
সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিঘেরা দিনাজপুরের রাজনীতি ছিল সহনশীল ও শৃঙ্খল। বৈচিত্র্যময় ফসলের মাঠের মতো নানা মত-ধর্মের মানুষের বসবাস উত্তরের এই জেলায়। সামাজিক ও জাতীয় নানা ইস্যুতে চায়ের আড্ডায় উঠত বিতর্কের ঝড়।
তবে কখনো তার প্রভাব পড়ত না বন্ধনে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হিন্দু ভোটার থাকলেও নির্বাচনে ছিল না সাম্প্রদায়িকতা। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার পর সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়, শান্তির নগরী পরিণত হয় আতঙ্কের জনপদে। গ্রেপ্তারের ভয়ে ঘরে থাকতে পারতেন না ভিন্নমতের রাজনীতিকরা। গুম-খুন ও জঙ্গি নাটক সাজিয়ে অন্ধকার কুঠুরিতে আটকে রাখার ঘটনা ছিল নিত্যব্যাপার।
ফ্যাসিবাদ কায়েমের জন্য বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শত শত দিন কারাগারে কেটেছে তাদের। কেউ কেউ পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে বহু রাত জঙ্গলে ও নদীর ধারে কাটিয়েছেন। অনেককে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে খুন করা হয়েছে, ভাঙচুর করা হয়েছে বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। আলেম হলেই ধরে নিয়ে সাজানো হতো জঙ্গি নাটক। এভাবে দুর্বিষহ করে তোলা হয়েছিল দিনাজপুরের জনজীবন। এর সঙ্গে ছিল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বেপরোয়া দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, লুটপাট ও টেন্ডারবাজি।
বিএনপি ও জামায়াতের দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের পাঁচ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন হামলায় আহত হয়েছেন অন্তত তিন সহস্রাধিক। এছাড়া জামায়াতের ছয় নেতাকর্মীকে গুম করা হয়। বিএনপিরও অসংখ্য নেতাকর্মী আওয়ামী ক্যাডার বাহিনী ও পুলিশের হামলায় আহত হন।
বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে মামলা হয়েছে ছয় শতাধিক। এতে আসামি করা হয়েছে ৮০ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে। জামায়াত নেতাকর্মীদের নামে সবচেয়ে বেশি সাত শতাধিক মামলা হয়েছে। এতে আসামি করা হয়েছে লক্ষাধিক।
মামলা-হয়রানি করেই ক্ষান্ত থাকেনি আওয়ামী দুর্বৃত্তরা, দেড় দশকে বিএনপি ও জামায়াতের বহু নেতাকর্মীর বাসাবাড়ি, দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও আক্রমণ করা হয়েছে। অনেক স্থাপনা ভাঙচুরের পাশাপাশি দখল করে নিয়েছে। তাদের অত্যাচারে বছরের পর বছর বাড়িতে থাকতে পারেননি বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা। রাস্তাঘাটে, বনজঙ্গলে, ধানক্ষেতে, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে কাটিয়েছেন শত শত রাত। অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের কারণে সর্বস্বান্ত হয়েছেন।
দিনাজপুর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক জানান, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের নামে ১৩ শতাধিক গায়েবি ও রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। আসামি করা হয় পৌনে দুই লাখ নেতাকর্মীকে। জেলার নেতা থেকে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী-সমর্থককেও আসামি করা হয়। জুলাই বিপ্লবের পর আট শতাধিক মামলা প্রত্যাহারের জন্য তালিকা পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ২৫০টি প্রত্যাহার হয়েছে। অপর মামলাগুলো প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া কিছু মামলা বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তি হচ্ছে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে মামলার শিকার হয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির (রংপুর বিভাগ) সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও দিনাজপুর পৌরসভার তিনবারের মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম, জেলা বিএনপি সভাপতি অ্যাডভোকেট মোফাজ্জল হোসেন দুলাল, সাধারণ সম্পাদক (পদ স্থগিত) বখতিয়ার আহমেদ কচি, জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি মোকাররম হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান বাদশা, দিনাজপুর পৌর বিএনপি সভাপতি জিয়াউর রহমান, সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন মণ্ডল বকুল, জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি আবদুল মোন্নাফ মুকুল প্রমুখ।
অপরদিকে জেলা জামায়াতের আমির অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান, সাবেক আমির ও চিরিরবন্দর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দীন মোল্লা, সাবেক জেলা আমির ও কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম, জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মুহাদ্দিস ড. এনামুল হক, জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি রাজিবুর রহমান পলাশ, সাবেক জেলা সেক্রেটারি মাওলানা রবিউল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ভুট্টো ও তৈয়ব আলী, চিরিরবন্দরের জামায়াত নেতা মকবুল মুন্সি, খানসামা উপজেলা জামায়াতের আমির ও ইউপি চেয়ারম্যান কারী আবদুল হক সিরাজীসহ বহু নেতাকর্মী মামলার ঘানি টেনেছেন। কোনো কোনো নেতাকর্মী ৮-১১ বার পর্যন্ত জেল খেটেছেন।
এছাড়া শহর জামায়াতের আমির সিরাজুস সালেহীন, শহর জামায়াতের সাবেক নায়েবে আমির তোয়াব আলী মোল্লা, সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা মাওলানা মুজিবুর রহমান, দিনাজপুর শহর ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি, বর্তমানে দিনাজপুর-১ (বীরগঞ্জ-কাহারোল) আসনের জামায়াত মনোনীত এমপি পদপ্রার্থী মতিউর রহমান, ছাত্রশিবিরের সাবেক শহর সভাপতি সোহেল রানা এবং সাবেক শিবির নেতা আবদুল কাইয়ুম। বাদ যাননি জামায়াতের ১৩ উপজেলা আমিরও। তারা একাধিকবার জেল খেটেছেন।
তাদের মধ্যে আনোয়ারুলের নামে মামলা হয়েছে ২৮টি, জেল খেটেছেন একাধিকবার। অ্যাডভোকেট ভুট্টোর নামে মামলা হয়েছে ১৬টি। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে তৈয়ব আলীর নামেÑ৫২টি। উপজেলা পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে চিরিরবন্দরের মকবুল মুন্সির বিরুদ্ধেÑ৪১টি এবং সবচেয়ে বেশিদিন জেলও খেটেছেন তিনি। মকবুল মুন্সি বলেন, তার চার ছেলে, ছোট ভাই ও ভাইয়ের ছেলেসহ পরিবারের সাতজনের বিরুদ্ধে মোট ১৫৭টি মামলা হয়েছে। তাকে একাধিকবার গুমও করা হয়েছিল।
এ পর্যন্ত জামায়াত নেতাদের দুই শতাধিক মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে আর রাজনৈতিক মামলা হিসেবে প্রত্যাহার হয়েছে দুই শতাধিক।
বিএনপি নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলার শিকার হয়েছেন বখতিয়ারÑ৭৩টি। তিনি সবচেয়ে বেশি সময় জেলও খেটেছেন। জিয়াউরের নামে ২৭টি মামলা হয়েছে; তিনি আটবারে ১১ মাস জেল খেটেছেন। বিএনপি নেতা মহিউদ্দিন মণ্ডল বকুলের নামে ৪৭টি মামলা হয়েছে। বকুল বলেন, তিনি চার দফায় ১৭ মাস জেল খেটেছেন এবং ৩৭ মাস আত্মগোপনে ছিলেন।
এছাড়া জেলা বিএনপির সহসভাপতি সোলায়মান মোল্লার নামে ২৭টি মামলা হয়েছে। তিনি পাঁচবারে ১১ মাসের বেশি সময় জেল খেটেছেন। চব্বিশের ৫ আগস্টের পর তিনি মুক্তি পান। তিনি জানান, তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুট করা হয়েছে। সব শেষে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ও তার বাসায় অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এতে তার অর্ধকোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
আনিসুর রহমানের নামে মামলা হয়েছে ২১টি। একনাগাড়ে এক বছর ১৪ দিনসহ ১১ বার জেল খেটেছেন তিনি। এছাড়া যুবদল নেতা মুকুলের নামে মামলা হয়েছে ৩৭টি; তিনি জেল খেটেছেন আটবারে প্রায় ১০ মাস। বিরলের ধর্মপুর ইউপি চেয়ারম্যান নুর ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৩২টি।
জেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মিজানুর রহমান সাজুর নামে মামলা হয়েছে ১৭টি। তিনি টানা ছয় মাসসহ একাধিকবার জেল খেটেছেন। মিজানুর রহমান সাজু বলেন, আমার ছোটখাটো ব্যবসা ছিল। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা সেখানে ভাঙচুর, লুটপাট করে পুড়িয়ে দিয়েছে। এতে ১০-১২ লাখ টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এখন আমি সর্বস্বান্ত প্রায়।
জামায়াতের মিছিল-মিটিংয়ের ছবি তোলার অপরাধে ফটোসাংবাদিক নুর ইসলামকে দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার তৎকালীন ওসি জিলানী ও ডিবির ওসি রেদওয়ানুর রহিমের নেতৃত্বে একদল পুলিশ মধ্যরাতে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। পরে তার নামে নাশকতার চার মামলা দেওয়া হয়। এসব মামলায় চার মাস জেল খাটেন তিনি।
মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে মৃত্যু
বিএনপি-জামায়াতের ডজনখানেক নেতাকর্মী একাধিক মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে মারা গেছেন। তাদের মধ্যে আছেন খানসামা উপজেলা জামায়াতের আমির কারী আবদুল হক সিরাজী, বীরগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের আমির ও পৌরসভার সাবেক মেয়র মাওলানা মোহাম্মদ হানিফ, দিনাজপুর শহর জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা আবদুল মাতিন, নবাবগঞ্জ উপজেলা আমির ডা. আবুল কাশেম সরকার, জেলা কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা খোদা বখশ, কাহারোল উপজেলা আমির আবদুল গনি, চিরিরবন্দরের জামায়াত নেতা মাওলানা আতাউল্লাহ সরকার ও দিনাজপুর পৌর বিএনপির সাবেক সহসভাপতি সিরাজ আলী সরকার।
আওয়ামী আমলে দমন-পীড়ন
চিরিরবন্দর উপজেলার রানীরবন্দরে ২০১৩ সালে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর মামলার রায়ের প্রতিবাদে জামায়াতের মিছিলে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের হামলায় দলটির অসংখ্য নেতাকর্মী গুরুতর আহত হন। ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা হরতাল-অবরোধের সময় বহু নেতাকর্মী হামলা ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। অনেক নেতাকর্মীর বাসায় হামলা ও লুটপাট করা হয়েছে। অনেকের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে দিনাজপুর শহরের বিভিন্ন মেস এবং বাড়ি থেকে ছাত্রশিবির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমনও হয়েছে যে, প্রকাশ্য দিবালোকে শূন্য হাতে আটকের পর বোমার বস্তা আবিষ্কারের নাটক করা হয়েছে।
গুম ও খুনের শিকার যেসব নেতাকর্মী
আওয়ামী আমলে দিনাজপুরে জামায়াত-শিবিরের পাঁচ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। তারা হলেন খানসামায় ছাত্রশিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলাম, চিরিরবন্দরের শিবির নেতা মতিয়ার রহমান, বীরগঞ্জের ভুল্লির হাটের সালাহউদ্দিন, একই উপজেলার শিবরামপুর ইউনিয়নের মিলনপুরের আসাদুজ্জামান ও জামায়াতকর্মী ফয়জুল ইসলাম।
এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে জামায়াত-শিবিরের ছয় নেতাকর্মী গুম হয়েছিলেন। তারা হলেন তৎকালীন জেলা জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি তৈয়ব আলী, ঘোড়াঘাট উপজেলা জামায়াতের কর্মী গালিবুর রশিদ, হাকিমপুরের আবু নাঈম, মো. মাকতুম, চিরিরবন্দরের মকবুল মুন্সি ও পার্বতীপুর উপজেলার মাওলানা আতিউল্লাহ। পরে তাদের জঙ্গি আখ্যা দিয়ে নাশকতা ও সন্ত্রাসবিরোধী মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সাত-আট বছর পর্যন্ত জেল খেটে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তবে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারকে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। মুক্তিপণের নামে তাদের কাছ থেকে ১০-১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
গুমের শিকার পার্বতীপুর উপজেলার জামায়াতকর্মী ও জাহানাবাদ মণ্ডলপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আতিউল্লাহ সরকার বলেন, ২০১৭ সালের ২৩ জুন রমজান মাসে মসজিদে তারাবির নামাজ আদায়ের সময় ১৫-১৬ জন সাধারণ পোশাকে মসজিদে ঢুকে তাকে বের করে নিয়ে মাইক্রোবাসে তোলেন। গাড়িতে ওঠানোর পর হাতে হাতকড়া লাগিয়ে ও কালো কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধা হয়। একের পর এক অদ্ভুত প্রশ্নের সঙ্গে চলে শারীরিক নির্যাতন।
তিনি আরো বলেন, অজ্ঞাত স্থানে বন্দি রেখে প্রতিদিন পেটানো হতো। বৈদ্যুতিক শকও দেওয়া হয়। ছয় মাসের অধিক সময় সেখানে রাখার পর ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি রাতে রাজশাহীর রাজপাড়া থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে র্যাব-৫-এর এসআই সোহেল বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে রাজশাহী কারাগারে পাঠানো হয়। চার বছর পর ২০২২ সালের ১৪ মার্চ আদালতের মাধ্যমে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্তি পান তিনি। এর মধ্যে তার শিক্ষাজীবন ধ্বংস হওয়াসহ শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হন। পরিবার থেকে বিভিন্ন জায়গায় সন্ধান করতে গিয়ে এবং মামলার পেছনে খরচ করে নিঃস্ব হয়ে যান পরিবারের সদস্যরা।
তিনি জানান, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালানোর পর ওই বছরের ২৩ অক্টোবর সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, র্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীরসহ ১৮ জনের নামে দিনাজপুর জেলা জজ আদালতে মামলা করেন মাওলানা আতিউল্লাহ। সেটি বর্তমানে বিচারাধীন।
বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীর বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা
বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীর ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দলীয় কার্যালয়ে দফায় দফায় হামলা, ভাঙচুরসহ অগ্নিসংযোগ করেছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হামলা করত পুলিশ। বিএনপির জেলা কার্যালয় বন্ধ না করলেও ২০১২ সালের পর থেকে দিনাজপুর জেলা জামায়াত কার্যালয়সহ সবকটি উপজেলা কার্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর জামায়াতের সব কার্যালয় পুনরায় খোলা হয়।
এছাড়া থানায় মামলার নথি দেখে পুলিশের সহায়তায় চাঁদাবাজি করত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। তারা বিভিন্ন মামলার আসামি জামায়াত নেতাকর্মীর বাসায় গিয়ে টাকা চাইত। চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দেওয়ায় তাদের হয়রানি করা হতো এবং পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তারের ভয়ভীতি দেখানো হতো। তাদের মধ্যে অন্যতম বীরগঞ্জ উপজেলার শতগ্রাম ইউনিয়নের রাঙ্গালীপাড়ার মো. মিঠুর ছেলে এলিন আহমেদ। ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদের প্রভাব দেখিয়ে চাঁদাবাজি করত সে।
অন্যদিকে অনেক পুলিশ সদস্যও নিয়মিত চাঁদাবাজি করত বলে বেশ কজন ভুক্তভোগী জানিয়েছেন।
নাশকতা ও জঙ্গি নাটক
তথাকথিত নাশকতা ও জঙ্গি নাটক সাজিয়ে রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ অনেক নিরীহ মানুষকে ফাঁসিয়েছে পুলিশ ও র্যাব। বিনা অপরাধে আটক রাখা হয় বছরের পর বছর। সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে গুম করে বিভিন্ন অস্ত্র, বোমাসদৃশ বস্তুসহ হাজির করে গ্রেপ্তার দেখানো হতো। অনেককে ক্রসফায়ারের হুমকিও দেওয়া হয়। হাতিয়ে নেওয়া হয় লাখ লাখ টাকা। ফেরত দেওয়া হয়নি আটক নেতাকর্মীর কাছ থেকে জব্দ করা মোটরসাইকেল, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, ঘড়ি, নগদ টাকাসহ বহু মূল্যবান জিনিসপত্র।
এছাড়া জামায়াত নেতাকর্মীর বাড়িতে বেড়াতে আসা আত্মীয়-স্বজনদের নাশকতা ও জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে পুলিশ ধরে নিয়ে জেলে পাঠিয়েছে। বিশেষ করে জামায়াতের কোনো নেতাকর্মীর বাড়িতে আসা বয়স্ক, দাড়িওয়ালা ও পাঞ্জাবি-টুপি পরা মানুষ দেখলেই পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে নাশকতার মামলা দিত।
২০১৬ সালের আগস্টে সদর উপজেলার ঝানঝিরা গ্রামে দিনাজপুর শহর ছাত্রশিবিরের একটি অনুষ্ঠান থেকে সংগঠনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রকল্যাণ সম্পাদক মুনিরুজ্জামান শামিম, শহর শিবিরের নেতা আসাদুজ্জামান আসাদ ও শাহিনুর ইসলামকে আটক করে পুলিশ। আটকের তিনদিন পর দিনাজপুর জেলা শহরের রামনগর মদিনা মসজিদের পাশে খোলা মাঠে এক ব্যাগ বোমাসহ কথিত নাশকতার পরিকল্পার অভিযোগে আটক দেখিয়ে তাদের জেলে পাঠায়। এ সময় কোতোয়ালি থানার তৎকালীন ওসি রেদওয়ানুর রহিমের নেতৃত্বে পুলিশ তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়।
দিনাজপুর জেলা শহরের পশ্চিম পাটুয়াপাড়া এলাকার সাবেক সেনা কর্মকর্তা হাফিজুর রহমানের ছেলে আবু সাঈদ ঢাকার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেওয়ার অপরাধে ২০১৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) একটি দল ঢাকা থেকে এসে আবু সাঈদকে দিনাজপুর শহরের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। এ ঘটনার আড়াই মাস পর ঢাকার একটি বাসা থেকে নাশকতা ও জঙ্গি হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলÑএমন অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। দীর্ঘ ছয় বছর জেল খেটে সে জামিনে মুক্তি পায়। কিন্তু পরে তার লেখাপড়া আর হয়নি।
২০১৬ সালের ৪ আগস্ট কাহারোলের দশমাইলে ছাত্রশিবিরের সাবেক জেলা উত্তর সভাপতি জাকিরুল ইসলামকে ভিক্টরি স্কুলে ক্লাস চলাকালীন সময়ে তাকেসহ ৯ শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের মধ্যে একজন হিন্দুও ছিলেন। তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্যদের দিয়ে জঙ্গি নাটক সাজিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়। এরপর দিনাজপুর-১ (বীরগঞ্জ-কাহারোল) আসনের তৎকালীন এমপি মনোরঞ্জন শীল গোপালের নির্দেশে পূর্ব মল্লিকপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা স্কুলে হামলা চালায় এবং স্কুলে অগ্নিসংযোগ করে। এতে স্কুলের বই, খাতা, প্রয়োজনীয় নথি ও আসবাবপত্র পুড়ে যায়। এতে স্কুলের প্রায় ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। পরে স্কুলের সব শিক্ষক ১৬৭ দিন পর জামিনে মুক্ত হলেও ওই নামে আর স্কুলটি চালু করা সম্ভব হয়নি।
২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর হরতালের সমর্থনে মিছিল করলে পুলিশের সহায়তায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। এতে গুরুতর আহত হন সে সময়ের শিবিরের উপজেলা সভাপতি আমিনুল ইসলামসহ অন্তত ৩০ জন। গ্রেপ্তার করা হয় শিবিরের জেলা সভাপতি জাকিরুল ইসলাম, সেক্রেটারি ময়নুল ইসলাম, উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি তরিকুল ইসলামসহ ১৭ জনকে।
আমিনুল ইসলাম বলেন, আমাকে যেভাবে পিটিয়েছিল, তাতে বাঁচার কথা ছিল না। কিন্তু আল্লাহ্ বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাই বেঁচে আছি। সে সময় সুচিকিৎসা না পাওয়ায় আমার পা আজও মাঝেমধ্যে ব্যথা করে। এছাড়া খানসামা উপজেলা ছাত্রশিবিরের সাবেক থানা সভাপতি শাহজালাল ২৮টি মামলা মোকাবিলা করে প্রথম বর্ষ থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন জেলখানায়।
আওয়ামী এমপি-মন্ত্রীদের নৈরাজ্য
দিনাজপুরের ছয়টি সংসদীয় আসনের ছয়জন এমপির মধ্যে এএইচ মাহমুদ আলী মন্ত্রী ও খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এ দুজনসহ ছয়টি আসনের এমপিরা পুলিশকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছেন। তাদের মধ্যে সাবেক হুইপ ইকবালুর রহিম, প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ, সাবেক এমপি মনোরঞ্জন শীল গোপাল, শিবলী সাদিক নিজ এলাকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সবচেয়ে বেশি হয়রানি করেছেন। এমনকি তারা নিজ দলের নেতাকর্মীদের পর্যন্ত হয়রানি করেছেন। জমি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করেননি। নিজ দলের কর্মিবাহিনী ও পুলিশকে ব্যবহার করে জেলার সর্বত্র ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তাদের দাপটে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তো বটেই, সাধারণ মানুষও সব সময় ভীতসন্ত্রস্ত থাকত। তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই হামলা-মামলার শিকার হতে হয়েছে।
দলবাজ প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তা
ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে প্রশাসনসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের আচরণ ছিল দলীয় নেতাকর্মীর মতো। তারা নিজেদের আওয়ামী লীগের বড় নেতা মনে করতেন। ওই সময় জেলায় কর্মরত ডিসি, এডিসি, এসপি, এএসপিসহ কোনো কর্মকর্তা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় বোঝার উপায় ছিল না যে, তারা সরকারি কর্মচারী বা জনগণের সেবক। তাদের আচরণ ছিল আওয়ামী সন্ত্রাসীদের মতো। গোটা জেলাকে তারা আতঙ্কের নগরীতে পরিণত করেছিলেন।
দিনাজপুরে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন ওসি খুবই ভয়ঙ্কর ছিলেন। তাদের মধ্যে কোতোয়ালি থানার ওসি ও পলাতক সাবেক হইপ ইকবালুর রহিমের আস্থাভাজন রেদওয়ানুর রহিম, বীরগঞ্জ থানার সাবেক ওসি শাকিলা পারভীন অন্যতম। শাকিলা অত্যাচার-নির্যাতনের রেকর্ড গড়ে শ্রেষ্ঠ ওসির পুরস্কার পেয়েছিলেন বলে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছেন। তাদের মধ্যে বেশি বিপজ্জনক ছিলেন রেদওয়ানুর রহিম।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ৯ জন
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দিনাজপুরে শহীদের সংখ্যা সরকারি হিসাবে ৯ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে ১০। তাদের মধ্যে সদর উপজেলার রানীগঞ্জ বিদুরশাহী গ্রামের মুসলেম উদ্দিনের ছেলে রবিউল ইসলাম রাহুল, শহরের পাহাড়পুর এলাকার অধ্যাপক সুবীর চন্দ্র সেনের ছেলে রুদ্র সেন, বীরগঞ্জের ডাবরা জিনেশ্বরী গ্রামের আবদুল ওয়াজেদের ছেলে আল আমিন সরকার, চিরিরবন্দরে লক্ষ্মীপুরের বাসুদেবপুর গ্রামের ওমর ফারুকের ছেলে সুমন পাটোয়ারী, বিরলের পাকুড়া গ্রামের জয়নাল আবেদীনের ছেলে আসাদুল হক বাবু, একই উপজেলার নাগরবাড়ী গ্রামের আবদুল কাফির ছেলে জিয়াউর রহমান, একই উপজেলার করলা গ্রামের মিজানুর রহমানের ছেলে মাসুম রেজা অন্তর, নবাবগঞ্জ উপজেলার নরহরিপুর গ্রামের ফরিদুল ইসলামের ছেলে আশিকুল ইসলাম ও পার্বতীপুর উপজেলার হাবড়া ইউনিয়নের মজিবুর রহমানের ছেলে মো. শিমুল।
তবে বেসরকারি হিসাবে দিনাজপুরে শহীদের সংখ্যা ১০। জেলা জামায়াত অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দিনাজপুরে শহীদের সংখ্যা ১০ জন উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে দিনাজপুরে তিনজন, সিলেটে একজন ও ঢাকায় ছয়জন শহীদ হন।
জেলা বিএনপি সভাপতি অ্যাডভোকেট দুলাল আমার দেশকে বলেন, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে মিলে নেতাকর্মীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিএনপিকে দলীয় কর্মসূচি পালন করতে দেয়নি তারা। কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখা হতো। বিভিন্ন সময় রাতের আঁধারে নেতাকর্মীদের বাড়িতে হানা দিয়ে গ্রেপ্তারের নামে হয়রানি করা হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে কোনো নেতাকর্মীকে বাড়িতে থাকতে দেয়নি। পুলিশের ভয়ে নেতাকর্মীরা বন-জঙ্গলে ও ধানক্ষেতে বহু রাত কাটিয়েছেন।
জেলা জামায়াত আমির অধ্যক্ষ আনিসুর আমার দেশকে বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চেয়েছিলেন। জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীর নামে মামলা-হামলা ছিল নিত্যব্যাপার। ১৩ বছর কার্যালয়গুলো খুলতে দেয়নি। নির্ভয়ে কেউ বাইরে বেড়াতে পারেননি, বাসায়ও ঘুমাতে পারেননি। কোনো কর্মসূচির খবর পেলেই নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের ধুম পড়ে যেত। যেখানে যত সম্পদ পেয়েছে, সব লুট করে নিয়েছে। অন্তত ১০টি মোটরসাইকেলও আত্মসাৎ করা হয়েছে।