বগুড়া-৭ আসনটি গাবতলী ও শাজাহানপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মভূমির আসনটিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বরাবরই প্রার্থী হন। তাই এটিকে ভিআইপি আসন বলেন দলীয় নেতাকর্মীরা। যদিও সংসদে এই আসনের প্রতিনিধিত্ব করেননি খালেদা জিয়া। প্রতিবার উপনির্বাচনের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। স্বাধীনতার পর থেকে সংসদ ও উপনির্বাচন মিলে ১৫ বার ভোট হয়েছে। এতে বিএনপি ১০ বার, আওয়ামী লীগ দুবার, জাতীয় পার্টি দুবার এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী একবার নির্বাচিত হন। আগামী নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হয়েছেন খালেদা জিয়া। তার হাত ধরে হারানো দুর্গ পুনরুদ্ধার করতে চায় বিএনপি। ইতিমধ্যে আসনটিতে গোলাম রব্বানীকে প্রার্থী করেছে জামায়াতে ইসলামী। বিএনপি চেয়ারপারসনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তিনি। আসনটিতে জেতার আশা করছেন জামায়াতের এই প্রার্থী।
দুই দলের নেতাকর্মী ও স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার প্রচুর মামলা মাথায় নিয়ে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির অনেক নেতা আত্মগোপনে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের মহাজোটের অন্য শরিক দলগুলোর প্রার্থীরাও মাঠে নেই। বর্তমানে মাঠে আছেন জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাসদ ও গণতন্ত্র মঞ্চের একক প্রার্থী। সবশেষ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্রার্থী করা হয়।
বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছেন, খালেদা জিয়া প্রার্থী হওয়ায় এখানে দলের কোনও নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন না। তবে কোনও কারণে তিনি ভোট থেকে সরে গেলে দুজন দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন। এ ছাড়া ভোটের পর আসনটি ছেড়ে দিলে উপনির্বাচনে ওই দুজন নির্বাচন করবেন বলে জানিয়েছেন।
নির্বাচন অফিস ও দলীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে বগুড়া-৭ আসনে উপনির্বাচনের কারণে ১৫ বার ভোট হয়েছে। এতে খালেদা জিয়াসহ বিএনপি প্রার্থীরা ১০ বার নির্বাচিত হন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ দুবার, জাতীয় পার্টি দুবার এবং একবার স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আমানউল্লাহ খান ও ১৯৭৯ সালে বিএনপির হাবিবুর রহমান এমপি নির্বাচিত হন। সীমানা পরিবর্তনের পর ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির আমিনুল ইসলাম এমপি নির্বাচিত হন। এরপর থেকে আসনটি বিএনপির হাতে চলে যায়।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বাড়ি গাবতলী উপজেলায় হওয়ায় আসনটিতে বরাবর প্রার্থী হয়ে আসছেন খালেদা জিয়া। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনে জেতেন তিনি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়া নির্বাচিত হন। তিনি আসনটি ছেড়ে দিলে ওই বছরের সেপ্টেম্বরের উপনির্বাচনে তার
উপদেষ্টা হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু এমপি হন। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি ও ১৯৯৬ সালের জুনের দুটি নির্বাচনে খালেদা জিয়া নির্বাচিত হন। তিনি ছেড়ে দিলে ১৯৯৬ সালের উপনির্বাচনে আবারও হেলালুজ্জামান তালুকদার নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে খালেদা জিয়া নির্বাচিত হন। তিনি আসনটি ছেড়ে দিলে নভেম্বরে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে হেলালুজ্জামান তালুকদার নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়া আবার এমপি নির্বাচিত হন। তিনি আবার আসনটি ছেড়ে দিলে ২০০৯ সালের উপনির্বাচনে কেন্দ্রীয় নেতা মওদুদ আহমদ নির্বাচিত হন। এরপর বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে আসনটি হাতছাড়া হয়ে যায়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের শরিক জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিলে মুহম্মাদ আলতাফ আলী এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় ভোটের একদিন আগে স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিম বাবলু বিএনপির সমর্থন পেয়ে এমপি হন। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তফা আলম নান্নু এমপি নির্বাচিত হন।
বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, ইতিমধ্যে আসনটিতে খালেদা জিয়াকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে দল। পরে যদি তিনি ছেড়ে দেন উপনির্বাচনে প্রার্থী হবেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক এমপি হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু এবং গাবতলী উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোরশেদ মিল্টন। এরই মধ্যে দুই প্রার্থী দলীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি নির্বাচনি এলাকায় নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। সভা-সমাবেশ, মোটরসাইকেল শোডাউন, গণসংযোগ, উঠান বৈঠক, কুশল বিনিময়সহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন। এসব কর্মসূচিতে কখনও প্রকাশ্যে কখনও আকার-ইঙ্গিতে দলীয় প্রার্থী হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভোট চাইছেন তারা। তবে এবার এই আসনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে, সেটিও হিসেব করছেন বিএনপির নেতারা।
এদিকে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর হত্যা ও নাশকতার অসংখ্য মামলায় আওয়ামী লীগ এবং তাদের শরিক দলের প্রার্থীরা এলাকা ছাড়া। এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা আলম নান্নু এবং দলের অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হত্যা ও নাশকতার মামলা হয়েছে। অনেকের বাড়িঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র অবস্থান করছেন তারা। এ অবস্থায় শেষ পর্যন্ত তাদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ কম। স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া নিয়েও শঙ্কা আছে। ফলে এককভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে বিএনপি ও জামায়াত।
বগুড়া-৭ আসনে উপনির্বাচনে প্রার্থী হতে চান হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু ও মোরশেদ মিল্টন
ভোটাররা বলছেন, আসনটিতে আওয়ামী লীগ কিংবা তার শরিক দলগুলোর তেমন ভোট নেই। তবে এটি বিএনপির দুর্গ হলেও জামায়াতের ভোট আছে। দুই দলের প্রার্থীর মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। তবে খালেদা জিয়া প্রার্থী হওয়ায় অন্য যেকোনো দল কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে আসনটিতে প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন- বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য গোলাম রব্বানী, ইসলামী আন্দোলনের অধ্যাপক সবুজ ইসলাম সফিক, বাসদের শহীদুল ইসলাম ও গণতন্ত্র মঞ্চের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা মনিরুজ্জামান বাচ্চু।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আসনটিতে বরাবর প্রার্থী হয়ে জিতে আসছেন খালেদা জিয়া। এটি বিএনপির দুর্গ। এবারও বেগম জিয়া প্রার্থী হয়েছেন এবং জিতবেন বলে আশা করছি। পরে তিনি ছেড়ে দিলে উপনির্বাচনে আমি প্রার্থী হতে চাই।’
গাবতলী উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোরশেদ মিল্টন বলেন, ‘মূলত আসনটি জিয়া পরিবারের। ইতিমধ্যে এখানে চেয়ারপারসনকে প্রার্থী ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কোনও কারণে তিনি ছেড়ে দিলে প্রার্থী হতে চাই আমি।’
বগুড়া শহর জামায়াতের সেক্রেটারি অধ্যাপক আ স ম আবদুল মালেক বলেন, ‘বগুড়া-৭ আসনে আগামী নির্বাচনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা গোলাম রব্বানী আমাদের দলের একক প্রার্থী। বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিয়ে আশা করছি, আমাদের প্রার্থী এবার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন। সেভাবেই কাজ করছি আমরা।’
জামায়াতের প্রার্থী গোলাম রব্বানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকার মানুষের সঙ্গে আছি। সুখে-দুঃখে তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি। দুটি উপজেলার ভোটারদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। যেভাবে ভোটারদের সাড়া পাচ্ছি, আশা করছি বিপুল ভোটে আমি জয়ী হবো।’
প্রসঙ্গত, সোমবার বগুড়ার সাতটি সংসদীয় আসনের মধ্যে ছয়টিতে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। এর মধ্যে বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনে কাজী রফিকুল ইসলাম, বগুড়া-৩ (আদমদিঘী-দুপচাঁচিয়া) আসনে আব্দুল মুহিত তালুকদার, বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে মোশারফ হোসেন, বগুড়া-৫ (শেরপুর-ধুনট) আসনে গোলাম মোহাম্মাদ সিরাজ, বগুড়া-৬ (সদর) আসনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনে খালেদা জিয়া। তবে বগুড়া-২ আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে।
এর আগে চলতি বছরের ৫ এপ্রিল বগুড়ার সাতটি সংসদীয় আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছিল জামায়াতে ইসলামী। এর মধ্যে বগুড়া-১ অধ্যক্ষ শাহাবুদ্দিনকে, বগুড়া-২ আসনে অধ্যক্ষ শাহাদাতুজ্জামান, বগুড়া-৩ আসনে নূর মোহাম্মদ আবু তাহের, বগুড়া-৪ আসনে অধ্যক্ষ মাওলানা তায়েব আলী, বগুড়া-৫ আসনে দবিবুর রহমান, বগুড়া-৬ আসনে আবিদুর রহমান সোহেল এবং বগুড়া-৭ আসনে গোলাম রব্বানী।