Image description

চব্বিশের নৃশংস গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ। এখন পর্যন্ত বলা যায়, আগামী নির্বাচনে দলটি অংশ নিতে পারছে না। কিন্তু তাদের তৎপরতা নানাভাবে রয়েছে। প্রতি বিপ্লবসহ নানাভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরে আসার চেষ্টা করছে দলটির নেতারা। এর মধ্যে কিছু নেতাকর্মী ইতোমধ্যে বিভিন্ন দলের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। তবে বড় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিপুল ভোট ব্যাংক কোন দিকে যায়, সেদিকেই নজর স্বৈরাচার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর।

রাজনৈতিক মহল মনে করছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরাসরি অংশ নিতে না পারলে স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী দিতে পারে দলটি। এ ছাড়া দীর্ঘদিনের মিত্র ১৪ দলীয় জোটের বিভিন্ন দলের সাথেও ভোটের রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আশানুরূপ ফলাফল আসার সম্ভাবনা কম। তবে বিকল্প ভাবনাও রয়েছে, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের স্বারথী হতে পারে। আওয়ামী লীগ ভোটে অংশ না নিলে লাঙ্গলের জন্য বোনাস বলেই মনে করছেন জাতীয় পার্টির নেতারা। উভয় দলের একটি অংশ মনে করে আগামী ত্রয়োদশ নির্বাচনে নৌকার বিকল্প ছক লাঙ্গল। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোটে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত। নৌকার ভোট এক বাক্সে আনার ছক কষছে আওয়ামী লীগ। সেক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল নৌকার বিকল্প হতে পারে আওয়ামী সমর্থকদের জন্য। আগামী দিনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আদর্শগত মতপার্থক্য থাকলেও যেকোনো উপায়ে দেশের রাজনীতিতে ফেরাই মূল লক্ষ্য আওয়ামী লীগের।

এ দিকে আগামী নির্বাচনে এমন একটি সুযোগ আসলে জাতীয় পার্টির জন্য সুখবরই বলে মনে করছেন জাপার নেতারা। ৫ আগস্টের পর কিছুটা চাপে থাকা জি এম কাদেরের জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এবং দুই প্রভাবশালী নেতা সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারকে বহিষ্কার করার পর অতীতে বহিষ্কৃত ও ভিন্ন দল করা শীর্ষনেতাদের ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়। গত ১৪ জুলাই হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির বিভিন্ন অংশের নেতারা এক মঞ্চে আসেন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। জাতীয় পার্টি (রওশন এরশাদ), জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ও জাতীয় পার্টির (মতিন) নেতারাও এতে যোগ দেন।

জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, আমাকে বলা হয় আমি জাতীয় পার্টি ভেঙেছি। কিন্তু আমি দল ভাঙিনি, দল আমাকে বের করে দিয়েছে। আমার নেতৃত্বে আন্দোলন করে এরশাদকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছিলাম। আমি সব সময় বলে এসেছি ঐক্যের কথা। আজ এরশাদ সাহেবের স্মরণসভায় এসে বৃহত্তর ঐক্যের যে কথা শুনছি। তা যদি বাস্তবে কার্যকর করা যায়, তাহলে দেশ ও দেশের মানুষ উপকৃত হবে। স্মরণসভায় আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, দেশের শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পর নির্বাচন দিতে হবে। তিনি বলেন, নির্বাচন চাই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন হতে হবে।

 

অনুষ্ঠানে এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, মুজিবুল হক চুন্নু, জাতীয় পার্টির (রওশন এরশাদ) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ, জেপির মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম, জাতীয় পার্টির (মতিন) মহাসচিব জাফর আহমেদ জয়, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) প্রেসিডিয়াম সদস্য দিদারুল আলম চৌধুরী, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, নাজমা আক্তার, জিয়াউল হক মৃধা, জনতা পার্টি বাংলাদেশের (জেপিবি) প্রধান উপদেষ্টা শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, নির্বাহী চেয়ারম্যান গোলাম সারোয়ার মিলন, জাপার সাবেক নেতা নুরুল ইসলাম মিলন, লিয়াকত হোসেন খোকা, সাহিদুর রহমান টেপা, মোস্তফা আল মাহমুদ, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, জহিরুল ইসলাম জহির, জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

এ দিকে মুজিবুল হক চুন্নুকে সরিয়ে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে জাতীয় পার্টির মহাসচিব করেন জি এম কাদের। জি এম কাদের বরাবরই দ্রুত নির্বাচন দাবি করে আসছেন। তিনি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধেরও বিরোধিতা করে আসছেন বক্তৃতা বিবৃতিতে।

২০০৯ সালে জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের সমন্বয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার অধীনে বিএনপি-জামায়াত অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিলে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে বিনাভোটের এই নির্বাচনে অংশ নেয়। পুরস্কারস্বরূপ রওশন হন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। ২০১৮ সালে রাতের ভোটের নির্বাচনের পর প্রথম এরশাদ এবং তার মৃত্যুর পর ফের রওশন এরশাদ সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হন। ২০২৪ সালে কথিত নির্বাচনের পর জি এম কাদের হন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। বলা হয়ে থাকে, আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ ১৫ বছরে স্বৈরাচার হওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে জাতীয় পার্টির। আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টির এসব নেতা নির্বাচন সামনে এলেই দেশী-বিদেশী খেলায় যুক্ত হন। সেই খেলারই অংশ হিসেবে মাঠে নেমেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

ফিরে দেখা ২৭ জুলাই, ২০২৪ : গত বছরের জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। বিশেষ করে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিরস্ত্র আবু সাঈদকে পুলিশ সরাসরি গুলি করে হত্যার পর আন্দোলন ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। জাগ্রত হয় বিশ^ বিবেক। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া, উত্তরা, রামপুরা-বাড্ডা, মোহাম্মদপুর-বছিলায় ছাত্র-জনতার আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরাসরি গুলি করে। বন্ধ করে দেয়া হয় ইন্টারনেট পরিষেবা। সরকারি দলের ক্যাডাররাও রাস্তায় নামে অস্ত্র হাতে। ২১ জুলাই ২০২৪ শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের দেয়া রায় বাতিল করে কোটাপ্রথা বাতিল করে রায় দেন আপিল বিভাগ। ততদিনে প্রায় দেড়শ’ ছাত্র-জনতার জীবন প্রদীপ নিভে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় রক্তের দাগ। শিক্ষার্থীরা কিছুটা পিছু হটলেও দমন পীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার। গত ২৬ জুলাই একটি পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘হাসপাতালে কয়েক হাজার আহত, অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ’। শুধু রামপুরা-বাড্ডার দু’টি হাসপাতালেই ১৮০০ জন ভর্তি।

এদিন স্বৈরাচার শেখ হাসিনা বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ক্ষোভের আগুনে দগ্ধ রাজধানীর বিটিভি ভবন দেখতে গিয়ে চোখের পানি ফেলেন। ঘুরে আসেন ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালেও। কিন্তু উল্টো চিত্র ছিল আওয়ামী লীগের দোসর জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান রওশন এরশাদের। ২৭ জুলাই তিনি ক্ষোভের আগুনে পোড়া ও নষ্ট হওয়া রাজধানীর সেতু ভবন ও শেওড়াপাড়া মেট্রো স্টেশন পরিদর্শনে যান নেতাদের নিয়ে।

অসুস্থ শরীর নিয়েই নিজ অনুসারীদের নিয়ে রাজধানীর বনানীতে অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়া সেতু ভবন পরিদর্শনে গিয়ে গাড়িতে বসে রওশন এরশাদ সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন।

রওশন বলেন, সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তার নিন্দা জানানোর ভাষাও হারিয়ে ফেলেছি। যারা দেশের এত বড় ক্ষতি করেছে, তদন্তের মাধ্যমে তাদের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে বিচার করা প্রয়োজন। কোনো দেশের নাগরিক রাষ্ট্রের সম্পদ এভাবে ধ্বংস করতে পারে না। যারা করেছে, তারা দেশের শত্রু।

পরে রওশন এরশাদের লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান জাপা তার অংশের মহাসচিব কাজী মামুনুর রশিদ। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে পার্টির কো-চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম সেন্টু, গোলাম সরোয়ার মিলন, সুনীল শুভ রায়, প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম শফিকসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।