সংস্কার প্রশ্নে গত প্রায় সাড়ে আট মাস রাজনৈতিক দলগুলো ছিল আলোচনার টেবিলে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে সবকিছু। কিন্তু নভেম্বরে আবার রাজপথে কর্মসূচি নিয়ে নেমেছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলো। একদিকে সংস্কার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে ভিন্নমত, অন্যদিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে নির্বাচনের সময়। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঠের কর্মসূচি নিয়ে নামার পেছনে নির্বাচনের প্রস্তুতি, নাকি রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করার ইঙ্গিত—এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংস্কারসহ নানা বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের অবস্থান অনেক ক্ষেত্রেই বিপরীতমুখী। এর মধ্যে ১১ নভেম্বর জামায়াতসহ আটটি ইসলামপন্থী দল ঢাকায় সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের মূল দাবি হচ্ছে—জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি এবং ওই আদেশের ওপর নভেম্বর মাসের মধ্যেই গণভোট আয়োজন করা; আগামী জাতীয় নির্বাচনে উভয় কক্ষে বা উচ্চকক্ষে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি চালু করা।
সাড়ে ৮ মাসে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে টানা বৈঠক করে জুলাই সনদ প্রণয়ন করে কমিশন। অধিকাংশ দলই তাতে সই করে। কিন্তু এই জুলাই সনদের আলোকে কীভাবে সংস্কার বাস্তবায়িত হবে—এ বিষয়ে একমত হতে পারেনি দলগুলো।
অন্যদিকে গণভোট ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের দিনই করার পক্ষে বিএনপি। দলটি ইতিমধ্যে ২৩৭ আসনে তাদের দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। গত শুক্রবার থেকে একধরনের নির্বাচনী আমেজে মাঠের কর্মসূচিতে নেমেছে দলটি। উপলক্ষ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’। এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, কুমিল্লা, বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহ, বগুড়াসহ সব বিভাগ ও জেলায় সমাবেশ ও শোভাযাত্রা করেছে দলটি। এসব কর্মসূচিতে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ধানের শীষের নির্বাচনী পোস্টার, ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড প্রদর্শিত হয়।
গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে। এরপর দেশের রাজনীতিতে বিএনপি, জামায়াত, অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বড় শক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জামায়াত ও বিএনপি মাঠের কর্মসূচি দিলেও এনসিপি এখনো তেমনটা ঘোষণা করেনি।
বিএনপির মহাসচিবকে আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু ওনারা বলেছেন, জামায়াতের আহ্বানে তাঁরা সাড়া দেবেন না। বিগত রেজিম কিন্তু এ ধরনের সুর সব সময় বাজাত যে ওমুকের সঙ্গে বসবে না।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ এই কমিশনের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। প্রায় সাড়ে ৮ মাসে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে টানা বৈঠক করে জুলাই সনদ প্রণয়ন করে কমিশন। অধিকাংশ দলই তাতে সই করে। কিন্তু এই জুলাই সনদের আলোকে কীভাবে সংস্কার বাস্তবায়িত হবে—এ বিষয়ে একমত হতে পারেনি দলগুলো। ৩ নভেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করতে হবে। তবে আলোচনার পথে না গিয়ে রাজপথের কর্মসূচির দিকে ঝুঁকছে দলগুলো।
এর মধ্যে কার্যক্রম–নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ অনলাইন মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছে, ১৩ নভেম্বর ঢাকা ‘লকডাউন’ কর্মসূচি পালন করবে। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচারকাজ শেষ। রায় কবে ঘোষণা করা হবে, তা জানাতে ১৩ নভেম্বর তারিখ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগও দলটির পতিত শাসকের রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে রাজপথে নামতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এ সবকিছু মিলিয়েই রাজনীতি আবার উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। একের পর এক দল নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। কেউ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, কেউ সংস্কারে জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে, কেউ নিষেধাজ্ঞা ভেঙে প্রতিরোধের বার্তা দিতে চাইছে। বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বাধীন পক্ষগুলোর বিপরীতমুখী অবস্থানের সুযোগ আওয়ামী লীগ নিতে চাইবে—এটাই স্বাভাবিক বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
সব মিলিয়ে নভেম্বরের শুরুতেই দেশের রাজনীতির অঙ্গনে ফিরে এসেছে পুরোনো উত্তাপ, পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
এর মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের বক্তৃতায় সেই উত্তাপের টের পাওয়া যাচ্ছে। জামায়াতের সমাবেশের দিকে ইঙ্গিত করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘কথায় কথায় আপনি রাস্তায় যাবেন। এখন অন্য দল যদি তার প্রতিবাদে আবার রাস্তায় যায়, তাহলে কী হবে, সংঘর্ষ হবে না? বৃহত্তর দল বাংলাদেশে যদি রাস্তায় নামে এগুলোর প্রতিবাদে, সংঘর্ষ হবে।’
বিএনপি ৭ নভেম্বর ব্যাপক জনসমাগম ঘটানোর পর জামায়াত নেতারা ১১ নভেম্বরে ঢাকার রাজপথে লাখো মানুষ নামানোর ঘোষণা দিচ্ছেন। কার্যক্রম–নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগও সক্রিয় হওয়ার বার্তা দিচ্ছে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে প্রযুক্তিনির্ভর নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে এক সংলাপে আমীর খসরু এসব কথা বলেন।
একই অনুষ্ঠানে ছিলেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ। বিএনপির এখনকার আচরণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। হামিদুর বলেন, ‘বিএনপির মহাসচিবকে আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু ওনারা বলেছেন, জামায়াতের আহ্বানে তাঁরা সাড়া দেবেন না। বিগত রেজিম কিন্তু এ ধরনের সুর সব সময় বাজাত যে ওমুকের সঙ্গে বসবে না। এই কালচার থেকে কি বের হতে পারি না?’

মূলত জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার জন্য বিএনপিকে আহ্বান জানিয়েছিল জামায়াত। কিন্তু বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, জুলাই সনদের বিষয়টি জাতীয়। ফলে রাজনৈতিক দলে আহ্বানে সাড়া দিয়ে সংলাপে বসা সমীচীন হবে না। বরং সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে ডাকলে বিএনপিও অংশ নেবে।
কথায় কথায় আপনি রাস্তায় যাবেন। এখন অন্য দল যদি তার প্রতিবাদে আবার রাস্তায় যায়, তাহলে কী হবে, সংঘর্ষ হবে না?
নির্বাচনের আগে মাঠে ফেরার বার্তা বিএনপির
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে দেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে—সরকারের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা এসেছে। কিন্তু এখনো মানুষের মুখে মুখে একটা আলোচনা—নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হবে তো?
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রায় দেড় যুগ ধরে দেশের বাইরে। নভেম্বর বা ডিসেম্বরে তারেক রহমান দেশে আসবেন বলে আলোচনা আছে। এ পরিস্থিতিতে ৩ নভেম্বর হঠাৎই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৩৭টিতে নিজেদের প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে বিএনপি।
জামায়াত আগেই প্রার্থী ঠিক করে সারা দেশে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করে। বিএনপি প্রার্থী ঘোষণার মাধ্যমে ভোটের প্রস্তুতির পাশাপাশি রাজপথেও তৎপর হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
তাদের এই তৎপরতার যাত্রা শুরু হয়েছে ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবসের কর্মসূচি দিয়ে। বিএনপির দলীয় সূত্র বলছে, এই কর্মসূচি শুধু ঐতিহাসিক স্মরণ নয়; বরং এটি নির্বাচনের প্রস্তুতির সূচনা। সম্ভাব্য প্রার্থীরা এখন মাঠে সক্রিয় হচ্ছেন, দলীয় পর্যায়ে ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কমিটি পুনর্গঠনের কাজও চলছে।
বিএনপি চাইছে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হতে হবে। জামায়াতসহ ইসলামপন্থীদের চাওয়া পুরো ভিন্ন, গণভোট আগে হতে হবে। ফলে দুই পক্ষের দাবি আদায়ে নভেম্বরে রাজপথে শক্তি দেখানোর চেষ্টা চলবে। বিএনপির চাওয়া মেনে একই দিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন হলে ভোটের আগে একটা নৈতিক জয় হবে দলটির।
বিএনপি চাইছে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হতে হবে। জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলোর চাওয়া গণভোট আগে হতে হবে। ফলে দুই পক্ষের দাবি আদায়ে নভেম্বরে রাজপথে শক্তি দেখানোর চেষ্টা চলবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের চাপ জামায়াতের
ইসলামি দলগুলোর ভোট একটি বাক্সে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা গত এক থেকে দেড় বছরে বহুবার আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে জামায়াত এবং চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন এ বিষয়ে বেশ তৎপর। এরই ধারাবাহিকতায় নির্বাচনের আগে গণভোট ও উচ্চকক্ষে পিআর ব্যবস্থার দাবিতে জামায়াতসহ আটটি দল ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েছে। যুগপৎভাবে নানা কর্মসূচির পাশাপাশি ১১ নভেম্বর সমাবেশ করে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে তারা। নভেম্বরের মধ্যে গণভোট করাসহ পাঁচ দাবিতে এর আগে গত ৩০ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের কাছে স্মারকলিপি জমা দেয় এই দলগুলো।

জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে যে দলগুলো রাজপথে রয়েছে, তারা হচ্ছে খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), নেজামে ইসলাম পার্টি, ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন।
বিএনপি ৭ নভেম্বরের সমাবেশ ও শোভাযাত্রায় ব্যাপক জনসমাগম ঘটানোর পর জামায়াত নেতারা ১১ নভেম্বরে ঢাকার রাজপথে লাখো মানুষ নামানোর ঘোষণা দিচ্ছেন।
উত্তপ্ত সময়ের ইঙ্গিত
তিনটি ধারাবাহিক কর্মসূচি—৭, ১১ ও ১৩ নভেম্বর। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়টিকে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে ব্যস্ত ও স্পর্শকাতর করে তুলেছে।
রাজনৈতিক দলগুলো একদিকে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে টানাপোড়েনে আছে, অন্যদিকে মাঠে নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাড়তি সতর্কতায় আছে। কারণ, যেকোনো সময়ে সংঘর্ষ বা সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে। তবু দলগুলো নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
বিএনপি ও জামায়াত চাইছে নিজেদের চাওয়া মেনে সংস্কার বাস্তবায়ন এবং নির্বাচন। আর কার্যক্রম–নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ মনে করছে, দেশের রাজনীতিতে নিজেদের জানান দেওয়ার এটাই মনে হয় ভালো সময়।
তবে বিএনপি ও জামায়াতের সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি, জামায়াতসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা মত থাকলেও আওয়ামী লীগের বিষয়ে তাদের কোনো নমনীয়তা নেই। ফলে আওয়ামী লীগ রাজপথে নেমে সমস্যা করতে পারবে না। বরং বিএনপি, জামায়াতসহ দেশে তৎপর রাজনৈতিক শক্তিগুলো নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকলে সংস্কার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে বেকায়দায় পড়তে হবে।
এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক শক্তিগুলো একে অপরের বিপক্ষে রাজপথেও তৎপর হতে পারে, যা আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে যে শক্তি দেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, তা ক্যালকুলেটিভ বা হিসাবি পদক্ষেপে সীমাবদ্ধ থাকবে বলেই সবার প্রত্যাশা।