Image description

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক পদে বসার দৌড়ে এখন একরকম হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। শিক্ষাক্ষেত্রের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ এই পদে নিয়োগ পেতে আবেদন করেছেন ৬৩ জন কর্মকর্তা। এদের মধ্যে সংস্থাটির প্রভাবশালী কয়েকজনসহ রয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, কলেজের অধ্যক্ষও। 

মাউশির ডিজি পদটি শুধু প্রশাসনিক নয়, শিক্ষানীতির বাস্তবায়নে এটি একটি নীতিনির্ধারক অবস্থান। সারা দেশের মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষক নিয়োগ, এমপিও, প্রতিষ্ঠান অনুমোদন, এমনকি পরীক্ষার ব্যবস্থাপনাতেও এই পদধারীর প্রভাব ব্যাপক রয়েছে। নীতিনির্ধারণী পদ হওয়ায় এ পদে আসীন হতে জোর তদবির চালাচ্ছেন অনেকে। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপিপন্থিদের পাশাপাশি তদবির চালাচ্ছেন আওয়ামীপন্থি শিক্ষা ক্যাডার হিসেবে পরিচিতরাও। যদিও শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দলীয় পদ নয়, যোগ্যতাই এই পদটিতে প্রাধান্য পাবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নতুন ডিজি নিয়োগের ফাইল প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে পাঠানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর আগে ডিজি নিয়োগে গঠিত সার্চ কমিটি প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত বাছাই করবেন। এক্ষেত্রে প্রার্থীদের রাজনৈতিক পরিচয়ের পাশাপাশি একাডেমিক এবং প্রশাসনিক দক্ষতাও বিবেচনা করা হবে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সার্চ কমিটির সদস্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন)  মো. মজিবর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, মাউশি ডিজির পদটি গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা উপদেষ্টার নেতৃত্বে সার্চ কমিটি কাজ করছে। জীবনবৃত্তান্ত যাচাই প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনেক কিছু বিবেচনায় নেওয়া হবে। আমরা যোগ্য ব্যক্তিকেই নিয়োগের সুপারিশ করতে চাই।

গত ৭ অক্টোবর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দেয় সরকার। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সাতদিন পর ১৪ অক্টোবর ডিজির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ খানকে। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পালাবদলের পর তিনি তৃতীয় ডিজি, যিনি দায়িত্ব হারালেন। শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মতে, এত অল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষা প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে তিনজন কর্মকর্তার পরিবর্তনের ঘটনা নজিরবিহীন।

মাউশি ডিজির পদটি গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা উপদেষ্টার নেতৃত্বে সার্চ কমিটি কাজ করছে। জীবনবৃত্তান্ত যাচাই প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনেক কিছু বিবেচনায় নেওয়া হবে। আমরা যোগ্য ব্যক্তিকেই নিয়োগের সুপারিশ করতে চাই।— মো. মজিবর রহমান, অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) , মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ

 

এই ধারাবাহিক অস্থিরতার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবার পদটি রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখতে নতুন প্রক্রিয়ায় নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ধাঁচে উন্মুক্তভাবে আবেদন আহ্বান করে মাউশির নতুন ডিজি বেছে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে মাউশি ডিজি নিয়োগের আবেদনগ্রহণ শেষ হয়েছে। আবেদন করেছেন শিক্ষা ক্যাডারের ৬৩ কর্মকর্তা।

বিতর্কিতদের দৌড়ঝাঁপ
মাউশি ডিজি পদে নিয়োগ সামনে রেখে চলছে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের তদবির ও দৌড়ঝাঁপ। এ পদে নিয়োগ পেতে তদবির করা একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ। শুধু তাই নয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিজেদের পছন্দের লোক বসাতেও জোর তদবির চালাচ্ছেন।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, মাউশি ডিজির চেয়ারে বসতে মাউশিসহ বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ, জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক নিয়মিত মন্ত্রণালয়ে আসছেন। তাদের মধ্যে বিগত আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধা কর্মকর্তারাও রয়েছেন। শিক্ষা প্রশাসনে স্বচ্ছতা ফেরাতে হলে তদবির করা ব্যক্তিদের বাইরে এ পদে নিয়োগ দিতে হবে। তাহলে মাউশির অভ্যন্তরে যে অনিয়ম রয়েছে, তা বন্ধ করা যাবে। উন্নয়ন হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের।

ওই কর্মকর্তা মনে করেন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে ডিজি পদ নিয়ে চলমান অনিয়ম, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ শুধু শিক্ষাব্যবস্থার শৃঙ্খলা নষ্ট করছে না, বরং শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ এবং প্রশাসনিক কাঠামোয় বিশৃঙ্খলার জন্ম দিচ্ছে। দেশের ভবিষ্যৎ গঠনের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচাতে হলে গুরুত্বপূর্ণ এ পদটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। 

ডিজি পদে নিয়োগে এগিয়ে যারা
মাউশির ডিজি পদে নিয়োগ পেতে জোর তদবির চালাচ্ছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. খন্দকার এহসানুল কবির। নিয়োগ সুপারিশ পেতে বিএনপির হাই কমান্ডের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছেন তিনি। বিএনপিপন্থী রাজনীতি করা এ অধ্যাপক বোর্ড চেয়ারম্যান হওয়ার আগে যশোরের সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। 

মাউশির মনিটরিং অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশন উইংয়ের পরিচালক কাজী মো. আবু কাইয়ুম শিশির ডিজির চেয়ার পেতে জোর তদবির চালাচ্ছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা এ অধ্যাপকও ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন তৎকালীন চার দলীয় জোট সরকারের একজন মন্ত্রীর প্রথমে এপিএস পরে পিএস হিসেবেও দায়িত্ব পালর করেন।

আলোচনায় রয়েছেন মাউশির কলেজ ও প্রশাসন শাখার পরিচালক অধ্যাপক বি এম আব্দুল হান্নান। বর্তমানে তিনি মাউশি মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। মাউশিতে পদায়নের পূর্বে ১৪তম বিসিএসের এ কর্মকর্তা গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।

মাউশির আরও দুই কর্মকর্তা ডিজির চেয়ার পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। তারা হলেন-পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের পরিচালক ড. এ কিউ এম শফিউল আজম এবং প্রশিক্ষণ শাখার পরিচালক মো. সাঈদুর রহমান। তবে তাদের দুইজনেরই চাকরির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ডিসেম্বর মাসে। এছাড়া এ দুই কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী বলে মাউশির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। বিগত সরকারের আমলে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন তারা।

ডিজি পদের এ দৌঁড়ে রয়েছেন রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষ ড. ছদরুদ্দীন আহমদ এবং সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কাকলী মুখোপাধ্যায়ও। ঢাকার বড় দুই কলেজের দুই অধ্যক্ষও চালাচ্ছেন তদবির।

ডিজি পদে আলোচনার তালিকায় রয়েছেন ১৬তম বিসিএসের কর্মকর্তা ও মাউশির মাধ্যমিক শাখার বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেলের নামও। তিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বহুল আলোচিত শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলনের এপিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।