
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনের আয়োজনকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস বিরাজ করছে। আগামীকাল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত এই নির্বাচন। ফলে নতুন নেতৃত্বের দিকে মুখিয়ে আছেন শিক্ষার্থীরা। কারণ রাকসু শুধু শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের সংগঠন নয়, এটি দেশের জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব গঠনের একটি ঐতিহাসিক প্ল্যাটফর্ম।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ দশকের মধ্যে রাকসুর নেতৃত্বে উঠে আসা অনেকেই পরে জাতীয় রাজনীতির মূলধারায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তিন বছর পর ১৯৫৬-৫৭ মেয়াদে প্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন নাম ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (রাকসু)। ১৯৬২ সালে সংগঠনটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নামে যাত্রা শুরু করে। এরপর মোট ১৬ বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৮৯ সালে।
রাকসু থেকে উঠা এসে পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছেন এমন কয়েকজনের পরিচিতি দেওয়া হলো নিচে।
১. আবু সাইয়িদ
১৯৬৫-৬৬ শিক্ষাবর্ষে রাকসুর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন আবু সাইয়িদ। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব সময়ে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি তথ্য প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সংসদ সদস্যও ছিলেন।
২. নুরুল ইসলাম ঠান্ডু
তিনি ৭৩-৭৪ মেয়াদে রাকসুর ভিপি ছিলেন। পরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন এবং তার নিজ এলাকায় এমপি পদপ্রার্থী ছিলেন।
৩. ফজলুর রহমান পটল
তিনি ১৯৭৪-৭৫ সালে রাকসু ভিপি ছিলেন। পরে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে বিএনপির সাংসদ নির্বাচিত হন। ছাত্রজীবন থেকে তিনি রাজনীতিতে প্রতিভাবান ছিলেন।
৪. শামসুল হক টুকু
সত্তরের দশকে রাকসুর জিএস ছিলেন বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল হক টুকু। তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
৫. ফজলে হোসেন বাদশা
১৯৮০-৮১ শিক্ষাবর্ষে রাকসুর ভিপি ছিলেন তিনি। বাম রাজনীতির এই প্রবীণ নেতা বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগের সাথে জোট নির্বাচনে অংশ নিয়ে রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন।
৬. রুহুল কবির রিজভী
১৯৮৯-৯০ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ রাকসু নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রিজভী। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের সভাপতির দায়িত্ব পালনের পর কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র।
৭. রুহুল কুদ্দুস বাবু
১৯৮৯-৯০ সালের একই নির্বাচনে জেনারেল সেক্রেটারি (জিএস) পদে নির্বাচিত হন রুহুল কুদ্দুস বাবু। পরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি।
৮. নূরুল ইসলাম বুলবুল
তিনি ১৯৯০ সালে রাকসু নির্বাচনে শহীদ শামসুজ্জোহা হলের জিএস নির্বাচিত হন। পরে বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হোন এবং বর্তমানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নির্বাচিত আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সর্বোচ্চ ফোরাম কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ৩ আসনের জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, জাতীয় নেতৃত্ব গঠনের এই ঐতিহাসিক প্ল্যাটফর্মটি ৩৫ বছর পর আবারও সক্রিয় হচ্ছে ফলে একদিকে যেমন গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়বে, অন্যদিকে ভবিষ্যতের নেতৃত্বও গড়ে উঠবে এই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মাজিদুল ইসলাম বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রীয় প্লাটফরম হিসেবে রাকসু কাজ করলেও এর একটি জাতীয় আবেদন রয়েছে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতোপূর্বেও রাকসুর নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে ছিল। রাকসু বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে পলিটিক্যাল আউটপুট পাওয়ারও সম্ভাবনা তৈরি হবে। আর তাই জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির সূতিকাগার হতে পারে রাকসু।
এদিকে এবারের রাকসু নির্বাচনে ২৩টি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৩০৫ জন প্রার্থী। এর মধ্যে ভিপি পদে ১৮ জন ও জিএস পদে ৩৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সিনেট ছাত্রপ্রতিনিধি নির্বাচনের ৫টি পদে ৫৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ ছাড়া ১৭টি হল সংসদ নির্বাচনে ১৫টি পদে ৫৫৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অর্থাৎ তিন ক্যাটাগরিতে মোট ৮৬০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
নির্বাচনে মোট ১০টি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল আছে মাত্র দুটি–ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল। অন্যগুলো হলো: বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’, ছাত্র অধিকার পরিষদ ও ছাত্র ফেডারেশনের ‘রাকসু ফর রেডিক্যাল চেঞ্জ’, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন সমর্থিত ‘সচেতন শিক্ষার্থী পরিষদ’ ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) ‘অপরাজেয় ৭১, অপ্রতিরোধ্য ২৪’, সাবেক দুই সমন্বয়কের নেতৃত্বে ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’, নারী ভিপি প্রার্থীর নেতৃত্বে ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’, ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী জোট’ ও ‘ইনডিপেনডেন্ট স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স’।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি অ্যাকডেমিক ভবন ও ১৭ টি কেন্দ্রে সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
এ ছাড়া রাকসু ২৩ পদে ৩০৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন, সিনেটের ৫ পদে ৫৮ জন, ১৭ টি হলের ২৫৫ পদে ৫৫৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। মোট ভোটারের ২৮,৯০০ জন যার মধ্যে ৩৯.১ শতাংশ নারী এবং ৬.৯ পুরুষ শিক্ষার্থী। নির্বাচনে ৫১ জন পোলিং অফিসার থাকবেন।
নির্বাচন কমিশনার মোস্তফা কামাল আকন্দ বলেন, ঢাবি ও জাবির তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, সেগুলো যেন আমাদের প্রভাব না ফেলে তা আমরা দেখছি। যত দ্রুত সম্ভব নির্ভুল ফল প্রকশের চেষ্টা করব। বিকেল ৫টায় গননা শুরু হবে এবং সর্বোচ্চ ১৭ ঘন্টার মধ্যে ফল প্রকাশ করা হবে।