Image description
 

‘ব্রিটিশ দখলদারদের ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিকতা মুক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম না হলে আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র পেতাম না। বরং হিন্দুস্তানের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত হতাম। তাই আমাদেরকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের পাশাপাশি সাতচল্লিশের স্বাধীনতাকেও ধারণ করতে হবে।’

 

 

বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে আয়োজিত এক প্রীতি সম্মেলন ও শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকরা এ কথা বলেন।

 

১৪ আগস্ট ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা মুক্তি ও প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ আয়োজিত দি ব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

 

অনুষ্ঠানে রাজনীতিক, অ্যাক্টিভিস্ট, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, লেখক-সাংবাদিক-কবি-শিল্পী, উর্দুভাষী নাগরিক ও পাকিস্তানি শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।

 

জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামসুদ্দিনের সভাপতিত্বে ও সহকারী সদস্য সচিব গালীব ইহসানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত প্রীতি সম্মেলন বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের সরকারি মাদরাসা-ই-আলিয়ার যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী হাসিবের পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয়।

 

অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন আয়নাঘরে নির্যাতিত লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান বীরপ্রতীক, সিনিয়র সাংবাদিক আবুল কালাম মানিক, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র রাশেদ প্রধান, প্যান ইসলামিক মুভমেন্টের চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল ভূঞা, নাগরিক বিকাশ কেন্দ্রের (নাবিক) সভাপতি ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আরিফুল ইসলাম অপু, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সিনিয়র রিপোর্টার রাশেদ উর রহমান, আপ বাংলাদেশের মুখপাত্র শাহরীন ইরা, এসো দেশ গড়ির সভাপতি মোহাম্মাদ নুরুল হুদা ডিউক, ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুহাজির মুসলিম ও উর্দুবাসী সংখ্যালঘু কাউন্সিল বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ আফজাল ওয়ার্সি, নবাব সলিমুল্লাহ একাডেমির চেয়ারম্যান আব্দুল জব্বার, ডিপিডির সদস্য কামরুল আলাউদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম দলের সভাপতি কালাম ফয়েজী, দৈনিক আমার দেশের রিপোর্টার মোহাম্মদ ইমরান হোসাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যয়নরত পাকিস্তানি ছাত্র মুহাম্মাদ তাহির; জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইয়েদ কুতুব; বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল ওয়াহেদ,

 

লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান বীরপ্রতীক বলেন, বাঙালি মুসলমান ছিল নির্যাতিত কৃষক আর হিন্দুরা ছিল জমিদার। তাদের কারণে আমাদের পূর্ব পুরুষরা জুতা পরতে, মাথায় ছাতা ধরতে পারতেন না। স্কুলে যেতে হতো ধুতি পরে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রথম স্বাধীনতা পাওয়ায় আমরা হিন্দুদের জমিদারি থেকে মুক্তি পেয়েছি।

 

তবে হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলন না করলে এই স্বাধীনতা আরও আগে আসতো বলে মন্তব্য করেন সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আজকে ভারতবর্ষ আমাদেরই শাসন করার কথা ছিল। নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার শিক্ষিত জেনারেশন আমরা সাতচল্লিশের আগেই পেয়ে যেতাম। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা এরা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ছিল, মুসলমানদের বিরোধী ছিল। এদের কারণে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় আমরা ১৯৪৭ সালের আগে স্বাধীনতা পাইনি।

 

১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার আগে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে সৈনিক না থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পাকিস্তানি সেনারা না থাকলে পূর্ব বাংলার পরিণতি হায়দরাবাদের মতো হতো। কিন্তু তারা আমাদের দেশ পাহারা দিয়েছে। আমাদের সৈনিক বানিয়েছে। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক বাঙালি সেনাদের একবেলা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করায় আমরা সৈনিক হতে পেরেছি। সৈনিক হওয়ার পর ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে বাঙালি সেনারা বীরত্ব দেখিয়েছেন।

 

হাসিনুর রহমান বীরপ্রতীক বলেন, আমাদের সকল ইতিহাস গর্বের ইতিহাস। পাকিস্তান তাদের ইতিহাস শুরু করে শেরেবাংলা উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাব দিয়ে। কিন্তু আমরা এ ইতিহাস বলতে লজ্জা পাই। পাকিস্তানের মাধ্যমে পাওয়া এ স্বাধীনতা আমাদের জন্য গৌরবের। এ নিয়ে আমাদের লজ্জা পাওয়ার কিছু নাই। তিনি একাত্তরে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের ক্ষত ভুলে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে দুই রাষ্ট্রকে সুসম্পর্ক বাড়ানোর আহ্বান জানান।

 

জাগপার মুখপাত্র রাশেদ প্রধান বলেন, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের আজাদি নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু একাত্তরের পর আমাদের শেখানো হয়েছে মুজিব, মুজিব- মুজিব বাদে কিছু নাই। আমাদের সামনে থেকে সমগ্র ইতিহাস মুছে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবতা হলো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও মুজিববাদকে গ্রহণ করলো কিনা আমার সন্দেহ হয়। তারা জুলাই ঘোষণাপত্র শুরুই করেছে একাত্তরকে দিয়ে এবং আওয়ামী লীগের মতো সাত চল্লিশকে বাদ দিয়ে দিয়েছে।

 

তিনি বলেন, আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে- যদি সাতচল্লিশে পাকিস্তান না হতো তাহলে আজ আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্র পেতাম না। আজকে আমরা হিন্দুস্তানের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক থাকতাম। তাই সাতচল্লিশকে অস্বীকার করে একাত্তরকে ধারণ করবেন, আর নতুন করে চব্বিশকে ধারণ করবেন তাহলে হবে না। আমাদেরকে সাতচল্লিশ, একাত্তর ও চব্বিশকে একসঙ্গে ধারণ করতে হবে।

 

তিনি আরও বলেন, আমি একাত্তরকে চিনি আমার মরহুম পিতা মুক্তিযোদ্ধা শফিউল আলম প্রধানকে দিয়ে, আর সাতচল্লিশকে চিনি আমার মরহুম দাদা মুসলিম লীগ নেতা ও পাকিস্তানের স্পিকার দমিরউদ্দীন প্রধানকে দিয়ে। তাই আমি রক্ত দিয়ে অনুভব করি- আমি যদি চব্বিশ হই তাহলে একাত্তর আমার পিতা ও সাতচল্লিশ আমার দাদা।

 

বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, যদি সাতচল্লিশকে স্বীকার করলেই পাকিস্তানি বা রাজাকার হতে হয়তাহলে আমি সেই গর্বিত রাজাকার।

 

জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামসুদ্দীন প্রীতি সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে বলেন, ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪এগুলো একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। সাতচল্লিশ, একাত্তর ও চব্বিশ কোনোভাবেই পরস্পরের বিরোধী নয় বরং একে অপরকে সম্পূর্ণ করে। যারা এই তিন ঐতিহাসিক অধ্যায় নিয়ে বিভক্তি সৃষ্টি করবে, তারা জাতির শত্রু এবং বাংলাদেশের সমৃদ্ধির পথে বাধাতাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দিতে হবে।

 

তিনি বলেন, যদি আমরা ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের সঙ্গে না যেতাম, তাহলে আজ আমাদের সিকিম, হায়দরাবাদ বা কাশ্মীরের মতো পরিণতি বরণ করতে হতো। পাকিস্তান আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ায় আমরা ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে পেরেছি। অন্যথায় আজও আমাদের গোলামির শৃঙ্খল পরতে হতো। তাই আমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করিসাতচল্লিশ ছিল আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি।

 

মোহাম্মদ শামসুদ্দীন জোর দিয়ে বলেন, মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধারণ করতে না পারলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদও সম্ভব নয়। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়েছিল শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের হাতে। সেই ধারাবাহিকতায় আজকের বাংলাদেশকে আগামীর পথে এগিয়ে নিতে হবেনইলে আমরা পথহারা হবো, আমাদের গৌরবময় অতীত ভুলে যাবো।

 

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মোহাম্মদ বেলাল হোসেন, জাগপার সদস্য মোহাম্মদ আলী, বাংলাদেশে অধ্যয়নরত পাকিস্তানে শিক্ষার্থী কামরান সাগর ও কাশিফ; জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের সহকারী সদস্য সচিব আব্দুস সালাম, সদস্য ডা. হাবিবুল্লাহ মারজান ও ওয়াসিম আহম্মদ; বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের সদস্য সচিব ফজলুর রহমান, সহকারী সদস্য সচিব ডা. নাবিল আহমদ ও মো. আশরাফুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক গোলাম নূর শাফায়েতুল্লাহ, সদস্য সচিব মুহিব মুশফিক খান, ঢাকা মহানগর উত্তরের সহকারী সদস্য সচিব মুহাম্মদ এমদাদুল হক, মাদরাসা-ই-আলিয়া ঢাকার সহকারী সদস্য সচিব শরীফ মিয়াসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।

 

এর আগে সকাল ৯টায় জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ ও বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত পাকিস্তান আন্দোলনের তিন জাতীয় নেতা শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, খাজা নাজিমউদ্দিন ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মাজার জিয়ারত করেন।

 

 

 

 

 

এছাড়া বাদ মাগরিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা অর্জনে অবদান রাখা পাকিস্তান আন্দোলনের নেতাকর্মীদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।