সংস্কার বাস্তবায়ন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের প্রতিক্রিয়া জানানো নিয়ে উভয়সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
দলীয় নেতারা বলেছেন, নির্বাচনী প্রস্তুতিতে মনোযোগ দেওয়া বিএনপি ভাবতেও পারেনি যে এমন একটি পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে। ফলে দলটি এখন বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে।
বিএনপি সরকারের কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তারা আবারও স্পষ্ট করেছে যে, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে তারা কোনো আপস করবে না। বরং আগামী দিনগুলোতে আরও সতর্কভাবে এগোবে দলটি।
জ্যেষ্ঠ বিএনপি নেতারা বলছেন, নিজেদের প্রতিশ্রুতি রাখতে না পেরে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা হারানোর পর জুলাই সনদ ইস্যুতে বিএনপির চেয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার ও ঐকমত্য কমিশন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির জন্য সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পথ হলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজা। এতে কৌশলগতভাবে সরকারকে চাপের মুখে ফেলা সম্ভব হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, 'বিএনপি এখন দোটানায় পড়েছে। তারা যদি জুলাই সনদ প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে ধরে নেওয়া হবে যে তারা সংস্কারের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। এতে তারা বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে। আবার যদি সবকিছু মেনে নেয়, তাহলে হয়ে যাবে পরাজিত পক্ষ।'
মঙ্গলবার ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদের সাংবিধানিক সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশ সরকারে জমা দিয়েছে।
এর বিরোধিতা করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে অভিযোগ করেন, কমিশনের সদস্যরা বিএনপির দেওয়া নোট অব ডিসেন্ট অন্তর্ভুক্ত না করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে 'বিশ্বাস ভঙ্গ' করেছেন।
গত বুধবার রাতে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিএনপি নেতারা ব্যাপক আলোচনার পর সরাসরি প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের উদ্বেগ তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেন।
যোগাযোগ করা হলে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'দলের পক্ষ থেকে আমরা আমাদের মতামত দিয়েছি। সুতরাং কয়েকটি দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা বা প্রস্তাব পুরো জাতির ওপর একতরফাভাবে চাপিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।'
তিনি বলেন, 'কোনো প্রস্তাব জোর করে চাপিয়ে দিলে তা রাষ্ট্রের কোনো উপকারে আসবে না। কারও ব্যক্তিগত এজেন্ডাও বাস্তবায়িত হওয়া উচিত না। আমরা আশা করি, সরকার ও ঐকমত্য কমিশন এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, বিএনপির এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, 'বিএনপি যে সমস্যায় পড়েছে, সেটা দলের জন্য ক্ষতিকর হবে। দেখা যাচ্ছে, নানা পরিস্থিতিতে দলটি ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। এখন যদি তারা যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়, তাহলে নিজেদের আরও ক্ষতি করবে।'
অধ্যাপক আল মাসুদ পরামর্শ দেন, বিএনপির উচিত এমন একটি কৌশল তৈরি করা, যাতে সরকার চাপের মুখে থাকে, আবার নির্বাচনে দেরি হওয়ার মতো ঘটনাও না ঘটে।
তিনি বলেন, 'বিএনপি যদি আন্দোলনে যায়, তাহলে নির্বাচনের সময়সূচি কীভাবে ঠিক থাকবে? যেকোনো ধরনের অস্থিরতায় তাদের দাবি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।'
জ্যেষ্ঠ বিএনপি নেতারা বলেছেন, এ বিষয়ে এমন কোনো পরিস্থিতি তারা সৃষ্টি করবেন না, যার মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো সুবিধা পাবে বা আসন্ন নির্বাচনে বিঘ্ন ঘটবে।
দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপির চারজন স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগ স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বিএনপির জন্য আগামীদিনগুলো খুব একটা 'সহজ' হবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, 'এখন আমাদের আরও সতর্ক হয়ে ভাবতে হবে এবং সতর্ক থাকতে হবে এটা দেখার জন্য যে, দলের সামনে আরও বড় কোনো চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে কি না। আমরা এই নতুন ইস্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এই পরিস্থিতিতে জনগণ বুঝতে পারছে, বিএনপি নয় বরং সরকারই আস্থা ভঙ্গ করে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।'
নেতারা বলেন, যদি সরকার সনদ নিয়ে বিএনপির উদ্বেগ উপেক্ষা করতে থাকে, তাহলে তারা কৌশলগত সতর্কবার্তা দেবে এবং সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জ্যেষ্ঠ বিএনপি নেতা বলেন, 'বিএনপি কোনো বিশৃঙ্খলা চায় না। আমরা সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা করছি। বিএনপি প্রধান উপদেষ্টার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখে। কিন্তু বিএনপির আস্থাকে সরকার দুর্বলতার প্রকাশ হিসেবে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করছে। যদি তারা এর সুযোগ নিতে চায় এবং বিএনপিকে চাপে রাখে, তাহলে সেটা হবে গুরুতর ভুল।'