Image description

প্রায় নয় বছর আগে মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়। চলতি বছর বিচার শেষে চার আসামির ফাঁসির রায় দেয় আদালত। বিচার পেলেও মেয়েটি আর স্বাভাবিক হতে পারেনি। সে ঘরবন্দি, চুপচাপ; কারো সঙ্গে কথা বলে না।

চিকিৎসক বলছেন, মেয়েটি সেই নির্যাতন ভুলতে পারছে না। সে এখনো ‘ট্রমার’ মধ্যে আছে। পারিবারিক ও সামাজিক পরিস্থিতি সেটা আরও জটিল করে তুলেছে। মেয়েটির ‘কাউন্সেলিং’ দরকার।

ঘটনাটি বরিশাল নগরীর। ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর ১৯ বছর বয়সি মেয়েটিকে চার যুবক ধর্ষণ করে। পরে তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আরও একজন ধর্ষণ করে।

টানা প্রায় নয় বছর মামলা চলার পর ২৬ অক্টোবর বরিশালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মুহা. রকিবুল ইসলাম ধর্ষণের দায়ে চারজনের ফাঁসির রায় দেন।

আসামিরা হলেন- বরিশাল নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের রূপাতলী এলাকার রাসেল গাজী (৪৪), একই এলাকার রোকন খান (৩২), রাজিব জমাদ্দার (৩৪) ও জাহিদ হাওলাদার (৩৫)।

রায় ঘোষণার সময় তিন আসামি উপস্থিত থাকলেও রোকন খান পলাতক। মামলা চলাকালে জামিনে বেরিয়ে পলিয়ে যান তিনি।

বীভৎস রাত

মামলার এজাহার ও ভুক্তভোগীর পরিবার থেকে জানা যায়, মেয়েটির মাত্র কয়েকদিন আগেই বিয়ে হয়। কিন্তু তখনও স্বামীর বাড়িতে যাওয়া হয়নি। থাকতেন বাবা-মা আর ভাই-বোনের সঙ্গে। ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর মায়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটির পর মেয়েটির অভিমান হয়। স্বামী তখন বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি ছিলেন।

 

মেয়েটি রাতের বেলা অভিমান করে বাসা থেকে বেরিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা করার জন্য ইজিবাইকে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হন। চালক তাকে ভুল পথে প্রথমে নগরীর ত্রিশ গোডাউন ব্রিজের কাছে নিয়ে যায়।

সেখানে গিয়ে চালক তার আরও তিন সহযোগীকে গাড়িতে তোলে। পরে তারা খ্রিস্টানপাড়া এলাকার একটি নির্জন বনে নিয়ে যায় মেয়েটিকে।

সেখানে রাতভর মেয়েটিকে আটকে রেখে ও ভয় দেখিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়। ভোরবেলা তাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় একটি বাড়ির সামনে ফেলে যায় চার যুবক। সেখানে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি মেয়েটিকে সহায়তার কথা বলে আবারও ধর্ষণ করে।

পরে মেয়েটি রাস্তায় এলে স্থানীয় কয়েকজন তাকে আটক করে। জামা-কাপড় ঠিক না থাকায় ‘খারাপ মেয়ে’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে মারধর করে ফেলে রাখে।

পরে মেয়েটির পরিবার তাকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে যায়। পরদিন মেয়েটি বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন।

সংসার হারিয়েছে মেয়েটি

মেয়েটির পরিবার নগরীর একটি এলাকায় কিছুটা জায়গা কিনে একটি বাসা বানিয়ে বসবাস করছে। আধা পাকা একটি বাড়িতে চারটি ঘর। কোনোমতে চলা পরিবার। সেই বাড়ি থেকেই মেয়েটি হাসপাতালের উদ্দেশে বেরিয়েছিল।

সম্প্রতি সেই বাড়িতে গিয়ে মেয়েটির মা, ভাই ও বোনের সঙ্গে কথা হয়। কিন্তু মেয়েটির সাক্ষাত পাওয়া যায়নি।

পরিবার জানায়, ওই ঘটনার পর পরই মেয়েটির স্বামী তাকে তালাক দেয়। বিয়ের কয়েক দিন পর ঘটনাটি ঘটে। মেয়েটির স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছে, সেই পরিবারে সন্তানও আছে।

ঘটনার পর থেকেই মেয়েটি মনমরা ছিলেন। স্বামী তালাক দেওয়ার পর তিনি একেবারে ঘরবন্দি হয়ে পড়েন। পরিবারের সদস্য ছাড়া আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গেও কথা বলেন না। অনেক সময় খালি কান্নাকাটি করেন।

পরিবার জানায়, মেয়ের চিন্তায় বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হন। কয়েকদিন পর তিনিও মারা যান।

মেয়েটির মা বলছিলেন, “মেয়ের চিন্তায় বাবা গেল। এখন মেয়েটা দিন দিন ভেতর থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়ার অভাবে আমরা নিজেরাও অসুস্থ হয়ে পড়েছি। চিকিৎসার খরচ তো দূরের কথা, নিজের ওষুধ কেনার টাকাও জোটে না।”

আসামিদের হুমকি

আসামিদের সবার ফাঁসির রায় হওয়ায় ভুক্তভোগীর পরিবার খুশি। কিন্তু দণ্ডিতদের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত হুমকি আসছে। বাড়ি বিক্রি করে অন্য জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করছে পরিবারটি। কিন্তু আসামিদের তৎপরতায় সেটাও পারছেন না।

ভুক্তভোগী মেয়েটির বড় বোন বলেন, “রায় হওয়ার পর থেকেই হুমকি আসছে। বলা হচ্ছে, ওরা হাই কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে আসবে, তখন আমাদের দেখে নেবে। আমরা এখন আতঙ্কে আছি।”

তিনি বলেন, “ধর্ষকরা এতটাই অমানুষ যে, বোনকে ধর্ষণের সময় সে পানি চেয়েছিল। তখন তার মুখের উপর প্রশ্রাব করেছে। বোন যখন রাস্তায় পড়েছিল তখন তাকে কেউ সহায়তা তো করেনি; উল্টো মারধর করেছে লোকজন। নির্মম এ ঘটনার অনেকেই বিচারের আওতায় আনতে পারেনি পুলিশ।”

ভুক্তভোগীর মায়ের আকুতি, “বিচার পেয়েছি, কিন্তু শান্তি পাইনি। আমার মেয়ের নিরাপত্তা আর চিকিৎসার ব্যবস্থা যেন কেউ করে দেয়, এইটা চাই।”

আসামিদের জবানবন্দি

আসামিদের মধ্যে জাহিদ হাওলাদার রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করতেন, রোকন খান একটি সিমেন্ট কারখানার কর্মচারী, রাসেল গাজী চায়ের দোকানদার, রাজীব জমাদ্দার একজন ট্রাক চালক। তারা সবাই আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

জবানবন্দিতে চার আসামিই বলেছেন, তারা প্রায়ই রাসেল গাজীর কাছে গাঁজা খেতে যেতেন। সেদিন তারা গাঁজা খেতে গিয়েছিলেন। তখন দেখতে পান, রাসেল গাজী মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে। পরে তারা এতে যোগ দেন।

বরিশাল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) আব্দুল মান্নান মৃধা বলেন, “বিচারক রায়ে প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেছেন। জরিমানার টাকা মানসিক ভারসাম্য হারানো মেয়েটিকে দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। এখন জরিমানার টাকা তিনি যেন পেতে পারেন, সেজন্য জেলা প্রশাসককে উদ্যোগ নিতে হবে।”

‘মেয়েটির দীর্ঘ চিকিৎসা প্রয়োজন’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, “আমাদের কাছে আবেদন করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সমাজসেবা অধিদপ্তরকে বিষয়টি যাচাই-বাছাই করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হবে।”

জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, “জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের বরিশাল জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রতিমা সরকার বলেন, “বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করব। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে কথা বলব। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ‘রোকেয়া সদন’ আছে। সেখানে এ ধরনের নারীদের রাখা, মানসিক চিকিৎসা ও কাউন্সেলিং করা হয়। আমরা গিয়ে দেখে সেখানে পাঠানোর উদ্যোগ নেব।”

বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মশিউল মুনীর বলেন, “মেয়েটিকে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা দিতে হবে। এজন্য তাকে হাসপাতালের মানসিক ওয়ার্ডে ভর্তি করতে হবে। আমরা সব ধরনের সহায়তা করব।”