
আইনসভার মূল কাজ ‘আইন বানানো’ বাংলাদেশে ‘পিআর’ নিয়ে শোরগোল হচ্ছে। ‘প্রপোর্শনাল রিপ্রেজেন্টেশন’কে বাংলায় ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ বলা যায়। একটি নির্বাচনে ‘প্রদত্ত মোট ভোটের অনুপাতে’ কোনো ‘অথরিটি’তে ‘প্রতিনিধিত্ব’ প্রদানের ব্যবস্থাকে বলে প্রপোর্শনাল রিপ্রেজেন্টেশন। এখানে এখন টার্গেট বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদের ১৩ নম্বর নির্বাচন। ‘জাতীয় সংসদ’ বাংলাদেশের আইনসভার নাম।
বাংলাদেশ একটি ‘এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র, ‘ইউনিটারি’, মানে এটির একটিই ‘কেন্দ্র’ আছে, ঢাকা। তাই আইনসভাটি ‘প্রাদেশিক’ না ‘ফেডারেল-সেন্ট্রাল’, তা বলা লাগে না। ‘জাতীয় সংসদের’ মূল পরিচয়টিই হলো আইনসভা-লেজিসলেচার। মানে এখানে বাংলাদেশি জনগণের জন্য, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ আইন বানানো হয়। ‘আইন বানানো’ হয়! হ্যাঁ, ‘আইন বানানো’ হয়। এ জন্যই এর মর্যাদা (স্ট্যাটাস) আইনসভা। আইন বানানোই জাতীয় সংসদ সদস্যদের প্রধান কাজ। আর দ্বিতীয় কাজ হলো নির্বাহী বিভাগকে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এবং জনগণের পক্ষে জবাবদিহির (অ্যাকাউন্টেবিলিটি) আওতায় রাখা। এই জবাবদিহির নানা স্বীকৃত পন্থা আছে। জাতীয় সংসদের নিয়মিত অধিবেশনে প্রকাশ্য প্রশ্ন করে এমন জবাব চাওয়া যায়। ‘সংসদীয় স্থায়ী কমিটি’ আছে, মন্ত্রণালয়ভিত্তিক। সেখানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা নির্বাহী বিভাগের প্রতিনিধি জনগণের স্বার্থে করা কার্যক্রমের ব্যাখ্যা দেন বিস্তারিতভাবে। এমন বিস্তারিত জবাবদিহি ‘প্রকাশ্য অধিবেশনে’ সম্ভব হয় না। এর বাইরেও নানা স্বীকৃত পন্থায় জাতীয় সংসদের সদস্যরা নির্বাহী বিভাগকে জবাবদিহির আওতায় রেখে পুরো দেশবাসীর পক্ষে ‘জাতীয়’ দায়িত্ব পালন করেন। এগুলো ব্রিটিশ মডেলের নমুনা। মার্কিন মডেলে কিছুটা ভিন্নতা আছে বটে।
এ ক্ষেত্রে সারকথা হলো, জাতীয় সংসদের জন্য নির্বাচিত সদস্যরা পুরো জাতির জন্য আইনপ্রণয়ন ও পুরো জাতির কল্যাণে অন্যবিধ দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচিত হন এবং অবশ্যই তারা তাদের নির্বাচনি এলাকা (কনস্টিটুয়েন্সি)-ভিত্তিক ‘উন্নয়নকর্মের’ দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচিত হন না। নির্দিষ্ট এলাকাভিত্তিক উন্নয়নের দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচিত হন স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার বা কর্তৃপক্ষগুলোর জন্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। কারণ তাদের মূল কাজই হলো স্থানীয় জনগণের সুখ-সুবিধা-উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
‘দুই ধারার’ জনপ্রতিনিধিত্ব
এখানে দেখা যাচ্ছে, একটি ‘নির্দিষ্ট এলাকা’ থেকে দুধরনের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন। এক ধরনের নাম হলো আইনসভা বা জাতীয় সংসদের জন্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং অন্য ধরনের নাম হলো স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের জন্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। দুধরনের নির্বাচিত ব্যক্তিরাই জনপ্রতিনিধি। একজনের কাজ জাতির জন্য আইনপ্রণয়ন ও জাতীয় পর্যায়ের উন্নয়নসহ নানা কাজের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। অন্যজনের কাজ হলো স্থানীয় ভোটার-জনগণের উন্নয়ন-অভাব-অভিযোগের জবাব নিশ্চিত করা।
প্রথমটির নাম জাতীয় সংসদের সদস্যপদ। দ্বিতীয়টির ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে, স্তর আছে। বাংলাদেশে এগুলোর নাম ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশন। এসব ‘কর্তৃপক্ষে’ যারা নির্বাচিত হন, তারাও ‘জনপ্রতিনিধি’, পুরোমাত্রায়।
এ উভয় ধরনের জনপ্রতিনিধিকেই ‘নির্বাচিত’ হতে হয়। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের জন্য প্রতিনিধিরা সংশ্লিষ্ট ‘স্থানীয় জনগণ’ দ্বারা নির্বাচিত হয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নেই।
সিম্পল মেজরিটির দুর্বলতা
আইনসভার জন্য প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে। ব্রিটিশ মডেলে আসন ও ব্যক্তিভিত্তিক ভোটের মাধ্যমে আইনসভা ‘পার্লামেন্ট’র (ওদের আইনসভার নাম ‘পার্লামেন্ট, পাঠক মনে রাখবেন আশা করি) সদস্য নির্বাচিত করা হয় এবং তা ‘সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায়’ (সিম্পল মেজরিটি)। এখানে দুটো প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য : ব্রিটিশ মডেলে আইনসভার সদস্যরা প্রত্যেকে ‘ব্যক্তিগতভাবে’ ভোট (সমর্থন) অর্জন করেন এবং তা নির্দিষ্ট ‘নির্বাচনি এলাকাভিত্তিক’ (কনস্টিটুয়েন্সি, আগেও বলেছি)। আর দ্বিতীয় প্রসঙ্গ হলো, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সদস্য নির্বাচিত হতে ‘সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ’ (সিম্পল মেজরিটি) ভোট পেলেই একজন নির্বাচিত বলে ‘স্বীকৃতি’ পান। মানে, একটি নির্বাচনি এলাকা বা আসনে চারজন প্রার্থী আছেন এবং ধরা যাক, তারা প্রত্যেকেই ‘ভালো প্রতিদ্বন্দ্বী’। তাদের তিনজন ভোট পেলেন, যথাক্রমে, (১০০টি ভোট বিবেচনায়) ২০, ২৫ ও ২৬টি। আর চতুর্থজন পেলেন ২৯টি ভোট। ‘সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা’ বিবেচনায় চতুর্থজন ‘নির্বাচিত’ বলে স্বীকৃতি পাবেন। এটা হলো ‘প্রদত্ত ভোটের’ হিসাব। মনে করুন, মোট ভোটের ৫০ শতাংশ ভোট কাস্ট বা ‘প্রদত্ত’ হলো এবং মানে, ২০০ ভোটের মধ্যে বর্তমান উদাহরণে, ১০০টি ভোট ‘দেওয়া’ হলো। তার মধ্যে চারজন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে, ২৯টি ভোট পেয়ে ‘নির্বাচিত হওয়া’ মানে, কার্যত, জনগণের ১৪ দশমিক ৫ শতাংশের সমর্থন পেয়ে একজন নির্বাচিত হলেন। এটি ব্রিটিশ মডেলের স্বীকৃত।
‘পিআর’ কীভাবে?
এবার ‘পিআর’ মডেল বোঝা যাক। আনুপাতিক বা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মডেলের ‘একটি’ (মানে পিআরের আরো কিছু ‘মডেল’ আছে) হলো, একটি দেশের আইনসভার ৩০০টি ‘আসন’ আছে। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো’ নিজ দলের পক্ষ থেকে ‘৩০০ জন প্রার্থীর’ একটি ‘তালিকা’ নির্বাচনের আগেই ঘোষণা করবে এবং নির্বাচন কমিশনে জমা দেবে। সারা দেশের ভোটাররা প্রত্যেকে দুটো বিষয়ে খেয়াল করবেন : প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর প্রার্থী তালিকা এবং তালিকায় দেওয়া প্রার্থীদের ‘ক্রমবৈশিষ্ট্য’, প্রার্থীদের বৈশিষ্ট্য-যোগ্যতা এবং দলগুলোর ঘোষিত ‘অঙ্গীকারনামা-পরিকল্পনা’ ইত্যাদি। এসব দেখে-শুনে ভোটাররা, সে দেশের যে স্থান-অঞ্চলেই বাস করুন না কেন, কোনো একটি ‘দলকে’, মানে, দলের ‘মার্কা’য়, ভোট দেবেন এবং এভাবে একটি দল ‘প্রদত্ত মোট ভোটের’ ‘যত অংশ’ লাভ করবে, দলটি দেশটির আইনসভায় ‘তত অংশের আসন’ অর্জন করেছে বলে স্বীকৃতি পাবে। মানে, বাংলাদেশ বিবেচনায়, ৩০০ আসনের বেলায় একটি দল ‘সারা দেশে’ প্রদত্ত মোট ভোটের ‘১ শতাংশ ভোট’ পেয়ে থাকলে জাতীয় সংসদের ‘তিনটি আসন’ পাবে। এই ‘তিনটি আসনে’ দলটির ঘোষিত প্রকাশিত প্রার্থী তালিকার ‘প্রথম তিনজন’ নির্বাচিত হয়েছেন বলে স্বীকৃত হবেন।
‘পিআর’-এ চাই সচেতন-সচ্ছল ভোটার
মনে রাখা দরকার, ‘একজন ভোটার’ ভোটের আগে তিন, চার বা পাঁচটি দলের পূর্ণ প্যানেলের (তালিকা) ৯, ১২ ও ১৫শ (প্রতি দলের ৩০০ প্রার্থী হিসেবে) প্রার্থীর নাম-পরিচয়-যোগ্যতা জানবেন, দলগুলোর ‘ঘোষণা’ (মেনিফেস্টো) পর্যবেক্ষণ করবেন এবং তার সূত্রে ‘ভোট দেবেন’ বলে এখানে ‘আশা করা’ হয় এবং মনে করা হয়, ‘আইনসভার সদস্যের’ কাজ যেহেতু আইনপ্রণয়ন এবং নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করা, তাই সংশ্লিষ্ট ভোটার উচ্চতর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে, যার সঙ্গে ভোটারের পরিচয়-সাক্ষাতের সম্ভাবনা ক্ষীণ, ভোট দেবেন।
কিন্তু বাংলাদেশের ‘ভোট সংস্কৃতির’ (ভোটিং কালচার) অবস্থা কী? ‘সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠায় নির্বাচিত হওয়ার’ আয়োজনবিশিষ্ট নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় ভোটাররা তার এলাকার, কমবেশি চেনাজানা, এমন একজন প্রার্থীকে ভোট দেন, নির্বাচিত হলে যার কাছে তিনি প্রয়োজনে নিজের চাহিদা-অভিযোগ-প্রতিকার বিষয়ে কথা বলতে পারেন। এর বাইরে, এই ‘ভোট-সংস্কৃতির’ আরো নানা দুর্বলতা-সমস্যা আছে বটে। এই ভোটারদের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কম শিক্ষিত, কম সচেতন, কম সামর্থ্যবান। তাদের পক্ষে ‘নিজ দায়িত্বে’ নয় শ থেকে দেড় হাজার ‘প্রার্থীর’ সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা এবং ৩-৪-৫টি দলের ‘মেনিফেস্টো’ যাচাই করে ‘ভোট দেওয়ার’ সিদ্ধান্ত নেওয়া একটি জটিল ও কঠিন কাজ হবে।
‘জনপ্রতিনিধিত্বের গুণ’ বাড়ান, আপাতত
অর্থনৈতিকভাবে মোটামুটি সচ্ছল ও ‘সচেতনতায়’ মোটামুটি অগ্রসর জনগোষ্ঠীর দেশ হওয়ার আগে বাংলাদেশে ‘পিআর’ পদ্ধতি চালু করা ফলদায়ক-লাভজনক ব্যবস্থা হবে বলে মনে করার সুযোগ কম। আবার ‘জনপ্রতিনিধি’ বাছাই প্রক্রিয়ায় ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে’ পিআর প্রয়োগের প্রস্তাব করা হচ্ছে না। কেন? সেটিও তো প্রশ্ন বটে। এ বাস্তবতায় ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতির’ সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য ‘ব্রিটিশ মডেলের’ কিঞ্চিৎ সংশোধন করার কথা ভাবা যায়। বর্তমানে ‘সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার’ বদলে ‘নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার’ (এবসোলিউট মেজরিটি) বিধান প্রয়োগের ব্যবস্থা করা যায়। মানে, জাতীয় সংসদ হোক বা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের যেকোনো কর্তৃপক্ষ (ইউপি, উপজেলা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন) হোক, সর্বত্রই ‘জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত’ হবেন ‘অন্তত প্রদত্ত ভোটের ৫০ শতাংশ’ ভোটে। এ ব্যবস্থায় ‘প্রথম দিনের ভোটে’ প্রার্থীদের কেউ ৫০ শতাংশ ভোট পেলে সরাসরি নির্বাচিত বলে ‘ঘোষিত’ হবেন। তা না হলে, প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত দুজন প্রার্থী স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘দ্বিতীয় দিনের’ ভোটে প্রার্থী হবেন। ভোটের এই ‘দ্বিতীয় দিন’ পূর্বনির্ধারিত থাকবে। সেদিন ভোটে একজন প্রার্থী অবশ্যই এবং অনিবার্যভাবেই (প্রায়) ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাবেন এবং নির্বাচিত বলে ঘোষিত হবেন। এর ফলে একজন ‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি’ ‘পর্যাপ্তসংখ্যক ভোটারের সমর্থপুষ্ট’ বলে নিজে ভাবতে পারবেন। এর মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ‘ভোটের সংস্কৃতি’র উন্নতি ঘটবে এবং ক্রমেই অগ্রসর রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক পথে তারা এগোতে পারবেন।
পিআর পরে করুন
এ বাস্তবতায় আমরা বলতে পারি, ‘পিআর’ পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দাবি করা রাজনৈতিক দলগুলো আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই পিআর পদ্ধতি চালুর দাবি থেকে সরে আসতে পারে এবং জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘সাধারণের বদলে নিরঙ্কুশ’ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত হওয়ার বিধান চালুর দাবি করতে পারে। এটি করা গেলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এবং ভোটের সংস্কৃতির উভয়টির ক্ষেত্রেই কিছুটা অগ্রগতি হবে। বাংলাদেশ রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিবেচনায় এগিয়ে যাবে। এরপর, সুবিধামতো, পরের কোনো নির্বাচনে, পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়নে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে এগিয়ে যাবেন।
লেখক : প্রফেসর, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়