Image description

জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে লাইসেন্স পেতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ করতে হয়। তারমধ্যে অন্যতম হলো, যে স্থানটিতে শিপইয়ার্ড বা জাহাজ নির্মাণের কারখানা গড়ে উঠবে সেটি নিজস্ব জমি হতে হবে। কিন্তু ‘থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠানটির কারখানা মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার যে স্থানটিতে গড়ে উঠেছে তা প্রায় পুরোটাই নদী, খাল এবং নদী ও খালের ধারের সরকারি খাস জমি। বেশ কিছু সাধারণ মানুষের জমিও এরমধ্যে আছে। আওয়ামী লীগ আমলে জোর করে রাতারাতি এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়েছে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও তৎকালীন নৌ-মন্ত্রী শাজাহান খানের একচেটিয়া দাপটে। এই প্রতিষ্ঠানের মূল মালিক হিসেবে যদিও কাগজপত্রে আছে ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আমিনুল ইসলামের নাম। কিন্তু বাস্তবে এর অঘোষিত মালিক শাজাহান খান। প্রতিষ্ঠানটির মালিক ইঞ্জিনিয়ার আমিনুল ইসলাম নিজেকে বরাবর মন্ত্রী শাজাহান খানের শ্যালক হিসেবেই পরিচয় দিতেন। গজারিয়াস্থ কারখানা এলাকার মানুষ ছাড়াও সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা এটাই জানেন। 
২০১১ সালে কৃষকের কাছ থেকে সামান্য কিছু জমি কিনে নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠতে শুরু করে। তখন শাজাহান খান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী। তাঁর দাপটে অবৈধ দখলের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের পরিধি দ্রুত বাড়তে থাকে। নদী, খাল, সরকারি খাস জমি এবং সাধারণ মানুষের জমি জোর করে বালু ফেলে ভরাট করা হয়। স্থানীয় প্রশাসন বা বিআইডব্লিউটিএ এ ব্যাপারে কোনোই ব্যবস্থা নেয়নি। সাধারণ মানুষ তো এদের দাপটের কারণে কথা-ই বলতে পারেনি। শুধু তাই নয়, লাইসেন্স প্রাপ্তির কোনো শর্ত পূরণ না করেই জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্সও আদায় করে নেয় সম্পূর্ণ অবৈধভাবে। এমনকি একের পর এক কাজও বাগিয়ে নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ-সহ সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছ থেকে। এক্ষেত্রে টেন্ডার ডকুমেন্টসে ভয়াবহ অনেক জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এসব অপকর্ম করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরাও পড়েছে। তারপরও শাজাহান খানের এ প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা যায়নি। পরবর্তীতে আবারও কাজও দিতে বাধ্য হয়েছে বিআইডব্লিউটিএ-সহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান। এদিকে কাজ বাগিয়ে নেয়ার পর নানা জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে নিম্নমানে জাহাজ ও অন্যান্য নৌযান সরবরাহ করেছে। মেরামত কাজের কার্যাদেশ বাস্তবায়নেও করেছে বড় ধরনের ঘাপলা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজ না করেই, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ন্যূনতম কাজ করেই পুরো বিল তুলে নিয়েছে। ‘থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড’ নামের ভুয়া এই প্রতিষ্ঠানটির জাল-জালিয়াতি, ঘাপলা এবং অনিয়ম-অপকর্মে জড়িত ছিল বিআইডব্লিউটিএ-সহ সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানসমুহের কর্মকর্তারাও। সবাই জানতো, এটা মন্ত্রীর বেনামে প্রতিষ্ঠান। নিজ নামে যেহেতু প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব নয়, তাই তিনি এ কৌশল নিয়েছিলেন। এসব জাল-জালিয়াতি, অনিয়ম-অপকর্মে সহযোগিতার মাধ্যমে তারাও বড় অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। 
নদী-খাল ও জমি দখল করে যেভাবে গড়ে  উঠেছে থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড 
২০১১ সালে নয়ানগর মৌজায় মেঘনার কূলঘেঁষে কিছু জমি কিনে যাত্রা করে থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড। তখন থেকেই দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে। মেঘনা নদী, ফুলদী নদী, কুমারিয়া খাল, বুরুরচক খাল, মালিকানার কৃষিজমি, সরকারের খাসজমি সবই ঢুকে যেতে থাকে প্রতিষ্ঠানটির পেটে। সেখানে গড়ে ওঠে ‘থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড’ নামের একটি জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান।
এলাকা ঘুরে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নদী, খাল, বিল ও কৃষিজমি ভরাট করে দখল এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট করার অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ও তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। নদী রক্ষা কমিশন, জেলা প্রশাসক কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য চিঠিও দিয়েছে। কিন্তু নদী, খাল, জমি দখলমুক্ত হয়নি।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনে নদী দখলদার হিসেবে থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেডের বিষয়ে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি মেঘনার তীর থেকে প্রায় ৫০০ ফুট ভেতরে এবং ফুলদী নদীর মাঝ বরাবর দখল করে নিয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ও নদীর জমি দখলমুক্ত করতে প্রতিষ্ঠানটি সরিয়ে নিতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 
নদী, খাল, কৃষি ও অকৃষি খাসজমি দখল ও অবৈধভাবে ভরাটের বিষয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর পৃথক তদন্তে থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেডের বিরুদ্ধে প্রায় ২৭৪ একর জলাশয়, খাল, নদী ও কৃষিজমি দখলের কথা বলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ফুলদী নদীর তীর ভরাট করে ৬০ একর, সরকারের ৩০ একর খাসজমি, মেঘনা নদীর তীর ভরাট করে ৬০ একর, কুমারিয়া খাল ভরাট করে ১০ একর, গোপাট দখল করে ৪ একর, বুরুর চক খাল ভরাট এবং গজারিয়ার আরও দুটি মৌজায় প্রায় ১১০ একর জায়গা।
বিপুল পরিমাণে নদী, খাল ও সরকারি জমিতো দখল করে নিয়েছেই, এমনকি অনেক সাধারণ মানুষও নিঃস্ব হয়ে গেছে। এক দশক আগেও সবুজ ক্ষেত আর ফল-ফসলে সমৃদ্ধ ছিল মুন্সীগঞ্জ জেলার দ্বীপসদৃশ উপজেলা গজারিয়ার নয়ানগর মৌজার সদর ইউনিয়ন। তিন ফসলি জমিগুলোতে ফলত ধান, আলু, ভুট্টা। বর্ষায় পাওয়া যেত প্রচুর মাছ। বছরে শত শত কোটি টাকার ফসলই ছিল সেখানকার কৃষকদের আয়ের প্রধান উৎস। সেই সবুজ মাঠ আর কৃষিজমি এখন যেন ধু-ধু মরুভূমি। ২০১১ সালের স্যাটেলাইট চিত্রে যে ভূখণ্ডটি নদীর পানি আর সবুজ গাছগাছালিতে ছিল পরিপূর্ণ, পরের বছরগুলোতে সেখানে বাড়তে থাকে বালুভূমি। বালুতে ভরে ওঠে নদী, খাল। চাপা পড়ে যায় উর্বর কৃষিজমি। রুদ্ধ হয়ে যায় শত শত কৃষকের জীবিকার পথ। 
২৭ বছর সৌদি আরবে ছিলেন গজারিয়ার সদর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আমির হোসেন। সারা জীবনের সঞ্চিত টাকা দিয়ে যে জমিজমা কিনেছিলেন, সেখানে এখন আর যেতে পারেন না তিনি। তিনি বলেন, ‘২৭ বছর দেশের বাইরে কাটিয়ে আট বছর আগে দেশে আসছি। বিদেশে থাকতে টাকা-পয়সা জমিয়ে যে জমিগুলো কিনছিলাম, সেগুলো চাষ করেই সংসার চলত। একেকটা জমিতে ১২০ মণ আলু পাইতাম। একই জমিতে আলুর পরে ভুট্টা, তার পরে আমন ধান চাষ করতাম। এখন কিছুই করতে পারি না।’
আমির বলেন, ‘করোনার সময় জোর করে এসব জমিতে বালু ফেলে দখল করে নিয়েছে থ্রি এঙ্গেল। জমিজমা হারিয়ে আমি নিঃস্ব। মাঝেমধ্যে বাজার করার টাকাও থাকে না।’ চোখ মুছতে মুছতে তিনি আরও বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ার আমিনুল সাব (থ্রি এঙ্গেলের মালিক) জমি নিছে নিক। যদি আমার জমির মূল্য দিত, টাকাগুলো দিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়া চলতে পারতাম। কিন্তু তিনি তাও করেন না।’

শীর্ষনিউজ