Image description

আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে দাবি করে এর পক্ষে একটি বয়ান তুলে ধরলেন সাংবাদিক ও উপস্থাপিকা নবনীতা চৌধুরী। সেইসাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে কে আসতে পারেন- তা নিয়ে একটি বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়েছেন তিনি।

 

নবনীতা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসবে কিনা, তা নির্ভর করছে সরকারের বাইরের রাজনৈতিক পক্ষগুলো যেমন, বিএনপি-জামায়াত, সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর তৎপরতার উপর। যদি দ্রুত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসে, তবে বুঝতে হবে প্রধান উপদেষ্টা পদে কে আসবেন, সেই বিষয়টি এই পক্ষগুলো নিশ্চিত করে ফেলেছে এবং আগামী নির্বাচনের আগেই এটি কার্যকর হতে যাচ্ছে।

 

নিজের ইউটিউব চ্যানেল ‘নবনীতার বয়ান’ নামক অনুষ্ঠানে তিনি এই বিশ্লেষণ তুলে ধরেন।

 

এই উপস্থাপিকা দাবি করেন, ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত ড. ইউনূস সরকার কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথা ছাড়াই গঠিত হয়েছে, যা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন রয়েছে। বিষয়টি মাথায় রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরাসরি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে এই পরামর্শ দেওয়া হয় যে, আদালত যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

 

প্রসঙ্গত, প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ আগামী ডিসেম্বর অবসরে যাবেন। ফলে তার মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরলে নিয়ম অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন তিনি।

 

সে হিসেবে আমেরিকার তরফে সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে সৈয়দ রেফাত আহমেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে দাবি করে নবনীতা বলেন, ১৪ আগস্ট মার্কিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন সরাসরি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তার বাসভবনে সাক্ষাৎ করে এই বিষয়ে আলাপ করেন।

 

‘‘কোনরকম সাংবিধানিক ভিত্তি ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। তাই এই সরকার পুনর্গঠন করতে হলে বা ইউনূস যদি নিজে সেফ এক্সিট চান বা তাকে সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে তখন আসলে বাংলাদেশের
ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে, কী ধরনের সরকার গঠিত হবে?,’’ বলেন নবনীতা।

 

‘‘কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে সরাসরি প্রধান বিচারপতিকে এই পরামর্শ দেওয়া হয় এবং (তার বাসভবনে) এই আলোচনা করতে যাওয়া হয় যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে যাতে আদালত সক্রিয় হয়ে ওঠে। এবং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ যাতে প্রস্তুত থাকেন সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে যেকোনো পালাবদল ঘটে গেলে’’, বলেন তিনি।

 

যখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইউনূস সরকারের অবিশ্বাস বেড়েছিল, বিশেষভাবে বিএনপির, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরানোর আলোচনা সামনে আসে মন্তব্য করে নবনীতা আরও বলেন, পরবর্তীতে নিশ্চিতভাবে এই আইনি ব্যাখ্যার প্রশ্ন উঠবে এবং ইউনূস সরকারের বৈধতা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন উঠবে, মামলা হতে পারে। এমন অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসে কিনা একটা সাংবিধানিক ভিত্তিসমৃদ্ধ বা আদালতের আদেশে পুনর্গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে শেষ পর্যন্ত আগামী নির্বাচনটা অনুষ্ঠিত হয় কিনা এই নিয়ে জল্পনা উঠেছে তুঙ্গে।

 

এই সাংবাদিক দাবি করেন, আগস্ট মাসের শেষে এসে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আদালতে ওঠে। তার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ। আগস্ট মাসেও কিন্তু ড. ইউনূস সরকার শেষ পর্যন্ত নির্বাচন দেবেন কিনা ফেব্রুয়ারিতে তা নিয়ে সংসয় ছিল। তিনি জুলাইজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন তরফের চাপের মুখে এবং সরাসরি তাদের পরামর্শে ৫ আগস্ট প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন কিন্তু আগস্টেও রাজনৈতিক দলগুলো সেই ভরসাটা পাচ্ছিল না।

 

‘‘ফলে নির্বাচনকালীন একটা নিরপেক্ষ সরকার প্রয়োজন হবে, যে সরকারকে জামায়াতে ইসলামী-বিএনপি সহ সকল দল গ্রহণযোগ্য মনে করবে। আর এমন একটা সরকার গঠনের জন্যে মার্কিন দূতাবাসের তরফে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত মোটামুটি মানে সকল প্রথা ভঙ্গ করে সবাইকে চমকে দিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তার বাসভবনে চলে যান।’’

 

নবনীতা দাবি করেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ অবসরে যাবার সময়ও চলে আসবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে। তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে প্রধান উপদেষ্টার পদ নিতে প্রস্তুত হওয়ার জন্য কিন্তু তিনি সেক্ষেত্রেও সরাসরি রাজি হতেগড়িমসি করেন। কারণ এমন একটা স্পর্শকাতর সময়ে তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নিয়ে বেশ খুশি আছেন বটে, তিনি সকলকে খুশি রেখে তিনি রায়গুলো দিতে পারছেন বটে, কিন্তু বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী কিংবা জাতীয় নাগরিক পার্টি- এই পক্ষগুলো যদি নির্বাচন পর্যন্ত একটা গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ থাকে তাহলে এদের সকলকে খুশি রেখে একটা নির্বাচন অনুষ্ঠান করে ফেলতে পারবেন কিনা সৈয়দ রেফাত আহমেদ সে বিষয়ে নিশ্চিত না হতে পেরেই তিনি সরাসরি মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে কোন কথা দিতে পারেন না।

 

তিনি বলেন, রিভিউ আবেদনের শুনানি চলাকালে ২৭ আগস্ট প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছিলেন, আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে দিয়ে সাময়িক সমাধান দিতে চায় না, বরং নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কার্যকর ও সুদূরপ্রসারী সমাধান চায়। তিনি নিজেও প্রশ্ন তোলেন যে, এই ব্যবস্থা কার্যকর হলে কবে থেকে কার্যকর হবে।

 

নবনীতা বলেন, প্রধান বিচারপতি মাথায় ঢুকিয়ে দেন যে, বিএনপি-জামাত-সুশীল সমাজ এই তিন পক্ষই যখন রিভিউয়ের আবেদন করেছে, তাই এদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তো বিচারপতি রেফাত আহমেদ তাদের কাছেই উত্তর চায়ছেন যে, এরা কবে থেকে কার্যকর চায়ছেন? আগামী নির্বাচনের আগেই কি কার্যকর চান? তার মানে সৈয়দ রেফাত আহমেদ জানেন, এই বিষয়গুলোর মীমাংসা হতে হবে আদালতের বাইরে এবং তিনি সেই প্রেসক্রিপশন মোতাবেকই কাজ করবেন।

 

তিনি বলেন, আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনলে বুঝতে হবে, বিএনপি-জামায়াত-বিদেশী পক্ষ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক পক্ষগুলো এবং তাদের যে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা আছেন, তারা নির্বাচনের আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে চায়।

 

‘‘না হলে আবারো হয় আজকের শুনানিটাও বিলম্বিত হবে অথবা এই শুনানির পর আবার যে তারিখ ঘোষিত হবে আগামী নির্বাচন পার হয়ে গিয়ে এমন একটা সময়ে। সেসময়ে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আলাপ হবে যখন ইউনূস সরকারকে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনাটা কোনভাবে বিব্রত করতে পারবে না।’’

 

‘‘আর যদি এই আদালত খুবই দ্রুত ফিরিয়ে আনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তাহলে বুঝতে হবে সৈয়দ রেফাত আহমেদ বা প্রধান উপদেষ্টা পদে কে আসতে যাচ্ছেন সে বিষয়টা এইসব পক্ষগুলো নিশ্চিত করে ফেলেছে এবং আগামী নির্বাচনের আগেই এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসছে। ওই যে সৈয়দ রেফাত আহমেদ যে প্রশ্ন করেছেন কবে কার্যকর হবে?- সে সিদ্ধান্তটাও হয়ে গেছে,’’ বলেন তিনি।

 

নবনীতা আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা পদে কাকে নিয়োগ করা যাবে? প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কে দায়িত্ব নিতে পারেন? তত্ত্বাবধায়ক সরকারে?-এই বিষয়টি নিশ্চিত না হলে নিশ্চিতভাবেই সৈয়দ রেফাত আহমেদ এসময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার ঝুঁকি নেবেন না। তিনি বাইরে থেকে কি ইঙ্গিত পেয়েছেন তার উপর নির্ভর করছে আদালতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার বিষয়টি। আর নির্ভর করছে ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব নিতে রাজি হন কিনা তার উপরেও।

 

উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে করা একাধিক আপিল আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শুরু হয়েছে। আজ মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়।

 

এর আগে গত ২৭ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে করা আবেদনের শুনানি শেষে আপিলের অনুমতি দেওয়া হয়।এরপর ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার আপিল করেন।