Image description

দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা যদি সাক্ষাৎকার দিতে চান, সেক্ষেত্রে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটলেও তা নেবেন বলে সম্প্রতি জানিয়েছিলেন সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন। এ মন্তব্য করে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেন দর্শকপ্রিয় এই উপস্থাপক। তার বক্তব্যের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে অনলাইন দুনিয়ায়।

ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ওই মন্তব্য নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা এখনো চলছে। এমনকী তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণও করছেন নেটিজেনেরা। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, সাক্ষাৎকার নেওয়ার এই ইচ্ছা শেখ হাসিনাকে রাজনীতিতে নরমালাইজ করার চেষ্টা কি-না? মঙ্গলবার (২৮শে অক্টোবর) আত্মপক্ষ সমর্থন করে খালেদ মুহিউদ্দীন জবাবও দিয়েছেন তার বিরুদ্ধে সমালোচনার। তিনি নিজেই প্রশ্ন করেন, শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নেওয়া মানে কী তাকে নরমালাইজ করা?

নিউইয়র্ক-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘ঠিকানা’র সাংবাদিক খালেদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা ভিশনের সাংবাদিক ও উপস্থাপক কাজী জেসিন বুধবার (২৯শে অক্টোবর) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া এক পোস্টে দাবি করেন, কয়েক কোটি টাকা দিলেও শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার তিনি নেবেন না। এর সপক্ষে তিনটি কারণ তিনি উল্লেখ করেন। ধারণা করা হচ্ছে, খালেদ মুহিউদ্দীনের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কাজী জেসিন ওই পোস্ট দিয়েছেন।

পোস্টকে ঘিরে জেসিনও সামাজিক মাধ্যমে আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। তিনি কোথায় সাংবাদিকতা করেছেন, কাকে খুশি করতে এমন বক্তব্য দিলেন, শেখ হাসিনা তাকে আদৌ সাক্ষাৎকার দেবেন কী না, এমন প্রশ্ন সামনে আনছেন অনেক নেটিজেন। তিনি আমার দেশে সাংবাদিকতা করেছেন। জেসিনের নেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের এক সাক্ষাৎকার এক এগারোর জরুরি অবস্থার সরকারের আমলে বাংলা ভিশনে প্রচারিত হলে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়।

জেসিনের সঞ্চালনায় বাংলা ভিশন চ্যানেলের একটি টকশো অনুষ্ঠান গত আওয়ামী লীগের সরকারের রোষানলে পড়ে গোয়েন্দা চাপে বন্ধ হয়ে যায় বলে অভিযোগ ওঠে। এদিকে, দুই সাংবাদিকের বক্তব্য নিয়ে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে নানা শ্রেণি-পেশার নেটিজেন থেকে শুরু করে সাংবাদিক সমাজ যখন বুধবার তর্ক-বিতর্ক করছিল, যুক্তি-পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করছিল, সেদিনই তাদের আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে বিশ্বের প্রভাবশালী তিনটি গণমাধ্যম শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে।

একযোগে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারগুলো প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স, এএফপি এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্ট। সাক্ষাৎকারগুলো নেওয়া হয়েছে ই–মেইলে। সাক্ষাৎকারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা হত্যায় তার দায় আছে কী না, আসন্ন সংসদ নির্বাচন, দেশে ফেরা, ট্রাইব্যুনালে তার বিচার এবং রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে লিখিত প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। এগুলোই ভারতের জীবনে তার দেওয়া প্রথম সাক্ষাৎকার।

একই দিনে আন্তর্জাতিক তিন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার প্রকাশের ভেতর রাজনৈতিক কোনো বার্তা আছে কী না, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন, সরকারের প্রতিক্রিয়া কী, বিএনপিসহ নির্বাচনমুখী দলগুলো কীভাবে দেখছে বিষয়টিকে, এমন নানা প্রশ্ন ও আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। নেটিজেনদের প্রশ্ন, বিদেশি গণমাধ্যমগুলোর কী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে? কেন বাড়ছে?

গত বৃহস্পতিবার (২৩শে অক্টোবর) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। এর এক সপ্তাহের মধ্যে শেখ হাসিনার তিনটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলো। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার আগে দেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগকে ঘিরে বিদেশি সংবাদমাধ্যমের আগ্রহ বাড়বার কারণ ও উদ্দেশ্য কী?

বিশিষ্ট সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মনে করেন, 'ক্ষমতাচ্যুতির ১৪ মাস পরে বিশ্বের প্রথম সারির একাধিক সংবাদ সংস্থা ও সংবাদপত্র শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশ করার অর্থ হলো বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে তাদের গুরুত্ব রয়েছে। গুরুত্ব কমছে না। বাড়ছে।'

সরকারের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারে দেওয়া শেখ হাসিনার বক্তব্যের বিষয়ে এখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। ড. ইউনূসের মুখপাত্ররা শেখ হাসিনার মন্তব্যের বিষয়ে বিবিসি বাংলার প্রতিক্রিয়ার অনুরোধে তাৎক্ষণিক সাড়া দেননি। তবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বুধবার ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার দেওয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কথা বলবেন। আমরা এ বিষয়ে আগে তার ইন্টারভিউটা পড়ি, তারপর মন্তব্য করতে পারব।'

তিনটি সাক্ষাৎকারেই শেখ হাসিনা একই ভাষায় কথা বলেছেন। ছাত্র-জনতার হত্যার জন্য মাঠপর্যায়ে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দায়ী করেছেন। এমনকি তার ভাষায়, সহিংস বিদ্রোহ দমনকে সাংবিধানিক অধিকার বলেও বর্ণনা করেছেন। তিনি অন্তর্ভুক্তিমূলক সংসদ নির্বাচন চেয়েছেন। বলেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দিলে দেশে বিভেদ বাড়বে।

সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা গত বছরের বিক্ষোভ দমনের সময়কার কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেন। তবে তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তিগত দায় স্বীকার করেন না, আর ওই আন্দোলন ছিল একটি সহিংস বিদ্রোহ।

শেখ হাসিনার দাবি, বেশিসংখ্যক প্রাণহানির জন্য দায়ী ছিল ‘মাঠপর্যায়ে থাকা নিরাপত্তা বাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়া।’ তিনি আরও বলেন, ‘একজন নেতা হিসেবে আমি অবশ্যই সামগ্রিক দায় স্বীকার করি, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে—যে আমি নিজে নিরাপত্তা বাহিনীকে জনতার ওপর গুলি চালাতে বলেছিলাম, এটা ঠিক নয়।’

এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি ব্যক্তিগতভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছি, এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।’ তিনি স্বীকার করেন, ‘চেইন অব কমান্ডের মধ্যে কিছু ভুল অবশ্যই হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে, সরকারি কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত ছিল পরিমিত, সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, এবং যতটা সম্ভব প্রাণহানি কমানোর লক্ষ্যে।’

রয়টার্সের জন্য ভারতের নয়াদিল্লি থেকে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারটি ই-মেইলের মাধ্যমে নেন সাংবাদিক কৃষ্ণা এন দাস, সরিতা চাগান্তি সিংহ ও ঢাকার রুমা পাল। এএফপির পক্ষ থেকে নয়াদিল্লি থেকে লিখিত সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তবে প্রতিবেদনে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর কোনো নাম উল্লেখ করা হয়নি। দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে সংবাদমাধ্যমটির এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মারুশা মুজাফফরের নামে খবরটি প্রকাশিত হয়।