
জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ার তিনটি দফায় আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। এগুলো হচ্ছে-২, ৩ ও ৪ নম্বর দফা। সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় বেশকিছু অসামঞ্জস্য চোখে পড়েছে দলটির নীতিনির্ধারকদের। এসব পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখার জন্য দলের তিন সদস্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া পর্যালোচনা করে ঐকমত্য কমিশনে মতামত জানাবেন।
এ নিয়ে সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে বলা হয়, সরকার ঘোষিত সময়ে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংশয় দেখছে না বিএনপি। তবে নির্বাচনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে দেশি-বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্র চলছে। নির্বাচনের স্বার্থে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে চান তারা। এরই ধারাবাহিকতায় জুলাই সনদেও স্বাক্ষরে আগ্রহী দলের শীর্ষ নেতারা।
গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন। রাত সাড়ে ৮টায় শুরু হয়ে চলে ১১টা পর্যন্ত।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন- স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন (ভার্চুয়ালি), মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (ভার্চুয়ালি), আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী (ভার্চুয়ালি) সালাহউদ্দিন আহমদ, বেগম সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ (বীরবিক্রম) ও ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, ২৮ পৃষ্ঠার এই খসড়া পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করতে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদসহ তিন নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এ নিয়ে কাজও শুরু করেছেন। বৈঠকে নেতাদের পর্যালোচনায় উঠে আসে-সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামায় জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনে ধারাবাহিক বৈঠকে আলোচনা হয়নি-এমন কিছু বিষয়ও এতে রাখা হয়েছে। এছাড়া কিছু বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। এ সময় বলা হয়, আগামী সংসদ গঠনের ২ বছরের মধ্যে সংবিধান সংক্রান্ত সংশোধনী পাশ করার কথা প্রথমে বলা হলেও চূড়ান্ত খসড়ায় তা নেই।
সূত্রমতে, জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া নিয়ে সামগ্রিকভাবে খুব বেশি আপত্তি নেই বিএনপির। তবে জুলাই সনদে উত্থাপিত ৮৪ দফার মধ্যে যেগুলোয় সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে, সেসবের বাস্তবায়ন কীভাবে হবে; যেসব বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট এসেছে, সেগুলোর সুরাহা কীভাবে হবে এবং সংবিধান সংস্কারবিষয়ক যেসব কথা এসেছে, এর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে-এসবের নিষ্পত্তি জরুরি। নোট অব ডিসেন্ট প্রসঙ্গও পর্যালোচনায় উঠে আসে।
এ সময় বলা হয়, শুধু বিএনপিই নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কিছু বিষয়ে ভিন্নমত দিয়েছে। নারী আসন নিয়ে বিএনপির প্রস্তাব ছিল ৩০০ আসনের মধ্যে অন্তত ৫ শতাংশ আসনে নারীদের মনোনয়ন দেওয়া, যেখানে তারা সরাসরি ভোটের নির্বাচনে অংশে নেবেন। কিন্তু অন্য দলগুলো এ প্রস্তাবে দ্বিমত করেছে। এছাড়া সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০-এর সংস্কার প্রসঙ্গে বিএনপি চারটি ক্ষেত্র যুক্ত করতে চেয়েছে, যা নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে। বিএনপি যেসব মৌলিক প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে, সেগুলোয় ছাড় দিতে চায় না। এখানে বিএনপি আগের অবস্থানেই থাকতে চায়। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ব্যক্তি একই সঙ্গে দলীয় প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন না, নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের ১০০ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন-এসব অন্যতম।
বিএনপি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার কিছু ভারসাম্য আনতে রাজি। তবে এমন ভারসাম্য চায় না, যেখানে সরকারপ্রধান তথা প্রধানমন্ত্রীর হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকবে না। দলটি মনে করে, সার্বিক বিবেচনায় সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতিকে ব্যাপকভাবে ক্ষমতায়িত করা হলে সংসদীয় গণতন্ত্র তেমন অর্থবহ থাকবে না। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা না থাকলে সংসদীয় গণতন্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়বে। জুলাই জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়ায় রাজনৈতিক দলগুলো কোন কোন প্রস্তাবে একমত হয়েছে এবং কোন প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে, সেটা উল্লেখ করা হয়েছে। বিএনপিসহ কোন কোন দল কোন প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে, উল্লেখ আছে সেটিও।
জুলাই জাতীয় সনদ সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য পেলে একটি খারাপ নজির স্থাপন হবে-এমন মন্তব্যও করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। তারা বলেন, ‘এখানে বলা হয়েছে, জুলাই সনদের সবকিছু সংবিধান এবং কোনো আইনি ভিন্নতা থাকলেও এই সনদের বিধান, প্রস্তাব, সুপারিশ প্রাধান্য পাবে। এছাড়া দ্বিতীয় দফার আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অঙ্গীকারনামায় সনদকে সংবিধানের ওপরে রাখা হয়েছে। কোনো ডকুমেন্ট সংবিধানের ওপরে হতে পারে না। আমরা সংবিধানের মধ্যে আইনি বৈধতা এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় কীভাবে এই সমঝোতা দলিলটিকে বাস্তবায়ন করতে পারি, সেই চিন্তা করতে হবে। এখন যদি বলা হয় এই দলিলের সবকিছু সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য পাবে, তাহলে এটা ভবিষ্যতের জন্য খারাপ নজির সৃষ্টি হবে। এটা করা ঠিক হবে না।’
সালাহউদ্দিন আহমদ দুপুরে সাংবাদিকদের জানান, চূড়ান্ত খসড়ায় ‘বলা হয়েছে-এই সনদের বিধিবিধানের ব্যাখ্যা মীমাংসার এখতিয়ার বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকবে। আপিল বিভাগের ওপর কি এমন কোনো আইন ন্যস্ত করতে পারি? কোনো মামলার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট ডিভিশন থেকে আপিল বিভাগে আপিল হয়। তা ছাড়াও সাংবিধানিক কিছু বিষয়ে আর্টিকেলের ১০৩ অনুসারে আপিল বিভাগে যাবে। জুলাই সনদ আইনও নয় এবং রায়ও নয়।
এখানে ব্যাখ্যার জন্য আপিল বিভাগে কে পাঠাবে? কীসের ভিত্তিতে যাবে? সেই প্রশ্নগুলো আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা একটা সমঝোতার দলিলের স্বাক্ষর করলাম, সেখানে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য আপিল বিভাগের কোনো এখতিয়ার আছে কি না, এই এখতিয়ারটা কী? এটা খুঁজে বের করতে হবে।’
জুলাই সনদের বৈধতা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না-এই প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না, এই এখতিয়ার কি আমাদের সংবিধান কাউকে দিয়েছে? আমার মনে হয়, এটা সঠিকভাবে উচ্চারিত হয়নি। এটা অন্য কোনোভাবে হয়তো লেখা যেত। আদালতে প্রশ্ন তুলতেই পারেন কেউ। আর্টিকেল ৩১ অনুসারে আইনের আশ্রয় নেওয়া যে কোনো নাগরিকের অধিকার। আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না, এ বিষয়টা এভাবে উল্লেখ করা ঠিক হবে না।’
এদিকে বুধবার (২০ আগস্ট) বিকাল ৪টার মধ্যে ঐকমত্য কমিশনের কার্যালয়ে জুলাই জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়ার বিষয়ে দলীয় মতামত জমা দেয়ার সময়সীমা নির্ধারিত রয়েছে। তবে খসড়া পর্যালোচনার ক্ষেত্রে একদিন বেশি সময় নিতে পারে বিএনপি। সেক্ষেত্রে বৃহস্পতিবার ঐকমত্য কমিশনে মতামত দেওয়ার কথা রয়েছে।