জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি এবং গণভোটের সময় নিয়ে সমঝোতার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকারের বেঁধে দেওয়া সাত দিন সময় আগামী সোমবার শেষ হবে। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত সমঝোতার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
তবে বিএনপি দলের স্থায়ী কমিটিতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছে। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, কেবল সরকার উদ্যোগ নিলে আলোচনায় বসবে বিএনপি। একই সঙ্গে এমন পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য বৈঠকে সরকারের সমালোচনাও করেছেন নেতারা।
দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের ওই আলোচনায় বৈঠকের জন্য জামায়াতের আহ্বানকে ‘সঠিক পন্থা নয়’ বলে মত দেওয়া হয়েছে। জামায়াতের এ ধরনের কোনো আহ্বানে বিএনপি সাড়া দেবে না বলে জানা গেছে।
আলোচনার জন্য টেলিফোন করে বিএনপির সাড়া না পাওয়া জামায়াত আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তারা রাজপথে নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি আদায়ের কথা বলেছে। তবে বিএনপির বৈঠকে রাজপথে কোনো কর্মসূচি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি গণভোটের সময় নিয়ে নমনীয় হলেও জুলাই সনদে নোট অব ডিসেন্ট থাকতে পারবে না বলে শর্ত দিয়েছে। সব দলের মধ্যে আলোচনা নিয়ে তাদের দিক থেকে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের দুইজন উপদেষ্টা সমকালকে বলেছেন, দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ চলছে। কিন্তু কোনো দলই ছাড় দিতে রাজি হচ্ছে না। তারপরও সরকার আশাবাদী রাজনৈতিক সমঝোতা হবে।
দূতিয়ালিতে যুক্ত একজন উপদেষ্টা সমকালকে বলেছেন, দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে এটুকু স্পষ্ট, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন মাথায় রেখেই তারা এগোচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ছাড় দিতে পারছে না। ফলে তারা সমঝোতায় আসবে। ওই উপদেষ্টা বলেন, কথা বলে তাদের মনে হয়েছে, সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে তা দলগুলো মেনে নেবে। এ অবস্থায় সোমবারের মধ্যে সমঝোতা না হলে সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দলগুলোর সঙ্গে কথা বলতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অধিকাংশ উপদেষ্টা একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট করার পক্ষে মতামত দেন। তবে সোমবারের জরুরি বৈঠকে কয়েকজন উপদেষ্টা বলেন, একই দিনে গণভোট হলে সংস্কার নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে সরকার দলগুলোকে আলোচনা করে সমঝোতা করতে এক সপ্তাহ সময় দেয়।
আলোচনার লক্ষণ নেই
গত রোববার সংবাদ সম্মেলন থেকে আলোচনার আহ্বান জানায় জামায়াত। বিএনপি ও জামায়াতের দূরত্ব কমাতে এনসিপি, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ এবং ছয়দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ গত বুধবার উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানায়। এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু সমকালকে বলেছেন, পরের দুই দিন বিএনপি এবং জামায়াত নেতারা যে ভাষায় নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকার কথা বলেছেন, তা হতাশাজনক। আলোচনার উদ্যোগ কাজে আসেনি। তবে ৯ দল চেষ্টা করবে শেষ পর্যন্ত।
রাজনৈতিক সমঝোতায় অগ্রগতি নেই বলে সমকালকে জানিয়েছেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীবও।
আলোচনার জন্য গত বৃহস্পতিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে টেলিফোন করেন জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের। তবে একই দিনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় আলোচনা হয়, আলোচনার আহ্বান তামাশা মাত্র।
গতকাল মির্জা ফখরুল বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই ভোট ব্যাহত করার মতো অবস্থা তৈরি করছে। যে কয়েকটা দল গণভোটের চাপ দিচ্ছে, তাদের খুব পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, গণভোট হলে নির্বাচনের দিনই হতে হবে। নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতেই হতে হবে।
আবদুল্লাহ তাদের সমকালকে বলেছেন, আলোচনার জন্য টেলিফোন করে সাড়া পাইনি। এখন দেখব, সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়। যদি আগামী সোমবারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক থেকে নভেম্বরে গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত দিয়ে আদেশ জারি না করা হয়, তবে জামায়াত এবং যুগপৎ আন্দোলনের আট দলের আন্দোলন ছাড়া পথ খোলা থাকবে না। পরের দিন থেকেই আন্দোলন হবে।
জামায়াত এবং এনসিপির সন্দেহ, বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারলে নিজেদের মতো করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করবে। এ কারণেই বিএনপি সংস্কার প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে।
জামায়াতের মতো এনসিপিও বলছে, ঐকমত্য না হওয়ায় নোট অব ডিসেন্টের বিষয়ে ফয়সালা গণভোটে হতে হবে। এনসিপিও এই দুই সংস্কারে শক্ত অবস্থান নেবে বলে জানা গেছে। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গতকাল বলেছেন, ‘নোট অব ডিসেন্ট বলে কিছু থাকবে না। যা ঐকমত্য হয়েছে, বাকিটা ঠিক করবে জনগণ। জনগণ যদি বলে তাহলে সেগুলো বাস্তবায়িত হবে।’
রাজি হবে না বিএনপি
জামায়াতের আলোচনার আহ্বানকে ‘সঠিক পন্থা’ বলে মনে করছে না বিএনপি। দলটির অভিমত, সমস্যার সৃষ্টি করেছে সরকার এবং ঐকমত্য কমিশন। কারণ, সুপারিশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সনদের মিল নেই। বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট সনদে রাখার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে সরকার দলগুলোকে আলোচনার যে আহ্বান জানিয়েছে, তা তামাশা মাত্র।
গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ আলোচনা হয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জানা গেছে, বৈঠকে জামায়াতের টেলিফোন এবং ৯ দলের উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা হয়। নেতারা বলেছেন, জামায়াত সরকার নয়। ফলে রাষ্ট্রীয় কোনো বিষয় নিয়ে তারা বিএনপিকে ডাকতে পারে না। ব্যক্তিগত কোনো দাওয়াতে কিংবা দুই দলের মধ্যকার কোনো বিষয় হলে কথা বলতে পারে। তাই বিএনপি জামায়াতের আহ্বানে সাড়া দেবে না।
স্থায়ী কমিটির এক সদস্য সমকালকে বলেন, সরকার আলোচনায় ডাকলে বিএনপি যাবে। কিন্তু সরকার কি আলোচনা জন্য এক সপ্তাহ সময় বেঁধে দিতে পারে?
পাল্টা কর্মসূচি নয়
১১ নভেম্বর ঢাকায় জামায়াতসহ আট দলের মহাসমাবেশের পাল্টা কর্মসূচি দেবে না বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটি মনে করছে, নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা হোক– এমন পরিস্থিতি তৈরি করা যাবে না। তবে প্রয়োজনে মাঠের সক্ষমতা প্রমাণে কর্মসূচি দেওয়া যেতে পারে। এ সিদ্ধান্তেই বিএনপি জনসমর্থন ও সাংগঠনিক সক্ষমতা দেখাতে গতকাল ঢাকাসহ দেশব্যাপী জেলা ও উপজেলা সদরে ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবসে’ ব্যাপক শোডাউন করে।
বিএনপির অবস্থান হচ্ছে, সরকার ডাকলে আলোচনায় দলীয় অবস্থান জোরালোভাবে তুলে ধরা হবে। নোট অব ডিসেন্টসহ স্বাক্ষরিত জুলাই সনদের আইনানুগ বাস্তবায়ন চাইবে। সনদ বাস্তবায়নে একই দিনে গণভোট এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলবে। বৈঠকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।