Image description

সারাদেশে আধুনিক কৃষি ও ফসল বিস্তারের দায়িত্ব পালন করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), যা ফার্মগেটের খামারবাড়ি নামে পরিচিত। এখানে পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন শতাধিক নারী। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ দপ্তরে দীর্ঘদিন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন সমিতি-সংগঠনের দৌরাত্ম্য চলছে। এসব সংগঠন রীতিমতো সরকারি অফিসে কার্যালয় খুলে বসেছে। 

সমকালের অনুসন্ধানে এ রকম আটটি সংগঠনের কার্যালয় পাওয়া গেছে, যারা একাধিক সরকারি কক্ষ দখল করে রেখেছে। অথচ কক্ষ সংকটের অজুহাত তুলে ডে-কেয়ার সেন্টার চালুর উদ্যোগ বারবার আটকে যাচ্ছে। আটটি সংগঠনের মধ্যে সরকারি নিবন্ধনপ্রাপ্ত যেমন আছে, তেমনি রয়েছে অনিবন্ধিতও। এসব সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা কার্যালয়ে বসে তদবির বাণিজ্য করছেন। ফলে দপ্তরের মূল কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া এসব কার্যালয়ের বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসসহ নানা বিল অধিদপ্তরকে বহন করতে হচ্ছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী অধিদপ্তরের ভেতরে একটি আধুনিক ডে-কেয়ার সেন্টার গড়ে তুলতে গত এক বছরে একাধিকবার নির্দেশ দিয়েছেন। এতে দপ্তরে কর্মরত নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সন্তান দেখাশোনার ব্যবস্থা হবে; তারা কর্মক্ষেত্রে মনোযোগ দিতে পারবেন। কিন্তু কক্ষ সংকটের অজুহাতে সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়নি। ঢাকার বাইরের যেসব প্রকল্পের লিয়াজোঁ অফিসের জন্য খামারবাড়িতে একটি করে কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেগুলো ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সংগঠনের নামে বরাদ্দ কক্ষ বাতিল করা হয়নি। ফলে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার খোলার জায়গাও মিলছে না।

গতকাল বুধবার সরেজমিন পরিদর্শনে খামারবাড়িতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আটটি সংগঠনের কার্যালয় দেখা গেছে। এর মধ্যে সরকারি রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত খামারবাড়ি নন-গেজেটেড সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতি দুটি, বাংলাদেশ সরকারি গাড়িচালক সমিতির তিনটি, বাংলাদেশ চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতি খামারবাড়ি উপপরিষদ দুটি টিনশেডের কক্ষ দখল করে রেখেছে। অন্য পাঁচটি সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন নেই। বিসিএস (কৃষি) অ্যাসোসিয়েশন দুটি, অবসরপ্রাপ্ত বিসিএস (কৃষি) অফিসার কল্যাণ সমিতি দুটি, কৃষিবিদ সমবায় সোসাইটি লিমিটেড একটি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ দুটি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড একটি কক্ষ দখল করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এসব অফিসে নিয়মিত বৈঠক হয়, চলে তদবির বাণিজ্য।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারী অনেকের শিশুসন্তান রয়েছে। ডে-কেয়ার না থাকায় কেউ কেউ বাধ্য হয়ে স্বজন বা ভাড়াটে আয়া কিংবা বাণিজ্যিক ডে-কেয়ারের ওপর নির্ভর করছেন। এতে সন্তানদের ঝুঁকি বাড়ছে। অফিসেও তারা মনোযোগ দিতে পারছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অফিসে থাকি। ছোট বাচ্চা বাড়িতে রেখে কাজ করা অত্যন্ত কষ্টকর। ডে-কেয়ার থাকলে সবাই স্বস্তিতে কাজ করতে পারতেন। রুম পাওয়া যাচ্ছে না, অথচ দপ্তরের ভেতরে এত সংগঠন কার্যালয় খুলে বসেছে!’ 

আরেক নারী কর্মকর্তা বলেন, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সংগঠনগুলোর দখলদারিত্ব ও প্রশাসনিক অদক্ষতার কারণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে একটি সাধারণ ডে-কেয়ার সেন্টার এতদিনে চালু করা যাচ্ছে না। ফলে সরকারের নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, এখানে সংগঠনের প্রভাব এত বেশি, কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে সাহস পায় না। কৃষি উপদেষ্টা কয়েক দফা বলেছেন, ডে-কেয়ার সেন্টার দ্রুত চালু করতে হবে। কিন্তু কর্মকর্তারা পদক্ষেপ নেননি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশাসন ও অর্থ উইংয়ের পরিচালক মো. হাবিবউল্লাহ্ বলেন, ডে-কেয়ার নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। খুব দ্রুত চালু হবে। অধিদপ্তরের ভেতরে অফিস করা সংগঠনগুলোর বেশির ভাগ নেতা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে একজনের দাবি, ‘আমরা কোনো কক্ষ দখল করিনি। আমাদের কার্যক্রম অফিসের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাই কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ দিয়েছে।’ 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান সমকালকে বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন। তাদের অনেকের ছোট সন্তান রয়েছে। কিন্তু এত বড় দপ্তরে ডে-কেয়ার সেন্টার নেই। আশা করছি, শিগগিরই নারী কর্মকর্তারা এ সুবিধা পাবেন। তিনি বলেন, ‘সেখানে কোন কোন সংগঠনের কার্যালয় আছে, খতিয়ে দেখব। নিয়মবহির্ভূতভাবে কিছু হয়েছে কিনা, তাও দেখব।’ 

সাবেক সচিব এটিএম আতাউর রহমান বলেন, সরকারি অফিসে সমিতি ও সংগঠনগুলোর প্রভাব সীমিত না করলে জনস্বার্থে নেওয়া অনেক উদ্যোগ ব্যাহত হবে।