Image description

গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েছে বিএনপি। নির্বাচন, সংস্কারসহ নানা বিষয়ে দলীয় অবস্থান কূটনীতিকদের কাছে দলটির পক্ষ থেকে তুলে ধরা হচ্ছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিদেশিদেরও বিএনপির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। দলটির সঙ্গে দেশে অনেকবার বৈঠক করেছেন বিদেশি কূটনীতিকরা।

এমনকি লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গেও বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক এবং উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা বৈঠক করেছেন। এতে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থান, সরকার গঠন নিয়ে ভাবনা, জয় পেলে কীভাবে দেশ গড়তে চায়, দেশ ও জনগণ নিয়ে পরিকল্পনা, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন বিদেশিরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত বছর গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে নানা কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম তারেক রহমান। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জনপ্রিয় দল হিসাবে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বেশি বিএনপির। ক্ষমতায় গেলে বিএনপি কী করবে, তাদের পরিকল্পনা কী-সেই আগ্রহ থেকে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করছেন বিদেশিরা।

কারণ, তারেক রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাচ্ছেন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রধান ও উদার অর্থনীতির বিভিন্ন দেশের নেতারা। এজনই তারা তাদের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন দ্বিপক্ষীয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনার জন্য। তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক ইতিবাচক বার্তা দেয়।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবির যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন ঘোষণা হয়েছে, বাংলাদেশে যদি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়; তাহলে কোন দল জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেটা তো বিদেশিরা চিন্তা করছেন। সেই চিন্তার পরিপ্রেক্ষিতেই হয়তো তারা বোঝার চেষ্টা করছেন বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে দলটি কী করবে।

তাদের পরিকল্পনা কী, সেটা অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক কাঠামো, অর্থনীতি, কূটনীতি-এসব নিয়ে কী ভাবছে। তার (তারেক রহমান) সঙ্গে পরিচিত হতে চান তারা। সেজন্যই এই যোগাযোগ বলে আমার মনে হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে এই বিশ্লেষক বলেন, তাকে (বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) বুঝতে চাইছেন, সেই চাওয়াকেও একটি ইতিবাচক বিষয় বলে মনে করি। তারা বোঝার চেষ্টা করছেন এবং বক্তব্যটাও তার কাছে তুলে ধরছেন। যাতে তিনিও চিন্তা করতে পারেন যে তাদের (বিদেশিদের) প্রত্যাশ্যার জায়গা কতটুকু।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, তারেক রহমান একটা বড় দলের এখন শীর্ষ নেতা। আগামী দিনে নির্বাচন যদি ঠিকমতো হয়, স্বাভাবিকভাবে তিনি আরও বড় লিডারশিপে যাবেন। তাই নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে বিদেশিদের আগ্রহ রয়েছে।

লন্ডনে বিএনপির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্টের পর থেকে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, রাজনৈতিক নেতা এবং ব্যবসায়ীসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বৈঠক করছেন।

এসব বৈঠকে আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থান, সরকার গঠন নিয়ে ভাবনা, জয় পেলে কীভাবে দেশ গড়তে চায় বিএনপি, দেশ ও জনগণ নিয়ে পরিকল্পনা, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এরই অংশ হিসাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন। প্রায় দুই ঘণ্টার ওই বৈঠকে দুদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়াও বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার প্রসঙ্গে জানতে চান এই কূটনীতিক।

বৈঠকের শুরুতে তারেক রহমান ও যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স কুশল বিনিময় করেন। দলীয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের উন্নয়নে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র পাশে থাকবে বলে জানিয়েছেন দেশটির ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত। এছাড়া বৈঠকে লন্ডনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকের বিষয়টি আলোচনায় গুরুত্ব পায় বলেও সূত্রটি জানায়। এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির।

তিনি যুগান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের সঙ্গে বৈঠকটি ফলপ্রসূ হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে তারেক রহমানের ভাবনা, পরিকল্পনা এবং ভবিষ্যতে দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়নসহ স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন কাতারের একজন মন্ত্রী। এছাড়া বৈঠক করেছেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, কমনওয়েলথ ও উন্নয়নবিষয়ক দপ্তরের ইন্দোপ্যাসিফিক বিষয়ক পার্লামেন্টারি আন্ডারসেক্রেটারি অব স্টেট, ব্রিটিশ এমপি ক্যাথরিন ওয়েস্ট, ব্রিটিশ কনজারভেটিভ দলের গবেষণা উন্নয়নবিষয়ক সাবেক পরিচালক রজ ক্যাম্পসেল, ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক, ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস প্রমুখ।

জানা যায়, আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির পরিকল্পনা জানার পাশাপাশি বিএনপি সরকার গঠন করলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহের কথা জানাচ্ছেন বিদেশি কূটনীতিকরা।

এছাড়া রাষ্ট্র সংস্কারে বিএনপির ৩১ দফা নিয়েও ব্যাপক আগ্রহ বিদেশিদের। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বিদেশি প্রতিনিধিদের কথা শুনছেন এবং তার পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা করছেন। দেশের উন্নয়ন সম্ভাবনার ক্ষেত্রে প্রধান বাধাগুলোর বিষয়ও আলোচনায় স্থান পাচ্ছে।

বিএনপি এরই মধ্যে দেশবাসীর সামনে ৩১ দফা সংস্কার পরিকল্পনা তুলে ধরেছে। ওই পরিকল্পনায় রাষ্ট্র ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ পেলে ওই সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে দলটি।

এদিকে গত এক বছরে বাংলাদেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, জাপান, সৌদি আরবসহ ২২টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিভিন্ন সংস্থার কূটনীতিকরা বৈঠক করেছেন। পৃথক পৃথক এসব বৈঠকে জাতীয় নির্বাচন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, বিনিয়োগ, নতুন সরকারের সঙ্গে কাজে আগ্রহ প্রকাশ এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সহ বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হয়।

এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গেও বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। সর্বশেষ ২১ জুলাই খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ভুটানের রাষ্ট্রদূত দাশো খারমা হামু দর্জি। গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসভবনে (ফিরোজা) এ সাক্ষাৎ হয়। এ সময় বিএনপির চেয়ারপারসনকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান রাষ্ট্রদূত।

ওদিকে আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত কয়েক দফায় চীন সফর করেছে বিএনপির বেশ কয়েকটি প্রতিনিধিদল। সর্বশেষ গত জুনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে নয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল চীন সফর করেছে।

এই সফরের মধ্য দিয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন মির্জা ফখরুল। বিএনপির উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের এই সফর ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হতে যাচ্ছে, এজন্য সবার একটা স্বস্তি ও সন্তুষ্টি আছে। আশা রয়েছে, নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে যাবে দেশ। কারণ, অনেককিছু অপেক্ষা করছে একটা নির্বাচিত সরকারের ওপর, তাদের কর্মকাণ্ড, আগামী দিনে কী হবে। স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি অনেক সিদ্ধান্ত আছে। যেগুলো একটি নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সবাই স্বস্তিবোধ করে।