জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে উদ্ভূত সংকট নিরসনে উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে ৯টি রাজনৈতিক দল। তাদের লক্ষ্য—সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো। এ লক্ষ্যে দলগুলো শিগগির বিএনপি, জামায়াতসহ ইসলামপন্থি ও বাম ঘরানার দলগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনায় বসবে। ৯ দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কীভাবে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও জুলাই সনদ নিয়ে সৃষ্ট মতানৈক্য দূর করা যায়, তা নিয়ে অপরাপর দলগুলোর দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলবেন। মূলত পাঁচটি প্রশ্ন সামনে রেখে এই আলোচনা করবেন তারা। সেগুলো হলো—জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ কীভাবে হবে, নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট হবে কি না, গণভোটে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকবে কি থাকবে না, পার্লামেন্টের অধিবেশন একই সঙ্গে একটি কনস্টিটিউশনাল পাওয়ার হোল্ড করবে কি না এবং গণভোটে পাস হওয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলো পরবর্তী সংসদের ২৭০ দিনের মধ্যে কার্যকর না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে কি না। অবশ্য এই ৯টি দল জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট ও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হওয়ার পক্ষে মোটামুটি একমত।
গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর তোপখানা রোডে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ৯ দলের সমন্বিত উদ্যোগে এক জরুরি বৈঠকে এমন আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। নয়টি দল হলো—গণতন্ত্র মঞ্চভুক্ত ছয় দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী জনশক্তি পার্টি ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি, এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদ।
সংকট নিরসনে গণতন্ত্রকামী ৯ দলের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ কালবেলাকে বলেন, আমরা রাজনৈতিক সংলাপকে সব সময় স্বাগত জানাই। এই জাতীয় রাজনৈতিক যোগাযোগ বা এনগেজমেন্ট—এটা গণতন্ত্রের জন্য সবসময় শুভ। আমরা সহযোগিতা করব, এ বিষয়ে আমরা উদার।
অন্যদিকে নির্বাচনী কাঠামো, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের বিষয়ে একটি ‘সমঝোতামূলক রূপরেখা’ তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য জামায়াতের পক্ষ থেকে দুই সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আমিরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর আলোচনার পর আমিরে জামায়াত এই কমিটি গঠন করেন। কমিটির সদস্যরা হলেন—সংগঠনের নায়েবে আমির সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি ড. হামিদুর রহমান আযাদ।
তবে নয় দলের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেও এর সুফল নিয়ে সন্দিহান রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, তারা নিঃসন্দেহে খুব ভালো একটা কাজ করেছেন। তবে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তারা কতটা কী করতে পারবেন, তাদের বক্তব্য-সুপারিশ অন্য দলগুলো কতটা শুনবে; সেটা যথেষ্ট প্রশ্নসাপেক্ষ, একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জিংও। কারণ, কোনো রাজনৈতিক দলের কথা আরেকটি দল কেন শুনবে? প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই এজেন্ডা, মিশন, ভিশন, প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধরন—সবই তো আলাদা। তা ছাড়া সবগুলো দলকে আপনি একই মতে পাবেন, এটা আশাই বা কেন করেন। তাহলে তো একটি রাজনৈতিক দল থাকলেই হতো। রাজনৈতিক দলগুলো যদি একমতই প্রকাশ করে, সবাই যদি একই হয়ে যায়, তাহলে তো একদলীয় ব্যবস্থাই হয়ে গেল। সেক্ষেত্রে তো ভিন্ন দল দরকার নেই।
দীর্ঘ আলোচনার পর রাজনৈতিক দলগুলো গত ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলেও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে মতভেদ থেকে যায়। এমন অবস্থায় ২৮ অক্টোবর জাতীয় নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের দিন গণভোট করাসহ জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায়-সম্পর্কিত সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে বলা হয়, আগামী সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি প্রথম ২৭০ দিন (৯ মাস) সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো এই সময়ের মধ্যে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে। তবে পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে। সুপারিশে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫ জারি করতে সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই আদেশের অধীনে হবে গণভোট। আর গণভোট কখন হবে, তা নির্ধারণ করবে সরকার।
তবে গণভোটের পর বিএনপি ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত হয়। দলটির অভিমত, বিএনপি সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার (অংশীজন) হওয়া সত্ত্বেও কমিশনের সুপারিশে তাদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে, বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট (দ্বিমত)’ সনদে লিপিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা রাখা হয়নি। বিএনপির অবস্থান হচ্ছে, তারা জাতীয় নির্বাচনের দিনই একই সঙ্গে গণভোট চায় এবং ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ গণভোট চায়। অন্যদিকে জামায়াত আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে নভেম্বরে গণভোটের দাবি জানায়। তবে দলটির বর্তমান অবস্থান হচ্ছে, নির্বাচনের আগে যেকোনো দিন এটি হতে পারে। এতে তাদের কোনো আপত্তি নেই।
এমন অবস্থায় গত সোমবার গণভোট ও জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা নিয়ে বিএনপি, জামায়াতসহ দলগুলোর মধ্যে যে রাজনৈতিক অনৈক্য তৈরি হয়েছে, তা দূর করে এক সপ্তাহের মধ্যে সরকারকে সুপারিশ দেওয়ার আহ্বান জানায় অন্তর্বর্তী সরকার। এ সময়ের মধ্যে দলগুলো নিজেরা আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা করে একমত হবে বলে মনে করছে সরকার। তবে এ সময়ের মধ্যে দলগুলো একমত হতে না পারলে সরকার তার নিজের মতো করেই কাজ করবে বলে জানান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। এমন অবস্থায় দলগুলোর মধ্যকার দূরত্ব ঘোচাতে আলোচনার উদ্যোগ নিল ৯টি রাজনৈতিক দল।
সভায় উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ূম, এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, মুখপাত্র ফারুক হাসান, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন ও সিনিয়র সহসভাপতি তানিয়া রব, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল্লাহ কায়সার, ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, মহাসচিব আবু ইউসুফ সেলিম প্রমুখ।
পরে হাসনাত কাইয়ূম সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের দিক থেকে জুলাই সনদ ও গণভোটের বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে দায়দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিতে সাত দিনের সময় দিয়েছে। সে জায়গা থেকে আমরা বসেছি, কীভাবে সমাধান করা যায়। কিছু বিষয় আমরা কাছাকাছি আসছি। অন্যান্য দলের সঙ্গেও আমরা আলোচনা করব।
মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, একেক দল একেক ফর্মুলা প্রস্তাব করে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করছে। এখন আমরা একটা ফর্মুলা বললে অহেতুক বিতর্ক তৈরি হবে, যেটা আমরা এড়াতে চাই। সংস্কার নিয়ে সংকট সমাধানে আমরা অন্য দলগুলোর সঙ্গে কথা বলব। তবে সরকার চাইলেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে। কারও সঙ্গে তাদের কথা বলা দরকার হলে বলতে পারবে। আমরা কোনো উদ্যোগ না নিলে জনগণ বলত, আপনারা কিছু করলেন না। আশা করছি, ইনশাআল্লাহ একটা সুষ্ঠু সমাধান হবে। এটা করতেই হবে।
আখতার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, এনসিপি সব সময় আলোচনার পক্ষপাতী। সবার সঙ্গে মিলে যে কোনো সংকট দূরীভূত করতে আজকে এ আলোচনা। অনেক বিষয়ে কথা হয়েছে। সংস্কার নিয়ে সংকট যেন সুষ্ঠুভাবে সমাধান হয়, এ ব্যাপারে সরকারকে সাহসী ভূমিকা নিতে হবে।
বিএনপি-জামায়াতসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী বিভিন্ন দলের সঙ্গে ৯ দল আলোচনায় বসবে বলে জানান রাশেদ খান। তিনি বলেন, দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ঐকমত্যে এসে আমরা নির্বাচনের দিকে যেতে পারব বলে আশা করি।
সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, আমরা মনে করি, ঐকমত্য কমিশন ও সরকার এ ক্ষেত্রে একটা দায়িত্বহীন কাজ করেছে। তারা দায় এড়ানোর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টে বলটা ছেড়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা এর একটা সমাধান সূত্র বের করার চেষ্টা করছি। অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আমরা বসব, আলোচনা করব।