
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ, নান্দাইল, গফরগাঁও ও ভালুকায় বাড়ছে নির্বাচনের উত্তাপ। দেড় দশকেরও বেশি সময় পর ভোটের পরিবেশ ফিরে আসায় সারাদিন উত্তাল থাকছে সভা, সমাবেশ, মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে। গণসংযোগে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকছেন রাজনীতিকরা। বৃহত্তম দল বিএনপির নেতারা মাঠে সক্রিয়তার চেয়ে বেশি দৌড়ঝাঁপ করছেন হাইকমান্ডে। মনোনয়ন পাওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে রাখছেন নিবিড় যোগাযোগ। কিন্তু দলীয় কোন্দলের কারণে কিছুটা বিঘ্ন ঘটছে প্রচারে।
অপরদিকে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল জামায়াতে ইসলামী বেশ আগেই প্রার্থী চূড়ান্ত করায় ঐক্যবদ্ধভাবে ভোটের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নেতাকর্মীরা। ছুটছেন ভোটারদের কাছে, প্রচারে পাচ্ছেন বাড়তি সুবিধা। বসে নেই ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদসহ অন্য দলের নেতারাও, নানা কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণের কাছে তুলে ধরছেন নিজেদের অবস্থান।
ময়মনসিংহ-৮ (ঈশ্বরগঞ্জ)
এ আসনে বিএনপির ভেতরে সবচেয়ে আলোচনায় উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক প্রকৌশলী লুৎফুল্লাহেল মাজেদ বাবু। মাঠ পর্যায়ে তিনি তরুণ প্রজন্মকে আন্দোলিত করতে পেরেছেন। বেকারত্ব নিরসনে তার নানা উদ্যোগ স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিজ উদ্যোগে জেনারেটর স্থাপন ও অবকাঠামো আধুনিকায়নে তার ভূমিকাও এলাকায় ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।
প্রকৌশলী বাবু বলেন, ধানের শীষের পক্ষে জোয়ার তুলতে তিনি সবাইকে নিয়ে কাজ করছেন। তরুণদের চাওয়ামতো ঈশ্বরগঞ্জকে সাজানোর অঙ্গীকারও দিচ্ছেন। দল তাকে মনোনয়ন দেবে বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস আছে।
অন্যদিকে সাবেক সংসদ সদস্য শাহ নুরুল কবীর শাহীনও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি আগের আমলের অবদান ও নিজের পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। তবে স্থানীয় বিএনপির একাংশের অভিযোগ, দলের দুর্দিনে নেতাকর্মীদের পাশে না থাকার নজির তাকে এবার কঠিন চ্যালেঞ্জে ফেলেছে। জনপ্রিয়তা থাকলেও মনোনয়ন পাওয়া তার জন্য কঠিন।
জামায়াত জেলা শাখার শূরা ও কর্মপরিষদ সদস্য এবং উপজেলা শাখার আমির অধ্যক্ষ মাওলানা মঞ্জুরুল হক হাসানকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন থেকে উপজেলা শাখার সভাপতি মুফতি হাবিবুল্লাহ এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ ইত্তেফাকুল উলামা উপজেলা সভাপতি মাওলানা খন্দকার আবুল ফজল ‘নতুন বাংলাদেশে সুশাসন’ ইস্যুতে ভোটার টানার চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে এনসিপি উপজেলা শাখার প্রধান সমন্বয়কারী মোজাম্মেল হকও মাঠে আছেন।
ময়মনসিংহ-৯ (নান্দাইল)
আসনটিতে বিএনপিতে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশীর সক্রিয়তা দলটির ভেতরে প্রতিযোগিতা ও অবস্থান দখলের লড়াইকে প্রকাশ্যে এনেছে। দলটির অন্তত পাঁচ নেতাকে মনোনয়ন দৌড়ে প্রতিযোগিতায় দেখা গেছে। তাদের মধ্যে সাবেক এমপি আনোয়ারুল হোসেন খান চৌধুরীর ছেলে, ময়মনসিংহ উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য ও নান্দাইল উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ইয়াসের খান চৌধুরী ইতোমধ্যে সংগঠন শক্তি জোরদারে ব্যস্ত। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. এ কে এম শামসুল ইসলাম শামস মাঠে কৌশলী প্রচারে পরিচিতি বাড়াচ্ছেন। সাবেক এমপি খুররম খান চৌধুরীর ছেলে, ময়মনসিংহ উত্তর জেলা ও নান্দাইল উপজেলা বিএনপির সদস্য নাসের খান চৌধুরী পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও তৃণমূল নেটওয়ার্ক দুটোকেই পুঁজি করে অগ্রসর হচ্ছেন। সাবেক ছাত্রনেতা, ময়মনসিংহ উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য ও উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এমডি মামুন বিন আবদুল মান্নান তরুণ ভোটারদের ঘিরে সংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছেন। একইভাবে উচ্চপদস্থ সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) আনোয়ারুল মোমেনও প্রকাশ্যে বিএনপির মনোনয়ন চাওয়ার কথা জানিয়েছেন। দলটির অনেক নেতা ভেতরে গ্রুপিং ও লবিংয়ে ব্যস্ত আছেন। এতে শেষ পর্যন্ত একক প্রার্থীর পেছনে ঐক্য গড়াই হবে বিএনপির বড় পরীক্ষা।
জামায়াত এ আসনে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির (বিডিপি) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম চানকে সমর্থন দিয়েছে। জামায়াত প্রার্থী ঘোষণা না করে ১২ মে আনুষ্ঠানিকভাবে এই নেতাকে সমর্থন দেয়। আর সেদিন থেকেই নির্বাচনি প্রচার শুরু করেন আনোয়ারুল ইসলাম।
এছাড়া এনসিপি ‘বাংলাদেশ পুনর্গঠনের’ স্লোগান তুলে কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আশিকিন আলম রাজনকে প্রার্থী হিসেবে সামনে আনছে। গণঅধিকার পরিষদ দলীয়ভাবে মাহবুব আলম মাহবুবকে মনোনীত করেছে। ইসলামী আন্দোলন থেকে মাওলানা মুফতি সাইদুর রহমান মনোনয়ন পেয়েছেন।
ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও)
নির্বাচনকে সামনে রেখে এ আসনে ধানের শীষ পাওয়ার লড়াইয়ে নেমেছেন বিএনপির ছয় নেতা। তাদের মধ্যে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা আলমগীর মাহমুদ আলম অন্যতম। তিনি ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালনের পাশাপাশি গফরগাঁওয়ে তার সাংগঠনিক উপস্থিতি আছে।
তালিকায় আরো আছেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আল ফাতাহ্ খান, জেলা যুগ্ম আহ্বায়ক এবি সিদ্দিক, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আকতারুজ্জামান বাচ্চু, দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. মোফাখখারুল ইসলাম রানা এবং দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য ও গফরগাঁও উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মুশফিকুর রহমান। সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে তৃণমূলে গণসংযোগ ও মতবিনিময় চালিয়ে যাচ্ছেন।
জামায়াত উপজেলা শাখার আমির ইসমাইল হোসেনকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তিনি স্থানীয়ভাবে সংগঠন পুনর্গঠন ও ভোটারদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে ইতোমধ্যে ইউনিয়নভিত্তিক গণসংযোগ শুরু করেছেন।
ময়মনসিংহ-১১ (ভালুকা)
ময়মনসিংহের শিল্পাঞ্চল খ্যাত এ আসনে শ্রমিক ভোটার অন্যতম ফ্যাক্টর। উপজেলার হবিরবাড়ীসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় ছোট-বড় অসংখ্য শিল্পকারখানা, শ্রমিকদের আবাসন, বাজার, পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবার জটিলতা এবং প্রতিদিনের শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রা এখানে রাজনীতির ভাষা নির্ধারণ করে।
১৯৭৯ সালের পর এখানে মুসলিম লীগ দু’বার, জাতীয় পার্টি একবার, বিএনপি দু’বার জয় পেয়েছে। অর্থাৎ ভোটাররা ব্র্যান্ড–বিশ্বস্ততার চেয়ে কাজ ও প্রার্থীর বিশ্বাসযোগ্যতাকেই বেশি মূল্য দেন। এবার এখানে বিএনপির মনোনয়ন চাইছেন ভালুকা উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ফখরউদ্দিন আহাম্মেদ বাচ্চু, উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক মুহাম্মদ মুর্শেদ আলম ও অ্যাডভোকেট আনোয়ার আজিজ টুটুল।
বিএনপির অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতার মধ্যে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে জামায়াত। দলটির নেতাকর্মীদের তৎপরতা ভালুকায় সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। উপজেলা জামায়াতের আমির ছাইফ উল্লাহ পাঠানকে এখানে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। শিবিরের রাজনীতি দিয়ে তার যাত্রা শুরু। তিনি গত বছরের ৫ আগস্টের পর এ আসনে প্রচারণায় অনেক বেশি এগিয়ে আছেন। তিনি দিন-রাত ডোর-টু-ডোর প্রচার, পরিবারভিত্তিক ছোট বৈঠক, মসজিদ-মাদরাসা-বাজার-চৌমাথায় মতবিনিময় সব মিলিয়ে তারা ‘সুশাসন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ন্যায্যমূল্যের বাজার, মাদক কারবার দমন, যুবকর্মসংস্থান’ এই বার্তা দিয়ে ভোটারদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন।
অপরদিকে এনসিপির সম্ভাব্য প্রার্থী ডা. জাহিদুল ইসলাম। তিনি উপজেলার ৯ নম্বর কাচিনা ইউনিয়নের বাটাজোর গ্রামের বাসিন্দা। এলাকায় তার নাম আগে ততটা শোনা না গেলেও ২০২৪ সালের ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার দাবি নিয়ে তিনি সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেশ সক্রিয়। চিকিৎসকের পেশা ও বদলে দেওয়ার বার্তা নিয়ে তিনি মাঝে-মধ্যেই হাট-বাজার, গ্রাম-মহল্লা ঘুরছেন।
স্থানীয় শ্রমিক মর্তুজা আহমেদ বলেন, যেসব প্রার্থী জানমালের নিরাপত্তা এবং বাসা ভাড়া ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে কাজ করবেন তাদেরই ভোট দেব। মাছ ব্যবসায়ী আবদুল খালেক বলেন, ছিনতাই, ড্রেন মেরামত আর রাস্তার দুর্ঘটনা দূর করতে যে কাজ করবে তাকেই সমর্থন দেব।