বরাবরই বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত খুলনা বিভাগ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এ বিভাগে দলটি ঐতিহাসিকভাবে সাংগঠনিক শক্তি, জনসম্পৃক্ততা ও আন্দোলন-সংগ্রামে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেই প্রেক্ষিতেই গত কয়েকটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ রাতের ভোট ও প্রশাসনিক প্রভাবের মাধ্যমে এ বিভাগের আসনগুলো দখলে রাখলেও মাঠের বাস্তবতায় এখন আবার পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে খুলনা বিভাগের রাজনৈতিক তাপমাত্রা দ্রুতই বেড়েছে। মানুষ নতুন করে ভোটে অংশগ্রহণের স্বপ্ন দেখছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেন্দ্র দখল, রাতে ভোট দিয়েও খুলনা বিভাগে সাতটি আসন হাতছাড়া হয় আওয়ামী লীগের। এবার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে হারানো জনসমর্থন ফিরে পেতে মরিয়া বিএনপি। আর পাশে থেকে সীমিতভাবে জমি তৈরি করছে জামায়াত।
সম্প্রতি দুর্গাপূজার সময় জামায়াত নেতাদের মন্দিরে গিয়ে ভোট প্রার্থনার বিষয়টি খুলনা বিভাগের রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, এটি একদিকে ভোটের কৌশল হলেও অন্যদিকে জামায়াতের সমর্থক ঘরে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। ফলে যে প্রবাহে জামায়াত এগিয়ে যাচ্ছিল, সেখানে এখন কিছুটা ভাটা পড়েছে।
’২৪ গণঅভ্যুত্থানের পর বিএনপি পুনর্গঠনের পথে থাকলেও খুলনা বিভাগের একাধিক জেলায় চাঁদাবাজি, দলীয় কোন্দল ও একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশীর বিরোধে মাঠ কিছুটা বিভক্ত। বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রভাবশালী বলয় তৈরির প্রতিযোগিতা বিএনপির তৃণমূলকে দুর্বল করছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা বলছেন, এই সংকট দ্রুত কাটিয়ে উঠতে না পারলে জামায়াত কয়েকটি আসনে চমক দেখাতে পারে।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপি ছাড়া প্রায় সব দলই একক প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। অথচ বিএনপি এখনও অধিকাংশ আসনে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী নিয়ে দ্বিধায় আছে। স্থানীয় রাজনৈতিক মহল বলছে, দ্রুততার সঙ্গে প্রার্থী নির্ধারণ ও অভ্যন্তরীণ ঐক্য ফিরিয়ে আনতে পারলে খুলনা বিভাগে বিএনপির সম্ভাবনা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে উজ্জ্বল হতে পারে।
মেহেরপুর (২টি আসন) : মেহেরপুর জেলা ঐতিহ্যগতভাবেই বিএনপির ঘাঁটি। স্থানীয়রা বলছেন, দুটি আসনেই বিএনপি প্রার্থীদের জয়ের সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত।
কুষ্টিয়া (৪টি আসন) : কুষ্টিয়া-১, ৩ এবং ৪ আসনে বিএনপির অবস্থান শক্ত। তবে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও প্রার্থী মনোনয়নে যোগ্য ও জনপ্রিয় নেতাকে উপেক্ষা করলে এবং দল এই বিভক্তি নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিলে কুষ্টিয়া-২ আসনটি জামায়াতের কব্জায় যেতে পারে।
চুয়াডাঙ্গা (২টি আসন) : চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী এগিয়ে থাকলেও চুয়াডাঙ্গা-২ আসনে জামায়াতের সঙ্গে হবে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
ঝিনাইদহ (৪টি আসন) : ঝিনাইদহ-১, ২ ও ৪ নম্বর আসনে বিএনপি থাকতে পারে এগিয়ে। তবে ঝিনাইদহ-৩ এ জামায়াতের জনপ্রিয় প্রার্থী বিএনপিকে কঠিন চ্যালেঞ্জে ফেলতে পারে।
যশোর (৬টি আসন) : যশোর-১, ৩, ৪, ৫ ও ৬ এ বিএনপির জয়ের সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু যশোর-২ আসনে জামায়াতের শক্তিশালী প্রার্থীর উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
মাগুরা (২টি আসন) : উভয় আসনেই বিএনপি এগিয়ে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাও তুলনামূলক কম হতে পারে।
নড়াইল (২টি আসন) : নড়াইল-১ এ বিএনপি প্রার্থী এগিয়ে, কিন্তু নড়াইল-২ এ জামায়াতের জয়ের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
বাগেরহাট (৩টি আসন) : এ জেলায় চারটি আসন ছিল। সেখান থেকে এখন আসন করা হয়েছে তিনটি। বাগেরহাট-১ ও ২ আসনে বিএনপি শক্ত অবস্থানে। তবে বাগেরহাট-৩ এ জামায়াতের প্রবীণ নেতা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে আছেন।
খুলনা জেলা (৬টি আসন) : খুলনা শহর ও আশপাশের এলাকাগুলোতে বিএনপির জনপ্রিয়তা স্পষ্ট। খুলনা-১ থেকে ৪ আসনে বিএনপির জয় প্রায় নিশ্চিত বলছেন স্থানীয় ভোটাররা। তবে খুলনা-৫ এ জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেলের প্রভাব প্রবল। আর খুলনা-৬ এ বিএনপির অভ্যন্তরীণ ভুলে জামায়াত সুযোগ পেতে পারে।
সাতক্ষীরা (৪টি আসন) : সাতক্ষীরায় জামায়াতের আধিপত্য ঐতিহ্যগত। ১, ২ ও ৪ নং আসনে জামায়াত এগিয়ে থাকলেও ৩ নং আসনে তাদের অবস্থান কিছুটা দুর্বল বলে মনে করা হচ্ছে।
খুলনা বিভাগের রাজনীতি এখন এক সঙ্কট ও সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে। একদিকে ঐতিহ্যবাহী বিএনপির পুনরুত্থান, অন্যদিকে জামায়াতের সীমিত কিন্তু স্থায়ী উপস্থিতি। এ দুই মেরুর টানাপোড়েনই নির্ধারণ করবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নির্বাচনী ফলাফল।