
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের কথা সবারই জানা। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করেন মেধাবী শিক্ষার্থী আববারকে। বুয়েট শুধু নয়, সারা দেশের প্রায় প্রতিটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল ছাত্রলীগের টর্চার সেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আবাসিক হলে তুচ্ছ কারণেই ছাত্রলীগের হাতে মারধরের শিকার হতো সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সংগঠনটির ভিন্নমতাদর্শী নেতাকর্মীরা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। জানাচ্ছেন ভয়াবহভাবে নির্যাতিত হওয়ার কথা।
এমনি একজন আয়াজ মোহাম্মদ ইমন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইনস্টিটিউট অফ মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ (আইএমএল) ইংলিশ ফর স্পিকারস অফ আদার ল্যাংগুয়েজেস (ইসোল) এর ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রদলের বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের আবাসিক এই শিক্ষার্থী সম্প্রতি তিনি ফেসবুকের এক পোস্টে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার কথা বর্ণনা করেন।
পোস্টে তিনি জানান, প্রথম বর্ষে থাকাকালীন সময়ে একদিন গেস্টরুম শেষে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের রুমে নিয়ে যায় তাকে। পরে ‘তুই বিএনপির (ফেসবুক) পেজে লাইক দিছিস, তুই ছাত্রদল করিস’ বলে রাত তিনটা পর্যন্ত নির্যাতন চালায় তার ওপর। শুধু তাই নয়, তাকে নির্যাতন করার পর ‘তুই বাড়িতে কল দিয়ে বল যে, তুই বিএনপি করিস। এজন্য তোরে হল থেকে বের করে দিচ্ছি’ বলে তাকে বলতে বাধ্য করান তারা।
নির্যাতনকারী অনুসারীরা শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মাসুদ লিমনের বলে জানিয়ছেন ভুক্তভোগী ইমন। আর আন্ডারগ্রাজুয়েট প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হওয়ার ২ মাস পর ২০১৬ সালের মার্চে এ ঘটনাটি ঘটেছিল।
আয়াজ মোহাম্মদ ইমন লেখেন, ‘পশুরাও মানুষের কষ্ট বোঝে এবং অনেক সময় মানুষের উপর আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে, অত্যাচারীরা তার থেকে ও অধম’—আমেরিকান ইতিহাসবিদ রবার্ট এ স্কলার উক্তিটি করেছিলেন অত্যাচারীদের সম্পর্কে। আমি আয়াজ মোহাম্মদ ইমন ২০১৫-২০১৬ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলাম। শৈশবে কত স্বপ্ন ছিল কতকিছুই ভাবতাম এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। সেই দীর্ঘ ৪৫০ কিলোমিটার দূর থেকে স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। ঢাকায় তেমন আত্মীয় না থাকার কারণে প্রথমে ভেবেছিলাম যে হলতো আছেই, ওখানেই থাকবো। কিন্তু তখন তো জানতাম না যে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই হলগুলোতে ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাসী সংগঠন প্রতিটি রুমকে টর্চার সেল বানিয়েছিল।২০১৬ সালের ১লা জানুয়ারি আমার বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাস শুরু হয়। কত আবেগছিল যে স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করবো। কিন্তু এই আনন্দ আর স্বপ্ন ধীরে ধীরে কেড়ে নিল সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ।
“সেই দিনগুলো, যে সময়ে কথা বলা হয়নি” শীর্ষক এই পোস্টে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল ছাত্রদলের সাবেক এই সাংগঠনিক সম্পাদক লেখেন, প্রতিদিন রাতে সন্ত্রাসীরা গেস্টরুম নামের টর্চার সেলে শুরু করতো নির্যাতন, অসভ্যের ন্যায় গালি গালাজ করতো আমাদেরকে। যদিও আগে থেকে জানতাম এই সংগঠনের লোকগুলো সন্ত্রাসী, অসভ্য। একদিন আমাকে গেস্টরুমে বললো যে, “তুই রাতে আমাদের রুমে আসবি , যে রুমে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা থাকতো।”
তিনি আরও লেখেন, গেস্টরুম শেষে আমি তাদের রুমে গেলাম। রুমে ঢোকার সাথে সাথে ই আমাকে বললো যে, “তোর ফোন দে”। আমি উত্তরে বললাম, “ভাই এইটা আমার ব্যক্তিগত ফোন, এইটা কেন দিব?”। এই কথা বলার সাথে সাথেই ২ জন সন্ত্রাসী নাজমুল ও ফয়সাল আমাকে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করলো। আর সাথে বলছিল যে, “তুই বিএনপির পেজে লাইক দিছিস, তুই ছাত্রদল করিস”। কী এক অসহ্য যন্ত্রণা। কেউ শুনেনি সেদিনের চিৎকার। আমাকে রাত ৩টা পর্যন্ত নির্যাতন করার পর বললো যে , “তুই বাড়িতে কল দিয়ে বল যে, তুই বিএনপি করিস এই জন্য তোরে হল থেকে বের করে দিচ্ছি। আর তোর ভাইরা কোন দল করে ওটাও বলতে বলবি ”। আমি তাদের বললাম যে , এতো রাতে কেউ ফোন রিসিভ করবে না। এইটা বলার পর আবারও আমাকে মারধর করতে থাকে । এক পর্যায়ে আমার অবস্থা দেখে একজন বলে উঠলো যে , “আর মারিস নাথাক, সকালে বের করে দেবো”।
ইমন লেখেন, কী যন্ত্রণা ছিল। সময়গুলো মনে পড়লে এখনো একা বসে কান্না করি। পরের দিন সকালে ক্লাসে যাই। আর ভয়ে সারাদিন হলে আসিনি। সন্ধ্যায় হলে আসলাম, রিডিং রুমে গিয়ে পড়তে বসলাম। রাত ৮টার দিকে কল আসলো আবার। উপর থেকে বললো, “গেস্টরুম আছে, তাড়াতাড়ি আসো”। গেস্টরুম নামক সেই নির্যাতন সেলে গেলাম, যাওয়ার সাথে সাথে লীগের সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি লাঠি দিয়ে আমাকে মারতে লাগলো। এক পর্যায়ে আমাকে হল থেকে বের করে দেয়। সাথে আমার কোনো জিনিসপত্র আনতে পারিনি।
‘‘তখন আনমুানিক রাত ১১টা বাজে । ইডেন কলেজের সামনে একা-একা বসে ভাবছিলাম যে কী করবো, কোথায় বা থাকবো। হঠাৎ এসএম হলের ছাত্র, আমার বন্ধু এরফান ও আমার ডিপার্টমেন্টের আশেক রায়হানকে ফোন করলাম, পুরো ঘটনা ওরা শোনার পর বললো যে, ‘চল এখন এসএম হলে গিয়ে থাকি। সকালে কোনো একটা ব্যবস্থা হবে।’ কোনো রকম আতঙ্কে রাত পার করলাম। সকালে উঠে জিগাতলায় এক বড় ভাইয়ের বাসায় উঠলাম। জিগাতলা থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে এসে ক্লাস পরীক্ষা দিতাম এবং ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। এভাবে আতঙ্কে চলতে থাকলো শিক্ষাজীবন।’’
২০১৯ সালে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদল মনোনীত ক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী (জিএস) ইমন আরও লেখেন, জীবন চলছিলো সাধারণ নিয়মে । এদিকে থেমেও থাকেনি আমাদের ওপর সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের হামলা। প্রায় সময়ই জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের হামলা ও নির্যাতন ছিল তাদের দৈনিক রুটিন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ছিলনা কোনো পদক্ষেপ। কারণ তখনকার প্রশাসনকে সরাসরি আওয়ামী প্রশাসনই বলা যায়। ক্যাম্পাসে আমাদের তেমন আড্ডা ছিল না, তবু বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে আমাদের রাজনৈতিক আড্ডা ছিল। ১লা নভেম্বর ২০১৮ সালের সন্ধ্যার কথা। এই ভয়াবহ সন্ধ্যা কখনোই ভুলবার না। আমরা তিনজন—বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় কমিটির মাসুদ ভাই, আমার সহযোদ্ধা বন্ধু নয়ন ও আমি ঢাকা মেডিকেল গিয়েছিলাম। ফেরার সময় মাসুদ ভাই বললেন যে, চলো টিএসসি তে এক কাপ চা খেয়ে যাই। তখন আমি বললাম, ভাই আমাদের জন্য নিরাপদ হবে না।
‘‘তবু শেষমেষ গেলাম টিএসসির স্বপন মামার স্টলে । তিনজনে চা নিয়ে বসলাম আর গল্প করছিলাম। হঠাৎ একজন অপরিচিত ছেলে এসে বললো ‘ভাই আপনাকে মনে হয় কেউ অনসুরণ করতেছে। আপনি এখান থেকে বের হয়ে যান তাড়াতাড়ি।’ আমি আর কোন চিন্তা না করে সাথে সাথে উঠে টিএসসির ডাচ বাংলা বুথের সামনে দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছি, আর মাসুদ ভাইকে বললাম ভাই আপনি আর নয়ন বাইক নিয়ে ঐদিকে আসেন। একটু পরেই পেছনে ১০/১৫ জন ছেলে লাঠি, বাঁশ, স্টাম্প দিয়ে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করলো। তখন আমি অসহায় ছিলাম। এতো এতো মানুষ টিএসসিতে, অথচ কেউই আসেনি সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করতে। এক পর্যায়ে মধ্য বয়স্ক একজন ভদ্রমহিলা দৌড়ে এসে বললেন, এই ছেলেকে মারতেছো কেন? ওর তো কোন দোষ দেখিনাই। ভদ্র মহিলা সবাইকে ডাক দিচ্ছিলেন সাহায্য করার জন্য, কিন্তু সন্ত্রাসীদের ভয়ে কেউই আসেনি। আমার পুরো শরীরে আঘাত নেই কোন জামা-কাপড়। হামলা শেষে আমার বন্ধু নয়ন বাইক উঠালো। আমরা প্রক্টর অফিসের সামনে গিয়ে প্রক্টর আমজাদ হোসেনকে ফোন করলাম কিন্তু সে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। লিখিত অভিযোগ দিলাম, তবুও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি তখনকার হাসিনার দালাল প্রশাসন। এক পর্যায়ে ভাবলাম যে এভাবে অভিযোগ দিয়ে কোন লাভ হবে না। আমার মতো শত শত নেতাকর্মীকে নির্যাতন করেছিলো সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের নেতারা। আমার ওপর ১লা নভেম্বরের হামলাটা করা হয়ে ছিল তখনকার জহুরুল হক ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সাকিবুর রহমান সায়েমের নেতৃত্বে। এতো হামলা, নির্যাতন– তবুও তো থেমে থাকিনি আমরা। আমাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম চলছিলো নিয়মিত। সর্বশেষ আতঙ্কের মধ্যে ও ২০১৯ সালের ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি।
"লড়েছিলাম জালিমের বিরুদ্ধে, লড়ে যাব আজীবন এই দেশের মানুষের জন্য। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।‘’