
দলীয় নেতাদের বিব্রতকর ছবি, ভিডিও ও অডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানোর বিষয়টি বিএনপিকে বেশ ভাবাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকায় দলটির নেতারা মনে করছেন, এটি সংঘবদ্ধ অপপ্রচার। শুরুতে এই সাইবার আক্রমণকে আমলে না নিলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির শীর্ষ নেতারা এখন নড়েচড়ে বসেছেন।
নেট দুনিয়ার অপপ্রচার থেকে রেহাই পাওয়ার পাশাপাশি করণীয় ঠিক করতে পুরো বিষয় নিয়ে দলের ভেতর বিস্তর পর্যালোচনা চলছে। তবে দলীয় তহবিল না থাকায় গুজব প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না বিএনপি। সঙ্গে রয়েছে সমন্বয়হীনতা। ভার্চুয়াল জগতে বিএনপির উপস্থিতি খুব একটা না থাকায় নির্বাচনের আগে দলটির বিরুদ্ধে অপপ্রচার আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, সালাহউদ্দিন আহমেদ থেকে শুরু করে দলের সক্রিয় নেতাকর্মী কেউ অপপ্রচার থেকে রেহাই পাননি। ব্যঙ্গ ফটোকার্ড থেকে শুরু করে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো, বিভিন্ন ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে। এতে বিভ্রান্ত হয়ে দলের অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতেও দেখা গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী সমকালকে বলেন, আগে মানুষ মূলধারার সংবাদের ওপর ভরসা করত। এখন সামাজিক মাধ্যমে মানুষ ঝুঁকেছে। সেখানে নানা অপপ্রচার হয়ে থাকে। এটিকে এখন হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে এআই প্রযুক্তি তো আরও ভয়ংকর। এই অপকৌশলকে এখনই রোধ করতে হবে, না হলে আগামী নির্বাচনের আগে এটি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, যার মাধ্যমে নির্বাচনী পরিবেশ হুমকিতে পড়তে পারে। তাই সাইবার আক্রমণ বন্ধে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে এখন থেকেই কাজ করতে হবে।
ডিজিটাল যুগে এখন সবার হাতে হাতে স্মার্ট মোবাইল ফোন। ইন্টারনেটও সহজলভ্য। বাস্তবতা ছেড়ে মানুষ আস্তানা গেড়েছে সামাজিক মাধ্যমে। চারপাশে কী ঘটছে, তা তাৎক্ষণিক পেয়ে যাচ্ছে সবাই। বাংলাদেশে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ মানুষের রয়েছে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। দেশে বর্তমানে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা পাঁচ কোটি থেকে ছয় কোটি। ইউটিউবে দর্শক সংখ্যা তিন কোটির বেশি। এর মধ্যে জেন-জি বা তরুণদেরই প্রাধান্য।
জামায়াত-শিবিরকে বেশি দায়ী করছে বিএনপি
বিএনপির আইটি সেল দাবি করছে, তারা বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে এবং দীর্ঘদিন পর্যালোচনা করে দেখেছে, বিএনপির বিরুদ্ধে ৭০ শতাংশ (আওয়ামী লীগ ও জামায়াত আলাদাভাবে) গুজব ছড়ানো হচ্ছে ভারত থেকে। এ ছাড়া ১৫ শতাংশ উত্তর কোরিয়া, ১০ শতাংশ পাকিস্তান, তুরস্ক (জামায়াত-শিবির) এবং বাকি ৫ শতাংশ রাশিয়া, চীন, বাংলাদেশসহ অন্য দেশ থেকে। এসব দেশে অর্থের বিনিময়ে ডিজিটাল মার্কেটিং মেথড ব্যবহার করে গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
দলটির আইটি সেলের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সাধারণত গুজব ফেসবুক, নিউজ ফিড আর ইনবক্সের মাধ্যমে ছড়ানো হয়। যারা এসব জায়গায় পোস্ট শেয়ার করে, তারা হয়তো ম্যানুয়ালি ঘণ্টায় ১০ হাজার মানুষের কাছে একটি মেসেজ পাঠাতে পারে। তবে অপপ্রচারকারীরা উন্নত সফটওয়্যার ব্যবহার করে তা কয়েক লাখ মানুষের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হচ্ছে। তারা সামাজিক মাধ্যমে ‘বট বাহিনী’ তৈরি করে অটোমেটিক কমেন্টস, লাইক দিয়ে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলছে।
বিএনপির আইটি সেলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গুজব, তথ্যের বিকৃতি, ভুয়া সংবাদ ছড়ানো পুরোনো অপকৌশল। বিগত ফ্যাসিবাদ সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিএনপির বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালিয়েছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এ কাজ এখন বেশি করছে জামায়াত-শিবির। এ কাজে তারা খুবই এক্সপার্ট। তাদের প্রত্যেক সদস্যের একাধিক আইডি রয়েছে। এর মাধ্যমে সম্মিলিত আক্রমণ করা হয়।
বিএনপির তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান এ্যাপোলো সমকালকে বলেন, মানুষের মনে যখন বারবার একই ধরনের নেতিবাচক তথ্য প্রবেশ করে, তখন তারা সত্য-মিথ্যার বিভাজন করার ক্ষমতা হারায়। দীর্ঘ মেয়াদে এই নেতিবাচক তথ্যের পুনরাবৃত্তি ব্যক্তিরা বিশ্বাস করতে শুরু করে। একে ‘ইল্যুশন অব ট্রুথ এফেক্ট’ বলা হয়, যেখানে মিথ্যা তথ্য বারবার শুনলে মানুষ সেটিকে সত্য বলে মনে করে।
অপপ্রচারের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, দেশের মানুষ এখন অনেক সচেতন। তারা অনেক কিছু জানতে চায়। এ জন্য সামাজিক মাধ্যমে তারা সক্রিয়। এটিকে টার্গেট করে পতিত স্বৈরাচারের দল ছাড়াও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরোধীরা বিএনপির বিরুদ্ধে সাইবার আক্রমণ করছে। প্রতিনিয়ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে একটি শ্রেণি গুজব তৈরি করছে। এ অপপ্রচারের জবাব দিতে সামাজিক মাধ্যমে সবাইকে সক্রিয় থাকতে হবে। সত্য তুলে ধরতে হবে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে রাখার সুযোগ নেই। বরং জামায়াতের বিরুদ্ধেই অপপ্রচার হচ্ছে। জামায়াতের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সেটি যদি বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে করে তাহলে তা প্রমাণ করতে হবে। যদি প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে জামায়াত ব্যবস্থা নেবে।
আর্থিক সংকট, রয়েছে সমন্বয়হীনতা
বিএনপির আইটি সেলের কর্মকর্তারা জানান, বিএনপির বিরুদ্ধে গুজব ছড়াতে এই খাতে প্রতি মাসে ছয় কোটি থেকে আট কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। বিপরীতে বিএনপি আছে আর্থিক দৈন্যে। আইসিটি সেলের এক সদস্য জানান, এমন কাল্পনিক গুজব প্রতিরোধে ব্যাপক কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি পর্যাপ্ত অর্থ ও দক্ষ জনবলের প্রয়োজন। বিএনপির এ বিষয়ে দক্ষ টিম থাকলেও প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে পারছেন না শুধু আর্থিক সংকটের কারণে। এ খাতে বিএনপির কোনো বাজেট নেই। তারা আক্ষেপ করে বলেন, দলের নেতারা হয়তো আর্থিকভাবে ধনাঢ্য, কিন্তু দল হিসেবে বিএনপি দরিদ্র। এ জন্যই কোনো তহবিল নেই।
এ ছাড়া আইসিটি ও মিডিয়া সেলের মধ্যে রয়েছে সমন্বয়হীনতা। এখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে মিডিয়া সেল। সেখানে আইসিটি সেলের গুরুত্ব কম। আইসিটি সেলে যারা বিগত দিনে বিনা পারিশ্রমিকে দলকে ভালোবেসে কাজ করেছেন এমন ছাত্রদল, যুবদলের মেধাবীদের বাদ দিয়ে কমার্শিয়াল আইটি বিশেষজ্ঞদের দিয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে মিডিয়া সেল। ফলে আইসিটি সেল আরও গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে।
সময়ের ফাঁদে বিএনপি
দ্য রয়্যাল আইটি সল্যুশনের চেয়ারম্যান ও আইটি বিশ্লেষক সাইফুল ইসলাম শাকিল জানান, বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার সাধারণত বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে শুরু হয়। এ সময় দলের নেতাকর্মীরা কেউ বিশ্রামে, কেউ ঘুমিয়ে পড়েন। সাধারণত গুজব প্রচারের পর এর কাউন্টার দিতে আট ঘণ্টা সময় পাওয়া যায়। এর মধ্যে ফ্যাক্ট চেকের মাধ্যমে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে পারলে ওই গুজব রোধ করা সম্ভব। ডিজিটাল মার্কেটিং মেথড ব্যবহার করে কাউন্টার পোস্ট ভাইরাল করতে হলে ন্যূনতম কিছু সময় প্রয়োজন। আবার গুজবের পোস্ট দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট করে দেওয়ার মাধ্যমেও এটিকে রোধ সম্ভব। যখন অনেক মানুষ একসঙ্গে রিপোর্ট করবে, তখন ফেসবুক স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি ব্যবস্থা নেবে। বিএনপি নেতাকর্মীরা যাতে সেই সুযোগ না পান, সে জন্য রাতেই বেশি এ কাজ করা হচ্ছে।
উচ্চপ্রযুক্তির ব্যবহার
ওয়ান মল আইটি লিমিটেডের নির্বাহী ও আইটি বিশ্লেষক সাইফুর রহমান আসাদ বলেন, মূলত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এবং শক্তিশালী সফটওয়্যার দিয়ে এসব অপকর্ম করা হচ্ছে। গ্রিন স্ক্রিন, ডিপ ফেক এবং বিভিন্ন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তির সহায়তায় এ ধরনের কাজ সূক্ষ্মভাবে করা সম্ভব। এতে করে এটি বাস্তব না বানোয়াট, সাধারণ দৃষ্টিতে তা বোঝার উপায় থাকে না। তিনি বলেন, সংঘবদ্ধ অপপ্রচারকারীরা ভুল তথ্যের প্রামাণ্য সূত্র ব্যবহার করতে ভুয়া সংস্থা ও অনলাইন পোর্টাল তৈরি করছে। এ ক্ষেত্রে তারা প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের লোগো, ফটোকার্ড ব্যবহার করে নিজেদের বানানো ঘটনা প্রচার করছে।
আইটি বিশ্লেষকরা জানান, সম্প্রতি ভয়েজ ক্লোনিংয়ের অনেক সফটওয়্যার বের হয়েছে, যেখানে একজন ব্যক্তির কণ্ঠে রেকর্ড করা বেশ কিছু ক্লিপ সরবরাহ করলে পরবর্তী সময়ে সেই সফটওয়্যারগুলো স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী সেই ব্যক্তির কণ্ঠ নকল করে যা ইচ্ছে বলানো যায়।