Image description

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির সাথে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট। পৃথকভাবে আন্দোলনে মাঠে থাকলেও ইস্যু ছিল একই। আওয়ামী লীগের পতন হলে এসব জোট ও দলকে বিএনপি যথাযথ মূল্যায়নের অঙ্গীকার করেছিলেন বলে জানিয়েছেন জোটের নেতারা। 

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে। দেশ এখন নির্বাচনমুখী। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ্বে অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রাজনৈতিক দলগুলোও শুরু করেছে নির্বাচনী প্রচারণা। জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যে ৩০০ আসনে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। চলতি মাসের শেষে কিংবা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করতে যাচ্ছে বিএনপি। তবে এই নির্বাচনে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেয়া শরিক বা সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে কতগুলো আসন ছেড়ে দেবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তাদেরকে যে ক’টি আসনই দেয়া হোক সেগুলোতে বিজয়ী হওয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় বিএনপি।

বিশেষ করে, জোটের অংশ হিসেবে এক দলের প্রার্থীরা আরেক দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবেন না বলে নির্বাচন কমিশন ও উপদেষ্টা পরিষদের যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করা হয়েছে সেটির ফলে সন্দেহ-সংশয় দানা বেধেছে তাদের মনে। বিএনপির একাধিক নেতা জানান, শরিক দলগুলোর নেতাদের ফেসভ্যালু ভালো হলেও ভোটের মাঠে তাদের অবস্থান অনেক দুর্বল। অন্যদিকে প্রতিটি আসনেই বিএনপির একাধিক শক্ত প্রার্থী রয়েছে। এমন অবস্থায় কাদেরকে বিজয়ী করা সম্ভব হচ্ছে তা নিয়েও ভাবছে দলটি। স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ সভায় এ বিষয়ে আলোচনার পর যোগ্য প্রার্থী খুঁজে বের করে তাদেরকেই আসন ছেড়ে দেয়ার বিষয়েই নীতিগতভাবে একমত হয়েছেন শীর্ষ নেতারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, যারা বিগত দিনে আমাদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে তাদের অবদান আমরা কোনোভাবেই ছোট করে দেখি না। কিন্তু যারা নির্বাচনে আসন চাচ্ছেন এবং আমরা যাদেরকে আসন যখন ছাড়বো তখন বিবেচনা করতে হবে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আসন ছেড়ে দিলাম কিন্তু যাকে ছাড়লাম তিনি বিজয়ী হতে পারলেন না, তিনি হারলে আমাদের শত্রুপক্ষ বিজয়ী হবে। এটি সবার জন্যই খারাপ হবে।

তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণের ভোটে কে জিতল সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যারা আসন চাচ্ছেন তাদের বুঝতে হবে, যিনি যে আসন চাচ্ছেন সেখানে তার অবস্থান এবং বিএনপির যিনি প্রার্থী আছেন তার অবস্থান কেমন? কার বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি আছে? যিনি মনোনয়ন চান তার স্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থ বেশি বিবেচনায় নিতে হবে। তাহলে সকলেই উপকৃত হবো।

বিএনপি এবং তার সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা একাধিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপির সঙ্গে বিভিন্ন জোট ও দলের আলাপ-আলোচনা চলছে। তারা পৃথকভাবে তাদের জন্য আসন চেয়ে বিএনপির কাছে তালিকা দিয়েছে। বিএনপি সেই তালিকা পর্যালোচনা করেছে। এসব দলের তালিকায় সর্বমোট ২৪৪টি আসনের কথা বিএনপিকে জানানো হয়েছে।

বিএনপি সূত্রে জানা যায়, নিজেদের দলের প্রার্থীদের চেয়ে শরিকদের আসন নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন বিএনপি। শরিকদের জন্য যেসব আসন ছেড়ে দেয়া হবে সেসব আসনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু আছে কিংবা কতগুলোতে তারা বিজয়ী হতে পারবেন সেটি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন নীতিনির্ধারণী নেতারা।

বিশেষ করে, নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের মাধ্যমে জোটের অংশ হিসেবে এক দলের প্রার্থীরা আরেক দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবেন না বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। গত ১১ আগস্ট নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে নবম কমিশন সভার মুলতবি বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ইসির এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিলেও এখন থেকে নিজ নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। জোটের প্রতীকে ভোট করতে পারবে না ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো।

এরই প্রেক্ষিতে গতকাল অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে নির্বাচনী জোট হলেও প্রার্থীদের নিজ দলের প্রতীকে জাতীয় নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করতে হবে এমন বিধান যুক্ত করে নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের খসড়া অনুমোদন করেছে। সংশোধিত আরপিও’র বিষয়ে আইন উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল বলেন, যদি নির্বাচনী জোট হয়, তাহলে জোটের অংশ হলেও দলের যে প্রতীক তা দিয়ে নির্বাচন করতে হবে। ফলে শরিক দলগুলো নিজ নিজ প্রতীকে কতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিএনপি নেতাদের মনে।

বিএনপির একাধিক নেতা জানান, শরিকদের ৪০টির মতো আসন ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে আপাতত নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে দলটির। তবে শরিক দলগুলোর নেতাদের মিডিয়া ফেস ভালো হলেও নিজ নিজ এলাকায় ব্যক্তি বা নিজ দলীয় শক্তিতে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম দেখছেন তারা। এছাড়া প্রতিটি এলাকাতেই দীর্ঘ দেড় দশক ধরে বিএনপির একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী জেল-জুলুম, হামলা-মামলা, নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, নেতাকর্মীদের নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, তাদের পাশে থেকেছেন। অনেকে নিজ নিজ এলাকার মানুষের কাছে জনপ্রিয়। তারা অনেকেই বিএনপির প্রার্থী হতে চান। যারা নির্বাচনে জিততে সক্ষম। এসব আসন শরিকদের ছেড়ে দিলে দলের তৃণমূলে হতাশা সৃষ্টি হতে পারে। কোনো কোনো এলাকায় মনোনয়ন না পেলে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। বিএনপি বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিলেও জয়ের সম্ভাবনা থাকায় তারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে অনেকটা অনড় মনোভাবই পোষণ করছেন।
১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, আমরা যখন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি তখন দেখা হয়নি কে ছোট, কে বড় দল। কার জনপ্রিয়তা বেশি কার কম। বড় দল হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই বিএনপির জনপ্রিয়তা বেশি থাকবে। তবে আমাদেরও অনেক প্রার্থী আছেন যাদের নিজ নিজ এলাকায় জনপ্রিয়তা আছে। এর সঙ্গে বিএনপি যদি এসব প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করে তাহলে জোটের প্রতিটি প্রার্থীই নির্বাচিত হবে।

জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান এড. ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ জানান, তার জোটের পক্ষ থেকে ৯টি আসন চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপির সঙ্গে আমরা বিগত দিনে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। তারা কথা দিয়েছেন যারা বিগত দিনে সাথে ছিল তাদের মূল্যায়ন করা হবে।

ফরহাদ বলেন, জোটের পক্ষ থেকে যাদের প্রার্থী করা হবে তাদের সঙ্গে যদি স্থানীয় বিএনপি ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে তাহলে প্রার্থীরা বিজয়ী হবেন। আর ভিন্ন হলে সমস্যা সৃষ্টি হবে। তিনি জোটের আসনগুলোতে দ্রুত মনোনয়ন চূড়ান্ত করার জন্য বিএনপির প্রতি অনুরোধ জানান।

বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বলেন, আমরা চাইছি ঐক্য ধরে রাখতে। তবে, আসন ছাড়ার ক্ষেত্রে প্রার্থীর জনসমর্থন ও বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আমরা এমন কোনো ছাড় দিতে চাই না, যা কেবল আসনপূরণ করবে, কিন্তু জয়ের নিশ্চয়তা দেবে না।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এড. সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, শরিকদের সাথে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, তাদের কাছে তালিকা চাওয়া হয়েছিল, নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে দলগুলো তালিকা দিয়েছে। পরবর্তীতে তাদের সঙ্গে বসে ঠিক করা হবে।