Image description

দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন অপরাধে অভিযুক্ত পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সাবেক সামরিক সচিব মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ । গত ৯ অক্টোবর তিনি বিশেষ ব্যবস্থায় তামাবিল সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। জেনারেল কবীর এখন কলকাতার নিউ টাউন এলাকায় সনজীবা গার্ডেন কমপ্লেক্সে সপরিবারে অবস্থান করছেন। ঢাকা এবং কলকাতার নিরাপত্তা সূত্রগুলো আমার দেশকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

জেনারেল কবীরের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পক্ষ থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর তিনি কোথায় আছেন তা নিয়ে যখন ব্যাপক আলোচনা চলছে ঠিক সেই মুহূর্তে আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে তার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। সেনা সদরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে জেনারেল কবীরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী জেনারেল কবীরের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন। আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, জেনারেল কবীর ভারতে পালিয়ে গিয়েছে এবং ভারত তাকে আশ্রয় দিয়েছে। ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সবকিছু করবে, এটা আমরা জানি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাকে যারা পালাতে সহযোগিতা করেছে তাদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

এখানে কোনো কোনো উপদেষ্টার নাম শোনা যাচ্ছে যারা জেনারেল কবীরকে পালাতে সাহায্য করেছে। এটা দ্রুত তদন্ত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, এখানে সেনাবাহিনীর দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। একজন সার্ভিং জেনারেল কীভাবে পালাতে পারে তার জবাব সেনাবাহিনীর দিতে হবে। আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর। সেই সেনাবাহিনীর জেনারেলরা যদি অন্য দেশের এজেন্ট হয়ে কাজ করে তাহলে তো আর বলা যায় না আমাদের একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র আছে।

একজন সার্ভিং বা কর্মরত জেনারেল কীভাবে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতের মতো বৈরী প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নিতে পারল তা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন এবং উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এর আগে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, সাবেক আমলা, পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে এই প্রথমবারের মতো সার্ভিং কোনো জেনারেলের দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার খবর পাওয়া গেল। বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুতর এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখছেন আন্তর্জাতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত হওয়া উচিত। কারণ এটা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এর পেছনে যে বাংলাদেশের কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠীর পাশাপাশি ভারতের হাত রয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যারা জেনারেল কবীরকে পালাতে সাহায্য করেছে তাদের তদন্তের

মাধ্যমে চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। জেনারেল কবীরের বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেওয়ার বিষয়ে অবগত কলকাতার একটি নিরাপত্তা সূত্র আমার দেশকে জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত থেকে গুমের দায়ে অভিযুক্ত সেনাকর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হতে পারে তা আগে থেকেই আঁচ করছিলেন জেনারেল কবীর। তিনি গত একমাস ধরে কলকাতা যাওয়া-আসার মধ্যে ছিলেন।

তিনি সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে একবার কলকাতায় আসেন এবং বেশ কয়েকদিন থেকে আবার বাংলাদেশে ফিরে যান। ওই সময় তিনি কলকাতার বারাসাত এবং নিউ টাউন এলাকায় অবস্থান করেন। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর গত ৯ অক্টোবর জেনারেল কবীর তামাবিল সীমান্ত দিয়ে আবার ভারতে প্রবেশ করেন। এখন তিনি কলকাতার নিউ টাউন এলাকার সানজিবা গার্ডেন কমপ্লেক্সে পরিবার নিয়ে অবস্থান করছেন। কলকাতার নিরাপত্তা সূত্রগুলো আরো জানিয়েছে, এর আগে পালিয়ে যাওয়া আরেক সেনাকর্মকর্তা লে. জে. (অব.) আকবর হোসেনও সানজিবা গার্ডেনে সপরিবারে অবস্থান করছেন। তবে এখানে অন্য আর কোনো জেনারেল আছেন কি না তা জানাতে পারেনি ওই সূত্রগুলো। উল্লেখ্য, সানজিবা গার্ডেন কলকাতার অভিজাত শ্রেণির বসবাস। বহুল আলোচিত খুন হওয়া আওয়ামী লীগের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারও এই সানজিবা গার্ডেনে ভাড়া ছিলেন এবং সেখানেই তিনি ‍খুন হন।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ আমলের গুমের ঘটনায় দুটি মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত ৮ অক্টোবর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৮ জনকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করেন। তাদের মধ্যে ২৫ জনই সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। এদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিলেন জেনারেল কবীর। পরোয়ানা জারির দিনই তা সংশ্লিষ্ট ১৩টি দপ্তরে পাঠানোর কথা জানিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১-এর কর্মকর্তারা।

এদিকে গত ১১ অক্টোবর ঢাকা সেনানিবাসের মেসে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান জানান, মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদকে ‘ইলিগ্যালি অ্যাবসেন্ট (অবৈধভাবে অনুপস্থিত)’ হিসেবে ঘোষণা করেছে সেনাবাহিনী। তিনি যেন বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারেন, সেজন্য তাকে ধরতে সব সীমান্তে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। জেনারেল কবীর আহাম্মদের বিরুদ্ধে জয়েন্ট ইন্টেরোগেশন সেলে (জেআইসি) ভুক্তভোগীদের বন্দি রেখে নির্যাতনের মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত।

তিনি বলেন, ‘মেজর জেনারেল কবীর না জানিয়ে অবৈধভাবে ছুটিতে গেছেন। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।’ জেনারেল হাকিমুজ্জামান আরো বলেন, ‘জেনারেল কবীর ৯ অক্টোবর সকালে বাসা থেকে বের হয়েছেন। এর পর থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ডিজিএফআই, এনএসআই ও বিজিবিকে বলা হয়েছে যেন তিনি দেশত্যাগ করতে না পারেন।’ তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী সংবিধান স্বীকৃত বাংলাদেশের সব আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।’

গুমের মতো মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত মেজর জেনারেল কবীর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। গত বছর জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকসের কমান্ড্যান্টের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। সবশেষ গত ২১ সেপ্টেম্বর তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২৪ লং কোর্সের আলোচিত এই জেনারেল গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে সামরিক বিমানে করে ভারতে যান এবং ফিরে আসেন। গত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় খুনি মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এবং কদমবুচি জেনারেল হিসেবে পরিচিত মেজর জেনারেল মাহবুব রশিদের কোর্সমেট হওয়ার সুবাদে ডিজিএফআই-এর সিটি আইবিতে পোস্টিং দেওয়া হয় জেনারেল কবীরকে। পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিবের পদ লাভ করেন তিনি। জেনারেল জিয়া, মাহবুব এবং কবীর একত্রে গুম-নির্যাতনের পাশাপাশি নানা দুর্নীতি ও নানা অপরাধে যুক্ত হন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আসাদ নামে এক কোর্সমেটকে সামনে রেখে একটি ডেভেলপার কোম্পানির সহযোগিতায় ভাষানটেক, ইসিবি চত্বর এবং মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় জমি কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত হন। জেনারেল কবীর বিভিন্ন জনকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে কম দামে জমি ক্রয় করে পরবর্তী সময়ে বেশি দামে বিক্রি করে এবং বিভিন্ন ডেভেলপিং ব্যবসায় নিয়োজিত হয়। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনাল (BUP)-এর কাছে তারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা শতাংশ কিনে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকায় বিক্রির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। নেত্রকোনার বাসিন্দা জেনারেল কবীর গত জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় বিভিন্ন জিওসিকে মোবাইলে ফোন করে ছাত্রদের উপর নির্বিচারে গুলি করার জন্য শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে নির্দেশ প্রদান করে।

বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক প্রফেসর এম শহীদুজ্জামান জেনারেল কবীরের পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি আখ্যা দিয়ে আমার দেশকে বলেন, জেনারেল কবীর যদি সত্যিই ভারতে পালিয়ে গিয়ে থাকেন তাহলে সেটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তো বলা হলো জেনারেল কবীর যেন পালাতে না পারে সে জন্য বিমানবন্দরসহ সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তাহলে তিনি কীভাবে পালালেন, এই প্রশ্নের জবাব তো কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সঠিক তদন্ত হতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের জেনারেলরা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে এবং ভারত তাদের আশ্রয় দিচ্ছে, এটা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। ভারত আসলে উসকানি দিচ্ছে। ভারত চাইছে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে। ভারতে যেসব জেনারেল আশ্রয় নিচ্ছে তারা যে ভারতের হয়ে এখানে নানা ধরনের অপরাধ করেছে তা এখন প্রমাণিত। অপরাধী জেনারেলদের ভারত যে আশ্রয় দিচ্ছে সে বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশি বেশি তুলে ধরার আহ্বান জানিয়ে এই বিশ্লেষক বলেন, বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির ওপর জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেকেই নজর রাখছে। সরকারের দায়িত্ব হলো বিষয়টি ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরা এবং এসব অপরাধীর যে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সেই বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে দ্রুত শেষ করা। এটা করতে পারলে ভারত তখন আন্তর্জাতিকভাবে চাপে পড়বে।

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী জেনারেল কবীরের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন। আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, জেনারেল কবীর ভারতে পালিয়ে গিয়েছে এবং ভারত তাকে আশ্রয় দিয়েছে। ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সবকিছু করবে, এটা আমরা জানি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাকে যারা পালাতে সহযোগিতা করেছে তাদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। এখানে কোনো কোনো উপদেষ্টার নাম শোনা যাচ্ছে যারা জেনারেল কবীরকে পালাতে সাহায্য করেছে। এটা দ্রুত তদন্ত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, এখানে সেনাবাহিনীর দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। একজন সার্ভিং জেনারেল কীভাবে পালাতে পারে তার জবাব সেনাবাহিনীর দিতে হবে। আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর। সেই সেনাবাহিনীর জেনারেলরা যদি অন্য দেশের এজেন্ট হয়ে কাজ করে তাহলে তো আর বলা যায় না আমাদের একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র আছে।