আইসিটি হাসিনা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী—সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন—এর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণা করছে। ২০১০ সালে হাসিনা নিজেই যে ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, আজ সেই আদালতেই তিনি অনুপস্থিত অবস্থায় পাঁচটি অভিযোগে বিচারাধীন।
রাষ্ট্রপক্ষ তাঁর মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছে। সাম্প্রতিক হামলার প্রেক্ষিতে নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়েছে, এমনকি অগ্নিসংযোগকারীদের দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশও আছে। হাসিনা এ বিচারকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে দাবি করেছেন। তাঁর ছেলে সতর্ক করেছেন যে দল নিষিদ্ধ হলে সহিংসতা বাড়তে পারে।

কর্মফলের প্রতিধ্বনি
শেখ হাসিনা আন্দোলন দমনে যেসব চরম নির্দেশনা দিয়েছেন সেসব কথোপকথন এখন তাঁরই বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এইসবই পাওয়া গেছে তাঁরই তৈরি নজরদারি ব্যবস্থার মাধ্যমে। যে প্রযুক্তি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে ব্যবহার করেছেন তিনি তা তাঁর বিরুদ্ধেই ডিজিটাল প্রমাণ হিসেবে ফিরে এসেছে। এটি বিশ্বব্যাপী পেগাসাস কেলেঙ্কারির প্রতিধ্বনিই তুলে ধরে—স্পাইওয়্যার সরকারকে শক্তিশালী করলেও শেষ পর্যন্ত শাসনকর্তাকেও ফাঁসাতে কাজ করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ঘটনা দেখায় যে নিয়ন্ত্রণহীন নজরদারি কতটা বিপজ্জনক। কর্তৃত্ববাদী প্রযুক্তি সবচেয়ে গভীর কবর খুঁড়ে দেয় যারা এটি চালায় তাদের জন্যই।