ঝিনাইদহে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় লেদ মেশিনে দীর্ঘদিন ধরে কৃষি যন্ত্রপাতি, মোটরসাইকেল পার্টসসহ লোহার বিভিন্ন যন্ত্র তৈরির কাজ চলে আসছে। তবে সম্প্রতি এই স্বাভাবিক শিল্প-কারখানার আড়ালে গড়ে উঠেছে একটি বিপজ্জনক নেটওয়ার্ক। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে হাতে তৈরি আগ্নেয়াস্ত্রের কারখানা। মহেশপুর উপজেলার ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা কয়েকটি গ্রামের বাসাবাড়িতে গোপনে এসব অস্ত্র তৈরি হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অপরাধীদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে খুব অল্প সময়েই।
এতে উদ্বেগ বাড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। সম্প্রতি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহেশপুরের ভারতীয় সীমান্তবর্তী গ্রাম মড়কধ্বজপুর, রায়পুর, কচুয়ারপোতা ও লেবুতলায় কয়েকটি বাড়িতে ছোট ছোট লেদ মেশিন বসানো হয়েছে। তবে সম্প্রতি এসব গ্রামের অন্তত ছয়টি বাড়ির মধ্যে লেদ কারখানায় আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছে।
বেশির ভাগ বাড়ির মালিকরা অনেক সময় জানেনই না তাঁদের বাড়িতে রাতের আঁধারে কী তৈরি হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও মালিকরাই এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়, আধুনিক অস্ত্রের মতো দেখতে ওয়ানশ্যুটার গান, মডিফায়েড পিস্তলসহ নানা ধরনের অস্ত্র বানানো হচ্ছে অতি সাধারণ দক্ষতায়।
সূত্র জানায়, সীমান্তবর্তী কয়েকটি গ্রামে মাঝরাতে লেদ চালানোর শব্দ শোনা যায়।
অনেক সময় পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে রাতে অভিজ্ঞ কারিগররা এসে অস্ত্র তৈরি করে আবার সকালে ফিরে যান। অভিজ্ঞতাভেদে তাঁদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। জনপ্রতি ছয় থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়ে থাকে। ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এসব অস্ত্র তৈরি করা হচ্ছে।
অপরাধীদের কাছে দাম কম ও সহজলভ্য হওয়ায় এসব অস্ত্রের চাহিদা রয়েছে।
স্থানীয় কিছু চোরাকারবারির মাধ্যমে এগুলো পৌঁছে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আকারভেদে একেকটি আগ্নেয়াস্ত্র ৮ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা মেহেদী হাসান বলেন, ‘এগুলো আমাদের এলাকার বাসিন্দাদের জন্য চরম আতঙ্কের বিষয়। একই সঙ্গে দেশের আইন-শৃঙ্খলার জন্যও উদ্বেগের কারণ। প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলছে। সীমান্ত এলাকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এখন হুমকির মুখে।’
অপরাধ বিশ্লেষক মোহাম্মদ লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘লেদ কারখানাগুলো শনাক্ত করতে প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি, সীমান্তে যৌথ টহল, স্থানীয় সোর্স নেটওয়ার্ক সক্রিয়করণ এবং অস্ত্র তৈরির মূল রিংলিডারদের গ্রেপ্তার করা জরুরি। তা না হলে অল্প খরচে অস্ত্র তৈরি ও পাচারের এই প্রবণতা ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ নিরাপত্তা সংকট তৈরি করবে। শুধু অভিযানে এই সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ চক্রটির শিকড় সীমান্তঘেঁষা বড় নেটওয়ার্কে। মাদক, ফেনসিডিল ও স্বর্ণ চোরাচালানকারী এসব নেটওয়ার্কের ভোগান্তি বাড়াতে এখন যুক্ত হয়েছে দেশীয় অস্ত্র তৈরির কারখানা। সীমান্তের এই লুকানো অস্ত্র কারখানাগুলো এখন সময়ের বড় হুমকি। যত দ্রুত এগুলো চিহ্নিত ও বন্ধ করা হবে, তত দ্রুত নিরাপত্তা ফিরবে সীমান্ত জনপদে।’
মহেশপুর ৫৮ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল রফিকুল আলম বলেন, ‘সীমান্ত সুরক্ষায় আমরা কঠোর নজরদারি বাড়িয়েছি। তবে আমাদের এলাকায় অস্ত্র তৈরির তথ্য জানা নেই। গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়িয়ে ওইসব লেদ কারখানায় অভিযান পরিচালনা করা হবে।’
এ ব্যাপারে ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, ‘এরই মধ্যে সীমান্ত এলাকার লেদ কারখানাগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যে কারাখানাগুলোতে অস্ত্র তৈরি করা হচ্ছে, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে শিগগিরই অভিযান চালানো হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘জেলার সব লেদ কারখানার তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। একই সঙ্গে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ এ নিয়ে কাজ করছে। আশা করছি, এই সংকটের নিরসন ঘটবে।’