Image description

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের বহিষ্কৃত এক ছাত্রলীগ নেতার বিডিএস ইন্টার্নশিপ সনদ পাওয়া নিয়ে তোলপাড় চলছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজশাহীতে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার দায়ে গত বছর ৩ নভেম্বর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ১৫ জন ছাত্রলীগ নেতাকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার ও শাস্তি দিয়েছে।

 

 

তাদের মধ্যে অন্যতম ২৯তম ডেন্টাল ব্যাচের শিক্ষার্থী মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শাহরিয়ার রহমান সিয়াম। সিয়ামের ইন্টার্নশিপ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয় এবং তাকে ছাত্রাবাস থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়।

 

সিয়াম রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল অনুষদের শিক্ষার্থী ছিলেন। মাদক সেবনসহ গুরুতর বিভিন্ন অভিযোগে সিয়ামকে ছাত্রলীগ থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছিল।

 

অভিযোগ উঠেছে, শাস্তি পাওয়ার পরও সিয়াম পেয়েছেন বিডিএস ইন্টার্নশিপ পাশের চূড়ান্ত সনদ। সিয়াম রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এ সনদ পাওয়ার পর বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিবন্ধন পেতে আবেদনও করেছেন।

 

এদিকে বিষয়টি জানাজানি হলে গত ২৪ জুলাই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. আজিজুল হক আজাদকে প্রধান করে একটি পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। তদন্ত কমিটি রোববার এ বিষয়ে একটি বৈঠক করেছেন। কমিটিকে ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

 

কমিটির একটি সূত্র জানিয়েছেন, সিয়ামের কাগজপত্রে গরমিল রয়েছে। তারা দুই-এক দিনের মধ্যেই পরিচালক বরাবর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেবেন।

 

জানা গেছে, শাহরিয়ার রহমান সিয়াম বগুড়া জেলার নারুলী পশ্চিমপাড়া গ্রামের মাহফুজুর রহমানের ছেলে। গত বছর ৩ নভেম্বর ছয় মাসের বহিষ্কারের পর তিনি ইন্টার্নশিপে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। শাস্তি অনুযায়ী চলতি বছরের ৭ মে সিয়ামের বহিষ্কারাদেশের মেয়াদ শেষ হয়েছে। সেই হিসাবে ৮ মে থেকে বাকি সময়ের জন্য সিয়ামের নতুন করে ইন্টার্নশিপ শুরু করার কথা ছিল;  কিন্তু বাকি ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ ছাড়াই সিয়াম গত ১৫ মে বিডিএস ইন্টার্ন সনদ তুলে নিয়েছেন।

 

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৩ জানুয়ারি প্রফেশনাল বিডিএস পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ওই বছরের ১৮ জানুয়ারি থেকে সিয়াম ইন্টার্নশিপ শুরু করেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেন্টাল বিভাগে। এক বছরের ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামে গত বছর ৫ আগস্ট পর্যন্ত তিনি ছয় মাস ১৮ দিন বিডিএস ইন্টার্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর সিয়াম আত্মগোপনে চলে যান।

 

জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার মিছিলে হামলার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ওই বছরের ৩ নভেম্বর ছয় মাসের জন্য তার ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম বাতিল ও ইন্টার্ন ছাত্রাবাস থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। এক বছরের ইন্টার্ন প্রোগ্রাম সম্পন্ন করতে তার আরও ৫ মাস ১২ দিন বাকি ছিল।

 

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত বছরের ৬ থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত অর্থোডন্টিক্স, ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল (ওএমএস), ১৬ অক্টোবর থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত প্রস্থোডন্টিক্স এবং ৩০ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত কনজারভেটিভ ডেন্টিস্ট্রি বিভাগের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। এসব প্রশিক্ষণে সিয়ামের অংশগ্রহণ ছিল বলে ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করার সনদে সইও করেছেন বিভাগগুলোর প্রধানরা।

 

জানা গেছে, সিয়ামের ইন্টার্ন সনদটি প্রস্তুত হয় গত ১১ মে। এতে সই করা বিভাগীয় প্রধানরা হলেন অর্থোডন্টিকস বিভাগের সাবেক প্রধান ডা. আব্দুর রশিদ মণ্ডল, ওএমএস বিভাগের ডা. শরিফুল ইসলাম, প্রস্থোডন্টিকস বিভাগের ডা. জাকি আজম এবং কনজারভেটিভ ডেন্টিস্ট্রি বিভাগের ডা. ইসমাইল হোসেন। সনদে এসব বিভাগের প্রশিক্ষণ গ্রহণের ক্ষেত্রে মন্তব্যের ঘরে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে দক্ষতা চমৎকার।

 

তবে কনজারভেটিভ ডেন্টিস্ট্রি বিভাগের প্রধান ডা. ইসমাইল হোসেন বলেন, আমারসহ সব বিভাগীয় প্রধানের স্বাক্ষর জাল করে সনদ তৈরি করা হয়েছে বলে ধারণা করছি। ইন্টার্নশিপের হাজিরা খাতাতেও সিয়ামের স্বাক্ষর নেই। এরপরও সে কিভাবে সনদ পেল তা নিয়ে আমাদেরও প্রশ্ন।

 

এদিকে মূল্যায়ন প্রতিবেদনে শাহরিয়ার রহমান সিয়াম আবাসিক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। সিয়ামের সনদে আরও লেখা হয়েছে- তিনি ওয়ার্ড ও বিভাগে রোগীদের পরিচর্যার জন্য মেডিকেল অফিসার, সহকারী রেজিস্ট্রার ও ওয়ার্ড মেডিকেল অফিসারের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তার প্রশিক্ষণকে চমৎকার হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে।

 

অন্যদিকে হাসপাতালের নথিপত্রে দেখা গেছে, চূড়ান্ত ইন্টার্ন সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. এফএম শামীম আহমদ, সহকারী পরিচালক ডা.  আবু তালেব, ডেন্টাল ইউনিটের প্রধান ডা. আবুল হোসেন ও রামেকের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খন্দকার মোহাম্মদ ফয়সাল আলমের স্বাক্ষর রয়েছে।

 

জানতে চাইলে রামেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খন্দকার মোহাম্মদ ফয়সাল আলম বলেন, সিয়াম ছাত্র হিসেবে অনেক দিন আগে কলেজ থেকে বের হয়ে চলে গেছে। আমি অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়েছি আরও পরে। সে ইন্টার্নশিপ করেছে, এতে ডেন্টালের বিভাগীয় ও ইউনিট প্রধানরা স্বাক্ষর করেছেন, সেটা দেখে আমিও স্বাক্ষর করেছি। তবে রামেকের ডেন্টাল ইউনিটের প্রধান ডা, আবুল হোসেন এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান।

 

ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম সম্পন্ন না করেই কিভাবে ছাত্রলীগ নেতা সিয়ামকে ইন্টার্ন সনদ দেওয়া হলো? জানতে চাইলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. এফএম শামীম আহমদ বলেন, তার লগবুক ক্লিয়ার আছে, সবকিছু ঠিকঠাক পাওয়া গেছে। এসবের ভিত্তিতে তাকে সনদ দেওয়া হয়েছে। এর আগে ভেতরে কি ঘটেছে সেটা জানার জন্যই তদন্ত কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। গরমিল হলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও  নিতে পারবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।