
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আমলাতন্ত্রকে ‘জামায়াতীকরণ’ করা হচ্ছে- বিএনপির কাছে এমন তথ্য রয়েছে বলে জানা গেছে। দলটির তথ্য মতে, শুধু আমলাতন্ত্র নয়, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগে প্রিসাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইসলামী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা, কৃষি কর্মকর্তা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান থেকে যাদের বাছাই করা হচ্ছে, তাদেরও বড় অংশ জামায়াতপন্থি। এমনটা হলে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বড় প্রশ্ন দেখা দেবে। এই অবস্থায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাসহ নিরপেক্ষ প্রশাসন চায় বিএনপি। এ জন্য শিগগির প্রধান নির্বাচন কমিশন ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে দলটির উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল। সেখানে বিষয়গুলো প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করার পাশাপাশি তাদের উদ্বেগের কথাও জানানো হবে।
গত সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শেষে এমন সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। বৈঠক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জানা গেছে, নির্বাচন সামনে রেখে চলতি অক্টোবরের মধ্যেই ‘ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার প্যানেল’ প্রস্তুত রাখতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ লক্ষ্যে গত ২ সেপ্টেম্বর সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়Ñ আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার
নিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় প্যানেল প্রস্তুত করতে হবে। এ জন্য সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক-বীমা থেকে শ্রেণি বা গ্রেডভিত্তিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা সংগ্রহ করতে হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে এই চিঠির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, নেতাদের অভিমত, সারা দেশে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার যে প্যানেল প্রস্তুত করা হচ্ছে, সেটির অধিকাংশ কর্মকর্তা ছাত্রজীবনে ছাত্রশিবির এবং বর্তমানে জামায়াতপন্থি। এমনটা হলে নির্বাচনে তাঁরা একটা বিশেষ দলকে বিজয়ী করতে ভূমিকা রাখতে পারে। এতে করে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই সতর্কভাবে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে যাতে এই তালিকা প্রণয়ন করা হয়, সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়- এ লক্ষ্যে শিগগির দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাবে। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা চায় দলটি।
বৈঠকে সূত্রে জানা যায়, দলটির নেতারা মনে করছেন, কিছু উপদেষ্টার বক্তব্য, তৎপরতা ও কার্যক্রমে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল-পদায়ন নিয়ে কিছু উপদেষ্টা পক্ষপাতমূলক আচরণও করছে, বিশেষ করে জামায়াতের পক্ষে কাজ করছে।
বিএনপির ভূমিকা রাখা উচিত : স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এক নেতা বলেন, তিনি সম্প্রতি একটি মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন। সেখানকার একজন কর্মকর্তা বলেছেনÑ বিএনপির কোনো লোকজন তেমন সচিবালয়ে আসেন না। অথচ, জামায়াতসহ কিছু দলের নেতাদের পক্ষ থেকে পদায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক চাপ সহ্য করতে হচ্ছে তাঁদের। দেশের বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখা দরকার। বৈঠকে ওই কর্মকর্তার বক্তব্য নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
বৈঠক বিষয়ে জানতে চাইলে একাধিক নেতা বলেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনসহ সর্বত্র নিয়োগ অথবা পদায়নের ক্ষেত্রে জামায়াত হস্তক্ষেপ করছে। ফলে নিরপেক্ষ প্রশাসন সাজাতে সরকারের জন্য এটা বড় বাধা। তাই, ইতালি সফরত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে ফিরলে তাঁর সঙ্গে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল সাক্ষাৎ করবে। পাশাপাশি প্রধান নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবে বিএনপি।
প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গভর্নিং বডি নিয়ে উদ্বেগ : বৈঠকে আলোচনা হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি ভেঙে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত ভালোভাবে নেয়নি বিএনপি। এ বিষয়ে দলটির বেশ আপত্তিও আছে। বিএনপি নেতারা মনে করেন, জামায়াতের চাহিদা অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য বিএনটিকে ঘায়েল করা।
বিএনপি মনে করছে, ৫ আগস্টের পর প্রশাসনিক যে রদবদল বা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে, সেখানে একটি দলের লোকজনকে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপি নেতারা। তাঁরা বলেছেন- নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনিক যে নিরপেক্ষতা, সেটা সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা মনে করছেন, বিগত ১৭ বছরের যে ফ্যাসিবাদী সরকার, তাদের যে প্রশাসন, সেখান থেকে তাদের লোকজনকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে সরানো হয়নি; একই সঙ্গে আরও একটি বিশেষ দলের লোকজনকেও নতুন করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসানো হয়েছে।
সরকারে তত্ত্বাবধায়ক বৈশিষ্ট্য দরকার : বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদসহ সাংগঠনিক নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, যেহেতু নির্বাচন আসন্ন এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন করা সরকারের লক্ষ্য; সুতরাং সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত, নিজেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে সাজানো, যাতে প্রশাসনিক বা সিদ্ধান্ত গ্রহণমূলক কোনো কাজ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে।
সনদ স্বাক্ষরে প্রস্তুত : বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী ১৭ অক্টোবর সনদ স্বাক্ষরের দিন গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দেবে। আর দলের পক্ষ থেকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বহুল আলোচিত জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবেন।
একক প্রার্থী ও প্রচার নিয়ে আলোচনা : নির্বাচন সামনে রেখে গণসংযোগ প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা হয়েছে বৈঠকে। বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে প্রচার-প্রচারণায় ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করছে দলটি। এ ক্ষেত্রে প্রচারণায় কীভাবে আরও গতি আনা যায়, দলের মিডিয়া সেল ও কমিউনিকেশন সেলকে কীভাবে আরও সক্রিয় করা এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাজে লাগানো যায়, সেটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া সামাজিক মাধ্যমে নানামুখী অপপ্রচার রোখা এবং নতুন নতুন ন্যারেটিভের মাধ্যমে এসব অপপ্রচার মোকাবিলা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে বিভিন্ন আসনে দলের একাধিক সম্ভাব্যপ্রার্থী এবং তাঁদের বাদনুবাদের বিষয়টি ভালোভাবে দেখা উচিত বলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে পরামর্শ দেন নেতারা। এমনটা চলতে থাকলে এর সুযোগ অন্য রাজনৈতিক দল নিতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা।