
বহুল কাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত জুলাই সনদের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে। চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এতে নানা অসংগতিসহ অপূর্ণতা খুঁজে পেয়েছে বেশ কয়েকটি দল। নেতারা বলছেন, বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে, তা কীভাবে সংবিধানে কার্যকর হবে উল্লেখ করা হয়নি। একই সঙ্গে অঙ্গীকারনামায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কোনো সময়সীমাও নেই। কিছু বিষয়ে অসামঞ্জস্য, আবার কিছু বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। অসংগতি চিহ্নিত করে তা সমাধানের পাশাপাশি সনদ দ্রুত বাস্তবায়ন চায় রাজনৈতিক দলগুলো। সেক্ষেত্রে নমনীয়তার কথাও বলছে কয়েকটি দল। জুলাই সনদের খসড়া পর্যালোচনা শেষে কাল-পরশুর মধ্যে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেবে দলগুলো। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক দলের শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন এমন তথ্য।
বিএনপি বলছে, সনদের সবকিছু উপস্থাপিত যেমন হয়নি, তেমনই রয়েছে অসামঞ্জস্যও। আর আইনি ভিত্তির মাধ্যমে এই সরকারকেই সনদ বাস্তবায়নের পরামর্শ জামায়াতের। এছাড়া সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না-এমন অঙ্গীকারনামায় আপত্তি জানিয়েছে সিপিবি। রোববার রাত সাড়ে ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
নেতারা জানান, জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় শব্দচয়ন, বাক্যগঠন এবং সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবে অনেক বিষয়ে অসামঞ্জস্য রয়েছে। জুলাই সনদের সাংবিধানিক ও আইনি ভিত্তি নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না বলা হয়েছে। তবে বাস্তবায়ন কোন পদ্ধতিতে হবে, তা দলগুলোকে জানানো হয়নি। জাতীয় স্বার্থে সব দলকে ছাড় দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, অন্যথায় জুলাই সনদের অসামঞ্জস্যের সুযোগ নিয়ে ফ্যাসিবাদী শক্তি ফিরে আসতে পারে।
এদিকে জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া পর্যালোচনা করে ২০ আগস্ট জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে মতামত দেবে বিএনপি। আজ দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা করবেন নেতারা। বৈঠকে কয়েকটি বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ পুনর্বিবেচনার জন্য আলোচনা হবে। জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় কিছু বিষয়ে অসামঞ্জস্য রয়েছে। পাশাপাশি কিছু বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। এগুলো আমাদের মতামতে তুলে ধরা হবে। সনদের চূড়ান্ত খসড়া পর্যালোচনা করে ২০ আগস্টের মধ্যে মতামত জানাবে বিএনপি।’
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ যুগান্তরকে বলেন, এটা তো এখন যেভাবে আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারিত হইছে, সেই জিনিসগুলো কোনো ধরনের গ্যাপ আছে কি না দেখতে হবে। অনেক সময় প্রিন্টিংয়েরও মিসটেক (ছাপায়ও ভুল) হয়। ঐকমত্য কমিশনসহ সবাই মিলে কষ্ট-পরিশ্রম করছে। অনেক সময় গেছে। এটির জন্য রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে একটা খসড়া তৈরি হয়েছে। এটি চূড়ান্ত হবে, চূড়ান্ত করার পর আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে আনা হবে। তারপর বাস্তবায়ন করা হবে। এ ধাপগুলো এখনো অবশিষ্ট। সেগুলো না হলে তো এটা লিখিত সনদ, এতে লাভ নেই। আইনি দলিল না হলে তো লাভ নেই।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি বা বাস্তবায়ন নিয়েও নিজেদের মধ্যে আরও কথাবার্তা বলতে হবে। নোট অব ডিসেন্ট বিষয়গুলো নিয়ে পার্লামেন্টে আলোচনা হবে। আমার ধারণা, বিএনপি দেখতে চাইছে আগামী নির্বাচনে তারা কেমন ভোট পায়, এর ভিত্তিতে তারা সুযোগ দেবে। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করার কথা বলেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু নোট অব ডিসেন্ট থাকলে তো আর বাস্তবায়ন করতে পারবে না। এখনো সময় আছে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এটা কোনো গ্রহণযোগ্য কথা না। এ প্রশ্ন আসা মানে, এটা হবে-যেন আমরা দায়মুক্তি দিচ্ছি। কিন্তু দায়মুক্তি দেওয়া গণতন্ত্রের বিপরীতমুখী অবস্থা। সুতরাং আমার বিবেচনায় এ ধরনের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক যুগান্তরকে বলেন, প্রশ্ন আছে-যেগুলোয় আমরা একমত হয়েছি, যেগুলোর সঙ্গে সংবিধান সংশোধনটা যুক্ত না; সেগুলো তো সরকার অনেক আগেই কার্যকরী করতে পারে। বা এখনই সরকার এগুলোকে কার্যকরী করতে পারে। আর যেগুলো সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে যুক্ত, এর জন্য তো ইলেকটেড পার্লামেন্ট লাগবে, ইলেকটেট রেপ্রেজেনটেটিভ লাগবে। সেগুলো আমরা সেখানে আলোচনা করব। একটা আলোচনা হচ্ছে যে এটার একটা আইনি সুরক্ষা কীভাবে দেওয়া যায়। এ বিষয়ে সবাই যদি একমত হয়, তাহলে আমাদেরও সম্মতি থাকবে। আমরা আপত্তি করব না। আজ গণতন্ত্র মঞ্চের বৈঠক ডাকা হয়েছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্মমহাসচিব ও দলীয় মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমাদের যে একটা মৌলিক দাবি ছিল, যেখানে আসলে সংকটের মূল জায়গা, নিম্নকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি-সেটা খসড়ায় উল্লেখ হয়নি। এজন্য আমরা মনে করছি, অন্য সংস্কারগুলো যা আছে, সব ঠিক আছে। কিন্তু এই মূল জায়গাটা (নির্বাচন পদ্ধতি) বাদ গেল, এটা নিয়ে আমাদের অনেক দলের দাবি ছিল। এটাকে আমরা একটা জুলাই সনদের অপূর্ণতা বলব। নির্বাচনে এটা নিয়ে সংকট থেকে যাবে।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু যুগান্তরকে বলেন, জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত ড্রাফট আমরা পেয়েছি। আগে যে ড্রাফটটা আমরা পেয়েছিলাম, এর আলোকে আমরা কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলাম, কিছুটা এর আলোকে পরিমার্জিত হয়েছে, সেজন্য আমরা সন্তুষ্ট। এরপরও আমরা আমাদের চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ ও মতামত শিগ্গিরই ঐকমত্য কমিশনকে অফিশিয়ালি জানাব। সনদে ৮৪টি পয়েন্ট উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলোর কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিস্তারিত বিবরণও দেওয়া আছে। সেখানে দল ও জোটগুলোর একমত এবং বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নোট অব ডিসেন্টগুলো কীভাবে সংবিধানে কার্যকর হবে, সেটা নিয়ে একটা ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে। সনদের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে এখনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এক্ষেত্রে বিএনপি যদি একটু উদারতা ও আন্তরিকতা দেখায়, আশা করি একটা সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম যুগান্তরকে বলেন, ঐকমত্য কমিশনে আমরা অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য একমত-দ্বিমতটা প্রতিফলিত হয়নি। আমরা এসব ব্যাপার নিয়েও কথা বলব। সোমবার আমরা নিজেরা বসে কথা বলে একটা সিদ্ধান্ত নেব। সেখানে আমরা একমত এবং দ্বিমতের জায়গাটা আরও কমিয়ে আনা যায় কি না, সেই ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেব।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা যুগান্তরকে বলেন, শনিবার আমরা জুলাই সনদের খসড়া হাতে পেয়েছি। ১২ দলীয় জোট ২১টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৯টি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। সনদে ৬টি বিষয়ের ব্যাপারে ১২ দলীয় জোটের নোট অব ডিসেন্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা সংস্কার কমিশনের কাছে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাব। এছাড়া অঙ্গীকারনামায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কোনো টাইম ফ্রেম বেঁধে দেওয়া হয়নি এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি নিয়ে আমাদের মতামত কমিশনকে ২০ আগস্টের মধ্যে জানাব। এ নিয়ে ১২ দলীয় জোটের মিটিং আহ্বান করা হয়েছে।
জুলাই সনদের সমন্বিত খসড়া প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম যুগান্তরকে বলেন, জুলাই সনদের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলগুলো একমত। কিন্তু এটা বাস্তবায়ন পরীক্ষা নিয়ে তাদের দুই-চারটা দলের মধ্যে মতবিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু তারপরও আমি মনে করি, এটা সামনে রেখে সব রাজনৈতিক দলই যেন একমত পোষণ করে। তা না হলে ফ্যাসিবাদী শক্তি ফিরে আসার সুযোগ পাবে। যদি ছাড় দিয়ে সমন্বিতভাবে আমরা এগিয়ে যাই, তাহলে এটা একটা মাইলফলক হিসাবে কাজ করবে। আগামী দিনে কোনো শক্তি জনগণের বিরুদ্ধে আর কাজ করতে পারবে না।