
বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলী ‘গুমের’ পর সিলেট-২ (বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর) আসনে ধীরে ধীরে তৎপর হন তাঁর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর (লুনা)। স্বামীর জনপ্রিয়তা আর নিজের আন্তরিকতা দিয়ে অল্পদিনেই স্থানীয় বিএনপিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। পান বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদও। এত দিন এই আসনে বিএনপির ‘একক প্রার্থী’ হিসেবে আলোচনায় ছিলেন তাহসিনা রুশদীর। তবে বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির সিলেট-২ আসন থেকে নির্বাচন করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় স্থানীয় রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
গত শুক্রবার বিশ্বনাথ উপজেলায় আয়োজিত সুধী সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ও বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির প্রার্থিতা ঘোষণা করেন। দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে থাকা এই নেতার এমন ঘোষণায় নড়েচড়ে বসেন তাহসিনার অনুসারীরা। পরদিন শনিবার তাঁরা ইলিয়াস আলীর সন্ধান চেয়ে বিশ্বনাথ পৌর শহরে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এটি গত এক যুগের মধ্যে ‘স্মরণকালের সবচেয়ে বড়’ বিক্ষোভ বলেও প্রচারণা চালান তাঁরা।
স্থানীয় বিএনপির একাংশের নেতা-কর্মীরা বলছেন, টানা ১৩ বছর ধরে তাহসিনা স্থানীয় বিএনপিকে সুসংগঠিত করার পাশাপাশি নিয়মিত এলাকা চষে বেড়িয়েছেন। বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনেও তাঁর সক্রিয় নেতৃত্ব ছিল। বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দুঃসময়ে তিনি পাশে থেকে সাহস আর উদ্দীপনা জুগিয়েছেন, কিন্তু এখন হঠাৎ এখানে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসে’ তাহসিনাকে টক্কর দিতে মাঠে নেমেছেন প্রবাসী নেতা হুমায়ুন কবির।
অন্যদিকে স্থানীয় বিএনপির আরেকটা অংশ মনে করছে, কেউ দেশে থেকে আবার কেউ বিদেশে বসে দলকে সুসংগঠিত করতে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছেন। হুমায়ুন কবির শোষক্ত ধারার নেতা। তিনি প্রবাসে থেকে দলের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। পাশাপাশি প্রবাসে থাকলেও দেশে থাকা তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
তাহসিনার অনুসারীদের অভিযোগ, হুমায়ুন কবির দেশে এসে প্রচার করছেন, তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়ে এলাকার উন্নয়নে মাঠে নেমেছেন। অথচ বিএনপির দুঃসময়ে দেশে আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর কোনো অবদানই নেই। স্থানীয় মানুষের সঙ্গেও তিনি জনবিচ্ছিন্ন। বিএনপি কিংবা দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও তাঁর পরিচিতি নেই। বরং সম্প্রতি দেশে এসে তিনি বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগরে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতাদের সক্রিয় উদ্যোগে আয়োজিত সুধী সমাবেশে অংশ নেন। এটি স্থানীয় বিএনপি ভালোভাবে নেয়নি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে আজ রোববার হুমায়ুন কবিরের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, দল মনোনয়ন দিলে আগামী সংসদ নির্বাচনে তিনি সিলেট-২ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান।
সিলেট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে গাড়িচালকসহ নিখোঁজ হন। বিএনপির অভিযোগ, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাঁকে ‘গুম’ করেছে। সিলেট বিএনপির একাধিক নেতা জানান, ২০১১ সালের মধ্যবর্তী সময় ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বন্ধের দাবিতে সিলেটে জোরালো আন্দোলন দানা বাঁধে ইলিয়াস আলীর নেতৃত্বে। আঞ্চলিক ইস্যুতে এমন আন্দোলন অতীতে কমই দেখা গেছে। ১৩ বছর আগে নিখোঁজ হলেও সিলেটে সব ধরনের নির্বাচনসহ আন্দোলন-সংগ্রামে ইলিয়াস আলী আলোচনায় ছিলেন।
স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলছেন, সিলেট-২ আসনে টানা তিনবার নির্বাচন করেছিলেন ইলিয়াস। এই নেতা বিজয়ী হয়েছিলেন দুবার। ২০০১ সালের আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ছিলেন সিলেট বিএনপির একক নেতা। এরপর ইলিয়াস আলীর উত্থান হলে দুই ধারায় সক্রিয় ছিল সিলেট বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো। পরে ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এক সড়ক দুর্ঘটনায় সাইফুর রহমানের মৃত্যু হলে ইলিয়াস আলী সিলেট বিএনপির একক নেতায় পরিণত হন। পরে ইলিয়াস নিখোঁজ হলে তাঁর অনুপস্থিতিকে দলীয় শক্তি হিসেবেই দল কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে।
এদিকে স্থানীয় বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, নিখোঁজ ইলিয়াস আলী জাতীয়ভাবে সুপরিচিত নেতা হওয়ায় সিলেট-২ আসনটি স্থানীয়ভাবে ‘ইলিয়াস আলীর আসন’ হিসেবে পরিচিত। সেখানে বিএনপির মনোনয়নে নির্বাচন করতে দীর্ঘদিন ধরেই মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন ইলিয়াস-পত্নী তাহসিনা রুশদীর। আগামী সংসদ নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পেলে জয় অনেকটা সুনিশ্চিত। তাঁর বাইরে অন্য কেউ মনোনয়ন পেলে ধানের শীষ প্রতীকের জয় পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। তাই আসনটিতে নিশ্চিত জয় পেতে তাহসিনার বিকল্প নেই।
যোগাযোগ করলে তাহসিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে (হুমায়ুন কবিরের প্রার্থিতা) কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
তবে স্থানীয় বিএনপিতে তাহসিনার ঘনিষ্ঠ এক নেতা বলেন, ‘১৩ বছর ধরে নির্বাচনী এলাকার মানুষ ইলিয়াস আলীর ফেরার প্রতীক্ষায় আছেন। তাঁর পরিবারের প্রতি ভোটারদের ভালোবাসা, আবেগ ও সহমর্মিতা রয়েছে। তাই ইলিয়াস-পত্নী ছাড়া কাউকে এখানে প্রার্থী হিসেবে কেউ কল্পনাও করতে পারছেন না।’
ওসমানীনগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি এস টি এম ফখর উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ইলিয়াস আলী নিখোঁজের পর থেকে এখানে তাহসিনা রুশদীর লুনাই বিএনপি কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিএনপির নির্যাতিত, নিপীড়িত নেতা-কর্মীদের তিনিই আগলে রেখেছেন। এই আসনে তাঁর কোনো বিকল্প নেই।