Image description

নীলের দেশখ্যাত নীলফামারী দীর্ঘদিন শোষণ করেছিল ইংরেজরা। তাদের স্থানীয় নিপীড়ক নীলকরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন উত্তরের এই জেলার চাষিরা। ২০০ বছর পর সেই নিষ্ঠুর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করেন আওয়ামী ‘কসাই’খ্যাত আসাদুজ্জামান নূর। তিনি ফ্যাসিবাদী দলটির জেলা কমিটির সদস্য হলেও এই জনপদে খুনখারাবির শিরোমণি ছিলেন। সাবেক এই সংস্কৃতি বিষয়কমন্ত্রীর জুলুমের রাজ্যে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থি মানুষ শত শত রাত নিজ বাড়িতে ঘুমাতে পারেননি। বেশ কয়েকটি মসজিদে হয়নি আজান-নামাজ। তবে এই কুৎসিত চেহারা তিনি ঢেকে রাখেন অভিনয় জগতে সাদা মনের মানুষের চরিত্রের চাদরে।

নীলসাগর ও বিস্তীর্ণ সবুজ ফসলের মাঠের মতো এই জেলার অধিকাংশ মানুষ শান্তিপূর্ণ ও ইসলামপন্থি। রাজনীতি ছিল খুবই সহিষ্ণু ও উদার। সুশৃঙ্খল এই জনপদকে অস্থির করে তোলেন নূর। ১৯৯৬ সালের দিকে জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আগমনের পর ক্রমাগত অসহিষ্ণু, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও দানবীয় রূপ ধারণ করেন। ২০০১-২৪ সাল পর্যন্ত টানা এমপি ছিলেন নীলফামারী-২ (সদর) আসনে। দীর্ঘ জুলুমের রাজত্বে জনগণ তার ওপর এতটাই ক্ষুব্ধ হন যে, তাকে এই জনপদের অভিশাপ মনে করা হয়।

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে কিছুটা গা বাঁচিয়ে চলেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য নূর। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার তাণ্ডবের মাধ্যমে তিনি আবার খুনখারাবির রাজনীতি শুরু করেন। ওই দিন জেলার জলঢাকায় সাদের হোসেন (২৭) নামে জামায়াতকর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। এরপর শুরু হয় শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদী সরকারের দুঃশাসন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতার মসনদে বসেই হামলা-মামলা শুরু করে আওয়ামী লীগ। ওই মাসের মাঝামাঝিতে জেলা জামায়াত অফিসে হামলা চালায় তারা। এতে সহায়তা করে পুলিশ। কার্যালয়টি পুড়িয়ে দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় দলটির জেলা আমির, সেক্রেটারিসহ অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে। দফায় দফায় তাদের রিমান্ডে নিয়ে চালানো হয় নির্যাতন। এরপর রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, চাকরিজীবী, সাংবাদিকসহ সমাজের সর্বস্তরের পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষকে জড়ানো হয় মামলায়। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবির।

মামলা দিয়ে হয়রানি

গত সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনে জেলায় জামায়াত নেতাকর্মীর নামে রাজনৈতিক মামলা হয় ১৩২টি। এতে আসামি করা হয় ৪০ সহস্রাধিক ব্যক্তিকে। আর বিএনপির নামে ৪৮ মামলায় ৫ সহস্রাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। এছাড়া বিএনপি ও জামায়াতের জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের দলীয় কার্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। জেলা জামায়াত অফিসের পর পুড়িয়ে দেওয়া হয় ডোমার উপজেলা কার্যালয়ও। দখলে নেওয়া হয় অন্য অফিসগুলো।

টানা কয়েক বছর জুলুম চললেও খুন-খারাবি কম হয়। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে ফের লাশের রাজনীতি শুরু করেন নীলফামারীর ‘কসাই’ নূর। জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অশান্ত করতে আঁটেন নতুন ফন্দি, আঁকেন জামায়াত ও বিএনপির প্রথম সারির নেতাকর্মী হত্যার নীলনকশা।

নীলফামারী আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আল মাসুদ চৌধুরী বলেন, ১১৩টি মামলার ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ৪৮টি মামলায় সিদ্ধান্ত এসেছে। অনেক মামলা বিচারের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। অন্যগুলোর ব্যাপারে অচিরেই সিদ্ধান্ত আসবে।

আওয়ামী লীগ নেতাদের দৌরাত্ম্য

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার পর জেলার অঘোষিত গডফাদারে পরিণত হন নূর। তার নির্দেশ ছাড়া দলে চলত না কিছুই। এছাড়া খবরদারি প্রতিষ্ঠা করেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন মুন। তারা ঠিকাদারি, নিয়োগ বাণিজ্য, মামলা, টেন্ডার বাণিজ্যসহ সব কারবার চালাতেন মিলেমিশে। তাদের ভয়ঙ্কর শোষণে এলাকাবাসী সব সময় তটস্থ থাকতেন।

এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জু চেয়ারম্যান, গাছ মিজানুর, ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি মনিরুল হাসান আপেল, সাধারণ সম্পাদক নোয়েল ছিল এলাকায় এক একটি খাতের সেনাপতি। মঞ্জু চেয়ারম্যান টেন্ডার বাণিজ্য, গাছ মিজানুর জেলা সভাপতি দেওয়ান কামাল আহম্মেদের সব অপকর্মের সারথী ও ছাত্রলীগ নেতা মনিরুল হাসান আপেল ও নোয়েল ছিল সব অপকর্মের অন্যতম কুশিলব। তাদের অন্যতম কাজ ছিল শিক্ষাঙ্গনে মাদকের সাম্রাজ্য বিস্তার করা।

এছাড়া নীলফামারী সরকারি কলেজ ও সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী নিবাসে ছাত্রলীগ নেতা মনিরুল হাসান আপেলের ছিল অবাধ যাতায়াত। যা নিয়ে জেলায় মুখরোচক কাহিনি প্রচলিত আছে।

অপরদিকে নীলফামারী-১ (ডোমার-ডিমলা) আসনের সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকার তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী, যা এলাকায় আগুন খাওয়া টিম নামে পরিচিতি পায়। এ টিমের নেতৃত্বে ছিলেন তার ভাতিজা ডিমলা উপজেলা যুবলীগের সভাপতি পারভেজ। অপর ৩ সন্ত্রাসী হলেন- তার অপর দুই ভাতিজা স্বেচ্ছাসেবক লীগের উপজেলা সভাপতি ফিরোজ, তার পিএস কানন ও তার ভাই মিন্টু। তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের টেন্ডার বাণিজ্য, তিস্তা নদীর পাথর ও বালু উত্তোলন, ভারত থেকে গরু ও মাদক পাচার, ভূমি দখল, নিয়োগ-বাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ সব অপকর্মের হোতা ছিলেন। এমপি আফতাব তার প্রতিবেশী এক বিধবা হিন্দু নারীর শেষ সম্বল বাড়ি-ভিটা দখল করে পেট্রোল পাম্প স্থাপন করেন।

আবদুল ওয়াহেদ বাহাদুর যুবলীগের জলঢাকা উপজেলার সাবেক সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। চোরাকারবারী, ভারতীয় গরুর পাচার, মামলা ও নিয়োগ-বাণিজ্য, মাদক কারবার, জুয়াসহ নানা অপকর্মে জড়িত ছিলেন তিনি। জলঢাকা থানার সামনে অফিস নিয়ে টর্চার সেল গঠন করে বিরোধীদের নির্যাতন করতেন। জুলাই বিপ্লবের পর যৌথবাহিনীর অভিযানে তার বাড়ি থেকে রাইফেলের ম্যাগাজিন উদ্ধার হয়েছে।

সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহসিনুল হক মহসিন, পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রফিকুল ইসলাম বাবু এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। শুধু বিএনপি-জামায়াতের লোকজন নয়, সাধারণ মানুষও তাদের উৎপাতে অশান্তিতে ছিলেন। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জামায়াত-বিএনপির তকমা দিয়ে চাঁদাবাজি ও দখলবাজি করেন। সরকারি বরাদ্দের মোটা অংশ তাদের পকেটে যেত। সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের দলীয় ক্ষমতা দেখিয়ে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা।

ডোমার উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম রিমন বিএনপি-জামায়াতের সব স্তরের নেতাকর্মীকে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করেন। কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেন। এছাড়া দখলবাজি, টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্যসহ এলাকায় এক মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়।

 

রামগঞ্জ প্রতিরোধ

আওয়ামী লীগের নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য বিশাল গাড়িবহর নিয়ে ২০১৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর মহড়া দেন তৎকালীন এমপি নূর। তারা সদর উপজেলার লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানীর বাড়ি অতিক্রম করার সময় সেখানে হামলা চালান। গাড়িবহরে থাকা আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ওই বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাটও করে। তখন এলাকায় তেমন মানুষজন না থাকায় এবং গাড়ি বহরে এমপি নূর, জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা থাকায় কেউ প্রতিরোধ করতে পারেনি। তবে তাৎক্ষণিক খবর পৌঁছে যায় রামগঞ্জ বাজারে।

খবর পেয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থি জনতা। তারা গাড়িবহর বাজারে পৌঁছামাত্র তাদের থামিয়ে প্রতিবাদ জানান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণ করে বহরে থাকায় আওয়ামী ক্যাডাররা। বেধে যায় সংঘর্ষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ১৪১ রাউন্ড শট গানের গুলি, ৩৭ রাউন্ড কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে বলে জানা যায়। এতে আওয়ামী লীগের ৪ নেতাকর্মী এবং আবু বক্কর সিদ্দিক নামে জামায়াত কর্মী নিহত হন। সংঘর্ষে আহত হয় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। তবে কোনো রকমে পালিয়ে বাঁচেন নূর।

সহিংসতার ঘটনায় পুরো জেলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী এমপির নির্দেশে সাঁড়াশি অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাতেই জেলা শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে নূরের সঙ্গে পরাজিত প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা মনিরুজ্জামান মন্টুর দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মোটরসাইকেল শো-রুম এবং তার ওষুধের দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা।

রামগঞ্জ বাজারে সংঘর্ষে ৫ জন নিহতের ঘটনায় দুটি মামলা হয়। এর মধ্যে নীলফামারী থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) বাবুল আকতার বাদী হয়ে ১৪ জনের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাত পরিচয়ের দেড় হাজার ব্যক্তিকে আসামি করেন। অপর মামলাটি করেন নিহত টুপামারী ইউনিয়ন কৃষক লীগের সভাপতি খোরশেদ আলম চৌধুরীর চাচাতো ভাই রাশেদ চৌধুরী। এতে ৮৬ জনের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাত পরিচয়ের দেড় হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। তবে বিবাদী সবাই জামায়াত, শিবির ও বিএনপির নেতাকর্মী।

মামলা দুটিকে পুঁজি করে গ্রেপ্তার অভিযানের নামে রীতিমতো বাণিজ্য শুরু করে পুলিশ। হাতিয়ে নেয় বিপুল অর্থ। এতে আতঙ্কে এলাকা ছাড়ে হাজার হাজার মানুষ। টাকা দিতে না পারায় জেল খাটতে হয় অনেক সাধারণ মানুষকেও। রেহাই পাননি স্থানীয় চা দোকানদার-হকারও। দীর্ঘদিন সংশ্লিষ্ট টুপামারী ও লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়ন প্রায় জনশূন্য ছিল। ৬ মাসেরও বেশি সময় ঐতিহ্যবাহী রামগঞ্জ বাজার, টুপামারী ও লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নে স্বাভাবিক জীবন ফেরেনি। ওই দীর্ঘ সময়ে স্থানীয় বেশ কয়েকটি মসজিদে আজান ও নামাজ আদায়ও হয়নি। হাতে গোনা দু-একটি মসজিদ চালু থাকলেও মুসল্লির সংখ্যা ছিল ৪-৫ জন।

অপরদিকে আসামির তালিকা ধরে গ্রেপ্তার-নির্যাতন চলে। এমনকি নূরের নির্দেশে এজাহারে নাম থাকা তিন নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে দুজন বিএনপির এবং অপরজন জামায়াতের। তারা হলেন- সদর উপজেলার লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী, একই উপজেলার টুপামারী ইউনিয়ন ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতিক ও শিবিরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর থানা শাখার সভাপতি মহিদুল ইসলাম।

নিহত রব্বানীর স্ত্রী শাহানাজ বেগম বলেন, রব্বানিকে এক স্বজনের বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার কয়েকদিন পর তার ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। আমার স্বামী দোষী হলে তার বিচার করতে পারত। তা না করে তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। রব্বানীর মৃত্যুর পর শিশু সন্তান নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছি। এর পরও খুনিরা অব্যাহতভাবে হুমকি দিতে থাকে, কিন্তু খোঁজ নেওয়ার কেউ ছিল না। এখনো হয়রানি বন্ধ হয়নি। আজও সেই নির্মম খুনের বিচার হয়নি।

আতিকুরের বড় ভাই আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ঘটনার দিনই গা ঢাকা দেয় আতিক। ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি রাতে টাঙ্গাইল থেকে তাকে ও একই গ্রামের আনোয়ার হোসেনের ছেলে শিবির নেতা মহিদুলকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। দু-তিন দিন পর আতিকুলের লাশ পাওয়া যায়।

নিখোঁজ মহিদুলের ভাই শহিদুল বলেন, মহিদুলের লাশ উদ্ধার হয় বগুড়ার শিবগঞ্জ থেকে। ২০১৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অজ্ঞাত পরিচয়ের ওই লাশ উদ্ধারের পর দাফন করে পুলিশ। সেই লাশের ছবি দেখে ওই বছরের ৪ মার্চ মহিদুলকে শনাক্ত করা হয়।

যৌথ বাহিনীর অভিযানে মসজিদের ইমাম, মাদরাসার শিক্ষক, ব্যবসায়ী, কৃষক, শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে গণহারে গ্রেপ্তার করা হয়। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। বন্ধ হয়ে যায় মসজিদগুলো, ফাঁকা হয় মাদরাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিরান পড়েছিল অন্যতম ব্যস্ততম রামগঞ্জ বাজার, বন্ধ ছিল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। বাসিন্দারা এলাকা ছেড়ে আশপাশের উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী জেলায় গিয়ে আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতজনদের বাসায় থাকেন। দীর্ঘদিন ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করে ভাটিয়াপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া, নিত্যানন্দী, সিতারপাড়, সুখধন, রামগঞ্জ গ্রামে।

ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-লুট

সংঘর্ষের ঘটনাস্থল রামগঞ্জ বাজার ছাড়াও জেলার বিভিন্ন স্থানে বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। জলঢাকা উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ফয়সাল মুরাদের উপজেলা শহরের থানার সামনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে অর্ধ কোটি টাকার পণ্য লুট করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। এতে নেতৃত্ব দেন আওয়ামী লীগ নেতা সফিয়ার মাস্টার।

বাজারের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী আবদুল খালেক ও আবদুল ওহাব বলেন, আওয়ামী ক্যাডাররা রাতের আঁধারে তাদের বন্ধ দোকানের তালা ভেঙে সব পণ্য নিয়ে গেছে। তাদের লুটপাট থেকে বাঁচতে পুলিশের সহায়তা চাইলেও তারা পাশে দাঁড়ায়নি।

১২ নেতাকর্মী হত্যা

আওয়ামী আমলের সাড়ে ১৫ বছরে জেলায় জামায়াত ও বিএনপির ১২ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে দুজন বিএনপি নেতা ও একজন ছাত্রদল নেতা এবং অপর ৯ জন জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মী। তাদের মধ্যে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার আঘাতে নিহত হন জলঢাকার পূর্ব বালাগ্রামের আতিয়ার রহমানের ছেলে জামায়াতকর্মী কাপড় ব্যবসায়ী সাদের হোসেন। তার স্ত্রী ও তিন সন্তানের ভরণপোষণ চলে দল থেকে পাওয়া মাসিক ভাতায়।

২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবর জলঢাকা শহরের বাসস্ট্যান্ডে মিছিলে বিজিবির গুলিতে নিহত হন কাজীরহাট হাজীপাড়া গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে জামায়াত কর্মী মোসলেম উদ্দিন। তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের দায়িত্ব নিয়েছে জামায়াত। ২০১৩ সালের ২ মার্চ মিছিলে বিজিবির গুলিতে নিহত হন শিবির কর্মী আতিকুল ইসলাম আপন। তিনি জলঢাকার টেঙ্গনমারি গ্রামের আনিছুর রহমানের একমাত্র ছেলে।

নিহত মোসলেমের বাবা আবুল হোসেন বলেন, বিজিবির গুলিতে তার ছেলের মৃত্যু হয়, আল্লাহ যেন তাকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন। তিনি শুধু তার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দেখে যেতে চান।

জলঢাকার গাবরোল বালাপাড়া গ্রামের মাদরাসা শিক্ষক মাওলানা মমতাজ উদ্দিন একই বছর পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তার স্ত্রী ও চার সন্তানের সংসার চলছে ধুঁকে ধুঁকে। ডিমলার খালিশা চাপানী গ্রামের ইমামুদ্দিনের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের দিন ব্যাপারীটোলা আলিম মাদরাসা ভোটকেন্দ্রে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এই দৃশ্য দেখে ঘটনাস্থলে হৃদরোগে মারা যান তার চাচাতো ভাই আকবর আলীর ছেলে মিজানুর।

এছাড়া ২০১২ সালের ডিসেম্বরে পুলিশের অভিযানকালে মৃত্যু হয় ডোমারের পশ্চিম বোড়াগাড়ী চান্দিনা পাড়া গ্রামের জামায়াত কর্মী শবদের আলী ও একই উপজেলার শালমারা গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে বিএনপির হরিণচড়া ইউনিয়ন সেক্রেটারি জাহানুর রহমানের। অর্ধশতাধিক মামলা নিয়ে জামায়াতের জেলা আমির অধ্যক্ষ আজিজুল ইসলাম ও জলঢাকা উপজেলা আমির আবদুল গনির মৃত্যু হয়।

নীলফামারীতে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড হয়েছে সদর থানায় ওসি আবু আক্কাস আহম্মেদ, মো. শাহজাহান এবং পুলিশ সুপার জোবায়েদুর রহমানের সময়।

চাকরিচ্যুত ৮ জন

২০১৬ সালে সৈয়দপুর শহরে জামায়াতের দোয়া অনুষ্ঠান থেকে জসিম উদ্দিন নামে সেনা সদস্য ও সৈয়দপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ওয়াজেদ আলীকে আটক করে পুলিশ। কিছুদিনের মধ্যে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। জলঢাকার কালীগঞ্জ গোলনা গ্রামের জামায়াত নেতা ও শিমুলবাড়ী ডিগ্রি কলেজের ইংরেজির প্রভাষক ইউছুব আলীকে স্থায়ীভাবে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। এভাবে বিএনপি ও জামায়াতের ৮ চাকরিজীবীকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

সাংবাদিক নির্যাতন

সংবাদ প্রকাশের জের ও সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করতে জেলায় কর্মরত চার সাংবাদিকের নামে মামলা দিয়েছিল পুলিশ। তাদের মধ্যে আমার দেশ-এর জেলা প্রতিনিধি উল্লেখযোগ্য। তাকে ২০১২ সালের ৫ ডিসেম্বর পুলিশের ওপর হামলার মামলায় আসামি করা হয়। এছাড়া নানাভাবে তাকে হয়রানি করা হয়। এছাড়া ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে কেন্দ্রে অগ্নি সংযোগ ও হামলার মামলায় আরো দুই সাংবাদিককে জড়ানো হয়। তারা হলেন- ইত্তেফাক পত্রিকার ডোমার উপজেলা প্রতিনিধি মোজাফফর আলী, এনটিভির জেলা প্রতিনিধি ইয়াসিন মোহাম্মদ সিথুন ও আমার দেশ-এর জলঢাকা উপজেলা প্রতিনিধি সেলিমুর রহমান। এ মামলায় ৪ মাস জেল খাটতে হয় সেলিমকে।

জেলা জামায়াতের আমির অধ্যক্ষ আবদুস সাত্তার বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার জামায়াতের মেরুদণ্ড ভাঙার চেষ্টা করেছে। হামলা-মামলা ও গুম-খুনের মাধ্যমে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিল নেতাকর্মীদের। নূরের গাড়িবহরে হামলার মামলায় অধিকাংশ জামায়াত নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে তড়িঘড়ি করে চার্জশিট দিয়ে বিচারের নামে কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছিল।

তিনি আরো বলেন, দাড়ি-টুপি ও পাঞ্জাবি পরা দেখলেই জামায়াত-শিবির সন্দেহে গ্রেপ্তার করত। মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনরাও তাদের হাত থেকে রক্ষা পাননি। এমনকি বিয়ের আসর থেকেও নিরীহ লোকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচিতো দূরের কথা, নেতাকর্মীরা বাড়িতেও অবস্থান করতে পারেননি। কিন্তু, তাদের অপচেষ্টা ও ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। এক পর্যায়ে তারা পালাতে বাধ্য হয়েছে।

জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মীর সেলিম ফারুক বলেন, ফ্যাসিবাদের শোষণামলে রাজনীতির মূল্যবোধই নষ্ট করা হয়েছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মী, এমনকি আওয়ামীবিরোধী অরাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে। চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। মামলার ঘানি টানতে টানতে বহু নেতাকর্মী নিঃস্ব হয়ে গেছেন। আমরা নিজ ঘরে ঘুমাতে পারিনি। আমাদের মৌলিক অধিকার বলতে কিছুই ছিল না। শুধু তাই নয়, বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী হওয়ায় হাসাপাতালেও মিলত না চিকিৎসা। কসাই নূর রামগঞ্জে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে আমাদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছেন।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন বলেন, গত দেড় দশক ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ রাজনীতির নামে যে অরাজকতা দেখিয়েছে, আগে এমন নীলফামারী কেউ দেখেনি। বিরোধীদল ও বিরোধী মত দমনে জেলায় বিশেষ করে বিএনপি নেতাকর্মীদের টার্গেট করে গুম-খুন ও হামলা-মামলা চলে। হাজার হাজার বিএনপি নেতাকর্মীর পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। এক কথায় বললে ওই সময়টা ছিল আওয়ামী আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগ। এটা আমার কথা নয়, নিপীড়িত জনগণের মন্তব্য।