Image description

জয়পুরহাট জেলার বেশিরভাগ মানুষ শান্তিপ্রিয়। এ জনপদের রাজনৈতিক মাঠও ছিল সংঘাতহীন। বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলিমের জানাজায় এসে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা ও সাবেক এমপি আব্বাস আলী মণ্ডল বলেছিলেন, জয়পুরহাটের রাজনৈতিক অঙ্গনে কোনো হানাহানি-বিশৃঙ্খলা ছিল না।

রাজনৈতিক কর্মসূচি শেষে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতারা একসঙ্গে বসে চা খেতাম। আলিম ভাইকে বড় ভাই মানতাম। তার চেম্বারে আমি প্রায়ই যেতাম। দুই ভাই বসে চা খেতাম। ব্যক্তিগত-পারিবারিক সব বিষয়ে আলাপ-আলোচনা-পরামর্শ করতাম।

স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জেলায় বিএনপি, জামায়াত, আ.লীগ, জাতীয় পার্টি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতাদর্শের পার্থক্য থাকলেও বড় ধরনের সংঘাত-সন্ত্রাস ছিল না।

তবে পরিস্থিতি একেবারেই বিপরীত মোড় নেয় ফ্যাসিস্ট হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকে। মানুষ দম বন্ধ পরিবেশে সময় পার করেছে। বিরোধী মতের লোকজনকে আটক, অপহরণ, গুম, পঙ্গু, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ নিপীড়ন ছিল নিয়মিত ঘটনা। এসব কাজে আওয়ামী লীগ সরাসরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করত। আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশে পুলিশ শত শত মিথ্যা মামলা দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে ঘরছাড়া করেছিল। দীর্ঘদিন নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছে তাদের। স্বৈরাচারী সরকারের নির্যাতনের ভয়ে ফসলের মাঠ, বাঁশঝাড়, কবরস্থান, পরিত্যক্ত বিল্ডিং ও বাড়িঘরে আশ্রয় নিতে হতো তাদের। অনেকেই ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় আত্মগোপনে ছিলেন। তারপরও আটক করে চালানো হতো অমানবিক নির্যাতন। কারো কারো ঠিকানা হয়েছিল জেলখানায়। জামিন হলে জেলগেট থেকে পুনরায় আটক করে নতুন মামলা দিয়ে জেলে ঢোকাত পুলিশ। হত্যা-আতঙ্ক তাড়া করত তাদের সারাক্ষণ। মুখ খুললেই চলত নির্যাতন।

জামায়াতের জেলা শাখার সহকারী সেক্রেটারি মামুনুর রশীদ আমার দেশকে বলেন, ‘শুধু জামায়াতের বিরুদ্ধেই ২৩০টি মামলায় প্রায় ২৫ হাজার আসামি করা হয়েছিল। ১৩০টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। বাকিগুলো এখনো চলমান।’

জানা গেছে, মামলা চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে অনেক পরিবার। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা জামায়াতের অফিস ভাঙচুরের পর আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। পরবর্তীতে জামায়াতের সবগুলো অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। শহরের কেন্দ্রীয় মসজিদে নিয়মিত পুলিশি পাহারা বসানো হতো।

জামায়াতের জেলা আমির ও জয়পুরহাট-১ আসনের এমপি প্রার্থী ডা. ফজলুর রহমান সাঈদ, সেক্রেটারি গোলাম কিবরিয়া মণ্ডল, সহকারী সেক্রেটারি হাসিবুল আলম, মামনুর রশীদ, আক্কেলপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও জয়পুরহাট-২ আসনের এমপি প্রার্থী রাশেদুল আলম সবুজকে বারবার জেলে যেতে হয়।

জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুদ রানা প্রধান বলেন, ‘আমাদের শায়েস্তা করতে মোল্লা নজরুল ইসলাম নামে একজন পুলিশ সুপারকে নিয়ে এসেছিল আওয়ামী সন্ত্রাসী লীগ। তিনি জয়পুরহাটের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের জাহেলি যুগের মতো নিপীড়ন করেছিলেন।’

তিনি বলেন, আওয়ামীদের তথাকথিত শান্তি সমাবেশে বোমা হামলা মামলায় আমার বাবা সাবেক এমপি মোজাহার আলী প্রধানকে হুকুমের এবং আমাকে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। জয়পুরহাটে নিজেকে ‘খাদেম’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া আ.লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন প্রকাশ্য জনসভায় আমাকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করতে বলেন। সেদিনই আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি অ্যাড. সামছুল আলম দুদু, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সেক্রেটারি এমএম সোলায়মান আলীসহ দলটির নেতাকর্মীরা জেলা বিএনপি অফিস লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে এবং বিএনপি নেত্রী জাহেদা কামালের বাসায় হামলা চালায়।

এই বিএনপি নেতা বলেন, জামায়াতের হাসিবুল আলম লিটন ভাইয়ের মোবাইলের দোকান লুট করে, ভাঙচুর চালানো হয় এবং আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। একই মামলায় শিবিরের জেলা সভাপতি আবু যর গিফারী এবং সেক্রেটারি ওমর আলী বাবুকে অমানবিক ও অমানষিক নির্যাতন করা হয়। অস্ত্র উদ্ধারের নামে রাতের আঁধারে তাদের উভয়ের ডান পায়ের হাঁটুতে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করা হয়। চিরতরে তাদের পঙ্গু করে দেওয়া হয়। সে সময় জীবন বাঁচাতে ফেরারির জীবনযাপন করি। জীবন থেকে হারিয়ে ফেলি চারটি বছর।

তিনি বলেন, এসপি মোল্লা নজরুল ইসলামের অপরাধ নিরপেক্ষ তদন্তসাপেক্ষে উপযুক্ত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি। তিনি বলেন, নেতাকর্মীরা যাতে অফিসে না আসতে পারে, সে জন্য প্রায় সময়ই পুলিশ বিএনপি অফিস ঘেরাও করে রাখত। সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচির ওপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। সব ধরনের কর্মসূচিতে পুলিশি বাধা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

নিরাপত্তার জন্য আ.লীগ অফিসও ঘিরে থাকত পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনী। সাবেক এমপি প্রয়াত মোজাহার আলী প্রধানকে একাধিক গায়েবি মামলায় দিনের পর দিন কোর্টের বারান্দায় ঘুরতে হয়েছে। অসুস্থতা নিয়ে দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হয়েছিল। তার শহরের বাসভবনেও হামলা করা হয়। জেলা বিএনপির তৎকালীন আহ্বায়ক অধ্যক্ষ শামছুল হককে তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে গায়েবি মামলা দেওয়া হয়। জেলা বিএনপির সাবেক সেক্রেটারি অধ্যাপক আমিনুর রহমান বকুলকেও সে মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। অধ্যক্ষ শামছুল হকের বাসায় রাত-দিন হানা দেওয়া ছিল পুলিশের রুটিন ওয়ার্ক। নারী ও শিশুরা আতঙ্কে থাকত সারাক্ষণ। সে সময় শিশুরা ট্রমাটাইজড হয়ে পড়ে।

অধ্যক্ষ শামছুল হকের বড় ছেলে যুবদল নেতা মোক্তাদুল হককে বারবার জেলে পাঠানো হয়। বারবার নির্বাচিত জয়পুরহাট পৌরসভার কমিশনার ও প্যানেল মেয়র জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলজার হোসেন, সাবেক এমপি মরহুম মোজাহার আলী প্রধানের ছেলে জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুদ রানা প্রধান, বড় ছেলে পৌর বিএনপি সেক্রেটারি আবু রায়হান উজ্জ্বল প্রধান, ছোট ছেলে জেলা ছাত্রদল সভাপতি মামুনুর রশীদ প্রধান কেউই বাসায় থাকতে পারতেন না। বারবার কারা নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তাদের সবাইকে। তাদের বাসাবাড়িতে হামলা করা হয়েছে।

অপহরণ

২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল রাতে জয়পুরহাট জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি অধ্যাপক নজরুল ইসলামকে বাসা থেকে অপহরণ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বহু চেষ্টা করেও তার কোনো খোঁজ পাননি পরিবারের সদস্যরা। ৬৯ দিন পর একদিন ভোরে পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর এক গ্রামীণ রাস্তায় তাকে ফেলে রাখা হয়। আক্কেলপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও জয়পুরহাট-২ আসনের এমপি প্রার্থী রাশেদুল আলম সবুজকে অপহরণ করে অমানবিক নির্যাতন করে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায়।

পাঁচবিবি উপজেলার তৎকালীন জামায়াত আমির তসলিম উদ্দিন আমার দেশকে বলেন, ‘পুলিশ রাত ১২টায় পুরানাপৈলের বাসা থেকে আমাকে তুলে নিয়ে যায়। ভেবেছিলাম কোনোদিন ফিরতে পারব না। আমাকে তুলে নিয়েই অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। আমি মাদরাসাশিক্ষক। তাই পুলিশ আমাকে বলে, ‘আগে মুসলমান হ, পরে মাদরাসা করিস।’ আমাকে পাঁচবিবি থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। পরে যখন দেখি আমার নামে মামলা সাজানো হচ্ছে, তখন একটু আঁচ করতে পারছিলাম হয়তো অপহরণ করবে না। আমার নামে ছয়টি মামলা দেওয়া হয়। ছয়দিনের রিমান্ডে রাখা হয়। সেখানে চরম মানসিক নির্যাতন করা হতো। খাবার দিলেও পানি দিত না। অজু করার পানি চাইলেও পেতাম না। পাঁচবিবি থানার তৎকালীন ওসি আশরাফুল ইসলাম আমাকে জোরপূর্বক সংবাদ সম্মেলন করে জামায়াত থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। ওই মামলা বাবদ আমার চার লাখ টাকা খরচ হয়।’

২০১৫ সালের ৯ মার্চ আক্কেলপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও জয়পুরহাট-২ আসনের এমপি প্রার্থী রাশেদুল আলম সবুজকে অপহরণ করে অমানবিক নির্যাতন করে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘আমাকে জয়পুরহাট-আক্কেলপুর সড়কের শুক্তাহার মোড় থেকে শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা অপহরণ করে। পরে বেদম প্রহার ও নির্যাতনের পর মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায়। পুলিশ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় গ্রেপ্তার দেখায়। বগুড়ায় চিকিৎসা নেওয়ার পর ছয় মাস কারাভোগ করে জামিন পাই।’

ক্রসফায়ারে হত্যা

২০১৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে জয়পুরহাট পৌরসভাধীন দেওয়ানপাড়া মহল্লার নজরুল ইসলামের ছেলে শাফিনুল ইসলামকে ঢাকার উত্তরা থেকে র‌্যাব সদস্যরা তুলে নিয়ে যায়। তিনি ছিলেন বিএনপি সমর্থক। শাফিনের বাবা নজরুল ইসলাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমার দেশকে বলেন, ‘অপহরণের পর দীর্ঘ এক মাস বেআইনিভাবে হেফাজতে আটক রাখে আমার সন্তানকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বস্তরে ধরনা দিয়েও খোঁজ পাইনি আমার কলিজার টুকরাকে। অবশেষে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে ২৫ অক্টোবর রাতে সদর উপজেলার পাকার মাথা দাদরা জন্তিগ্রাম মৌজার হেলাল সরদারের পরিত্যক্ত চাতালে নিয়ে এসএমজি ও শটগান দিয়ে ১০ রাউন্ড গুলি করে আমার বাবাকে হত্যা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তৎকালীন এসপি মোল্লা নজরুল ইসলাম এ হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অনেক অপরাধ করেছেন। মামলা চলমান। আমরা ন্যায়বিচার চাই। তার উপযুক্ত বিচার দেখে মরতে চাই।’

অপ্রতিরোধ্য চাঁদাবাজি

দলীয় প্রোগ্রাম বাস্তবায়নে চলত চাঁদাবাজি। বিভিন্ন অজুহাতে ব্যক্তি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে জোরজবরদস্তি চাঁদাবাজি করা হতো। ৬০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে না পারায় সেলুনকর্মী সদর উপজেলার তেঘর শেখপাড়ার ওসমান শেখের ছেলে হাতেম শেখের বাম হাত কেটে নেয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা।

হাতেম শেখ আমার দেশকে বলেন, ‘পলছনের (পরবর্তীতে দুষ্কৃতকারীদের হাতে নিহত) নেতৃত্বে ছয়-সাত আওয়ামী সন্ত্রাসী আমার বাড়িতে এসে বলে তোর মেয়ে কোথায়? তোর মেয়েকে দরকার। বুঝতে পারি মেয়েকে তুলে নিতে এসেছে। আমরা ভিতসন্ত্রস্ত হই। বিবাহিত মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থাকায় সে যাত্রায় রক্ষা পাই। দুই মাস কেউ বাড়ি থাকতে পারিনি। পরবর্তীতে তাদের লোকজন আমাদের ডেকে নিয়ে ৬০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। সেলুনে কাজ করে যা পাই, তা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাই। এত টাকা পাব কোথায়? চাঁদা না দিয়েও বাঁচার উপায় নেই। এলাকার এক দয়ালু লোকের কাছ থেকে ছয় হাজার টাকা ধার নিই। কিছুদিন পর ২০১৪ সালের আশ্বিন মাসের ২ তারিখে প্রকাশ্যে রামদা, সামুরাই নিয়ে বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেলযোগে ৪০-৫০ আওয়ামী সন্ত্রাসী আমার দোকানে আসে। দোকান থেকে আমাকে বের করে কোপাতে থাকে। এতে বাম হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং ডান হাতের কয়েকটি নখ কেটে যায়।’

এরপর থেকে তিনি আর কোনো কাজ করতে পারেন না। প্রতি তিন মাস পর তিন হাজার ৫৫০ টাকা প্রতিবন্ধী ভাতায় তো আর সংসার চলে না। এখন ভিক্ষা করে খান।

২০১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় ইউনাইটেড হজ গ্রুপের এমডি মাওলানা ফিরোজ আনসারীকে অপহরণ করে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। শারীরিক নির্যাতন করে তারাই আবার পুলিশকে ফোন দেয়। পুলিশ বলে, ‘বানিয়ে (পিটিয়ে) থানায় দিয়ে আসুন’। তিনি বলেন, পরে বাসার লোকজন ছাত্রলীগ অফিসে এসে অনুনয়-বিনয় করে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়।

পুলিশের নৃশংসতা

পুলিশ নৃশংস বর্বরতা চালিয়ে চিরতরে পঙ্গু করে দেয় দুই শিবির নেতাকে। তারা ছিলেন তৎকালীন ছাত্রশিবিরের জেলা সভাপতি আবু যর গিফারী ও সেক্রেটারি ওমর আলী বাবু। তাদেরই সঙ্গী আল-আমিনকে মারাত্মকভাবে জখম করা হয়।

মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় যাওয়ার পথে রাজধানীর আব্দুল্লাহপুরে বাস থেকে শিবির সভাপতি ও সেক্রেটারিকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু পুলিশ গ্রেপ্তারের কথা অস্বীকার করে। ৯ দিন পর দুই শিবির নেতাকে গ্রেপ্তার করার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় র‌্যাব-৫। র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, শীর্ষ দুই শিবির নেতাসহ তিনজনকে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার শিমুলতলী খাস্বাগুড়ি এলাকা থেকে আটক করা হয়। ওমর আলী বাবু আমার দেশকে জানান, ‘গ্রেপ্তারের পর আমাদের আয়নাঘরের মতো ছোট কক্ষে আটকে রাখে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। পরে পুলিশ আদালতে চালান না করে কথিত অস্ত্র উদ্ধারের নামে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজায়। ওইদিন গভীর রাতে পাঁচবিবি উপজেলার আওলায় ইউনিয়নের নির্জন স্থানে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় তিনজনেরই ডান পায়ের হাঁটুতে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। ২৭ ডিসেম্বর অবস্থার মারাত্মক অবনতি হলে চিকিৎসকরা আমাদের জীবন বাঁচাতে পা কেটে বাদ দেন। এখন অমরা চিরপঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে আছি।’ একই বছর শিবিরের মিজানুর রহমানের চোখ তুলে ফেলা হয়। শিবিরের ইমরানকে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হয়।

২০১২ সালের ৫ নভেম্বর স্থানীয় শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দানে জামায়াতের কর্মসূচিতে পুলিশ গুলি চালিয়ে পাঁচবিবির বদিউজ্জামান মণ্ডলকে হত্যা করে। ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি জয়পুরহাটের আব্দুল্লাহ আল মামুনকে হত্যা করা হয় বলে জামায়াত সূত্র জানিয়েছে। ২০১৩ সালের ৩ মার্চ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে পাঁচবিবিতে জামায়াতের প্রতিবাদ মিছিলে তৎকালীন পাঁচবিবি থানার ওসি নুর মোহাম্মদের নেতৃত্বে পুলিশ গুলি চালিয়ে মজিদুল ইসলাম, মজনু মিয়া, নাসির উদ্দিন, আব্দুল হাকিম, ফরমান আলী ও হিসাব উদ্দিনÑএই ছয়জনকে হত্যা করে। গুলিবিদ্ধ হন আরো ৩০ জন। একই বছরের ১৮ জুলাই জাহিদুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে জয়পুরহাটে জামায়াতে ইসলামীর ৪০ জনের বেশি নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ হন। এ সময় পাঁচবিবি উপজেলায় জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক ৮২টি মামলায় প্রায় ২১ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়।

শুধু উপজেলা আমির সুজাউল করিমের বিরুদ্ধেই ২৮টি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জামায়াত নেতা মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে ১৪টি এবং উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আব্দুল গফুর মণ্ডলের বিরুদ্ধে ৯টি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক ও ‘গায়েবি’ মামলা দেওয়া হয়।

জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ আমার দেশকে জানান, জেলায় শুধু জামায়াতের বিরুদ্ধেই মোট ২৩০টি মামলায় প্রায় ২৫ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১৩০টিতে আসামিরা খালাস পেয়েছেন, বাকি মামলাগুলো এখনো চলমান।

বিএনপি সূত্র জানায়, দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও প্রায় ২৫০টি মামলায় ৩০ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছিল। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলজার হোসেন আমার দেশকে বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে জেলায় মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। কথায় কথায় মামলা, পুলিশকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা হতো।’

তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা, ব্যবসা-বাণিজ্য দখল, লুটপাট ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে জেলাকে ‘চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্যে’ পরিণত করা হয়েছিল। তৎকালীন এসপি মোল্লা নজরুল ইসলাম বিরোধী শিবিরের ওপর কঠোর দমন-পীড়ন চালাতেন এবং এ নিয়ে তিনি আনুষ্ঠানিক সভাতেও গর্ব করতেন। তার সময় জেলায় পুলিশি বর্বরতার নজির গড়া হয়েছিল।

জেলা বিএনপির তথ্যমতে, তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও প্রায় ২০০টির বেশি মামলা দেওয়া হয়েছিল, যাতে আসামির সংখ্যা ছিল প্রায় ২০ হাজার। জেলা পিপি অ্যাডভোকেট শাহনূর রহমান (শাহীন) জানান, মোট ১৯৮টি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই ৬৯টি মামলা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছে। অধিকাংশ মামলাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও গায়েবি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

জেলা জামায়াতের আমির ও জয়পুরহাট-১ আসনের সাবেক এমপি প্রার্থী ডা. ফজলুর রহমান সাঈদ বলেন, সে সময় মনে হতো আমরা যেন আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে ফিরে গেছি। এসপি মোল্লা নজরুল ইসলাম কেবল সরকারি নির্দেশ নয়, বরং ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারিতায় মানুষের ওপর জুলুম চালাতেন। তৎকালীন ওসি আশরাফুল ইসলাম, ওসি সিরাজুল ইসলাম, এসআই হাসমত ও এসআই আসাদের নেতৃত্বে পুলিশ ছিল কার্যত ‘জুলুম বাহিনী’। মোল্লা নজরুলের পরিকল্পনায় পুলিশ আওয়ামী ক্যাডার হিসেবে কাজ করত এবং বিরোধী শিবিরের সবকিছু ধ্বংস করে দিত।

তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু ও কঠোর বিচার দাবি করেন।

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলিমকে দীর্ঘদিন কারাবন্দি রাখা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেয়। ২০১৪ সালের ৩০ আগস্ট তিনি ঢাকা জেলখানার প্রিজন সেলে মৃত্যুবরণ করেন। মামলা হওয়ার পর গ্রেপ্তার হবেন জেনেও তিনি জয়পুরহাটের নিজ বাড়িতেই থাকতেন। বাবার জানাজাপূর্ব বক্তৃতায় তার বড় ছেলে ফয়সল আলিম অভিযোগ করেছিলেন, ‘স্বৈরাচার হাসিনা সরকার আমার বাবার চিকিৎসা করাতে দেয়নি। তাকে বিনাবিচারে জেলখানায় আটকে রেখে হত্যা করা হয়েছে।’

২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর অবৈধ ট্রাইব্যুনাল বাতিল ও জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার মুক্তি আন্দালনকে কেন্দ্র করে সদরের পুরানাপৈল ইউনিয়নের হালট্রি গ্রামে দিবালোকে গ্রামবাসীর ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি চালিয়ে জামায়াতের আব্দুর রহমান, ফিরোজ হোসেন, আসমা বেগম, ইনসান আলী ও শামীমÑএই পাঁচজনকে হত্যা করে। সেদিন আরো ৫০ জন গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশ সেদিন ১৮টি গাড়ি নিয়ে ওই গ্রামে একযোগে হামলা চালায় বলে এলাকাবাসী জানায়।

নিহত ইনসানের মা রিনা বেগম বুকফাটা কান্নায় আমার দেশকে বলেন, ইনসান আমার একমাত্র ছেলে। তাকে আমি মাদরাসায় পড়িয়েছি। ছোটবেলা থেকেই সে নামাজি ও পরহেজগার ছিল। পুলিশ আমার বাবাকে নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করেছে। অপরাধ ঢাকতে পুলিশ ও আ.লীগ মিলে উল্টো আমাদের এলাকার বহু মানুষকে আসামি করে মামলা করেছে। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। আমার আর কোনো ছেলে নেই। জামায়াত-শিবিরের ছেলেরা আমাদের প্রায়ই খোঁজ-খবর নেয়। প্রতি ঈদের আগে আমাদের বাড়ি আসে। ইনসানের বাবা মোসলেম উদ্দিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘আমার বয়স হয়েছে। আগের মতো কাজকর্ম করতে পারি না। বড় আশা ছিল ইনসান সংসারের হাল ধরবে। পুলিশ আমার সন্তানকে বাঁচতে দিল না। আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি।’

পুলিশি বর্বরতার শিকার জামায়াত আমিরের স্ত্রী

শিবিরের লোকজনের বাড়ি বাড়ি হানা দিত পুলিশ। পুরুষ সদস্যদের না পেলে নারীদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হতো।

পাঁচবিবি উপজেলা জামায়াতের তৎকালীন আমির তসলিম উদ্দিনের স্ত্রী সাবিনা খাতুন বলেন, ‘২০১৩ সালে আমিরের স্ত্রীর পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসআই প্রদীপ ও এসআই কমলের নেতৃত্বে ছয়-সাতজন পুরুষ পুলিশ জোরপূর্বক টেনে-হিঁচড়ে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে নেয়। তারপর আমার ওপর ব্যাপক শারীরিক নির্যাতন চালায়। এতে আমি অনেকটাই বিবস্ত্র হয়ে পড়ি। পরে বহু মানুষের সামনেই চার হাত-পা ধরে হেঁচড়ে পিচের রাস্তা দিয়ে প্রায় ৩০০ মিটার পুরানাপৈল বাজারের মূল পয়েন্টে নিয়ে যায়। পুরুষ পুলিশ সদস্যদের নির্যাতনে আমি দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলাম। শারীরিক সে আঘাত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। ব্যথায় ভালোমতো ঘুমাতে পারি না। সেই অমানবিক নির্যাতনের কোনো বিচার পাইনি। উল্টো আমাদেরই মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে।’

আওয়ামী আধিপত্য

সে সময় সমগ্র জেলায় একক আধিপত্য বিস্তার করে আ.লীগ। নাটের গুরু ছিলেন হুইপ ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জয়পুরহাট-২ (কালাই-ক্ষেতলাল-আক্কেলপুর) আসনের এমপি আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও হুইপ হওয়ায় পুরো জেলায় তার ছিল একক আধিপত্য।

সদরের দোগাছি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম, কালাই উপজেলার জিন্দারপুর ইউনিয়ন আ.লীগ সভাপতি ও সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য রফিকুল ইসলাম, ক্ষেতলাল উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তাকিম মণ্ডল, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক রাসেল দেওয়ান মিলন, তার পিএস ইমরুল কবির সৈকত, আ.লীগ নেতা গোলাম হাক্কানী, সাবেক মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান ও আক্কেলপুর উপজেলার রুকিন্দিপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আহসান কবিরকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি বিশাল সিন্ডিকেট। জয়পুরহাটের দুটি সংসদীয় আসনেই হাটবাজার, বালুমহাল, সড়ক-সেতু নির্মাণ, নদী খনন, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি নির্বাচন, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, পুলিশে নিয়োগ ছিল তার সিন্ডিকেটের দখলে। এমনকি তার ম্যাসেজ বা ডিও লেটার ছাড়া নির্বাচনি এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরী, স্কুল-কলেজে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ বোর্ডে সরকারি প্রতিনিধি (ডিজি প্রতিনিধি) নিয়োগ দিতে পারত না যথাযথ কর্তৃপক্ষÑএমন অভিযোগও আছে। পর্দার আড়াল থেকে এসব সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন হুইপ স্বপন। তার ইশারায় অধিকাংশ স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি নির্বাচিত হতেন।