
আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেছেন, পুরোনো বয়ান আবার ফিরে আসছে। তিনি অভিযোগ করেন, একসময় বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে দেশের মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা হয়েছিল, এখন আবার ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ- এর নামে সেই একই ধরনের বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা চলছে।
শনিবার বিকেল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার অডিটোরিয়ামে ‘সঞ্চারণ’ ও ‘সেন্টার ফর বেঙ্গল স্টাডিজ-এর যৌথ প্রযোজনায় আয়োজিত আলোচনা সভায় আমার দেশ সম্পাদক এ কথা বলেন। আলোচনার বিষয় ছিল ‘জুলাই ও মুসলিম রাজনৈতিক কর্তাসত্তা’।
আলোচনায় আরও অংশ নেন- লেখক ও বুদ্ধিজীবী ডা. ফাহমিদ-উর-রহমান, হামাদ বিন খলিফা ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ড. উসামা আল-আযামী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিহান বিন ওমর।
মাহমুদুর রহমান বলেন, আগে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামপন্থীরা একসঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে লড়েছিল। এখন সেই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদই ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। এটি একটি সাংস্কৃতিক বিভাজনের দিকেই ইঙ্গিত করছে।
তিনি শাহবাগ আন্দোলনের সময়কার বিতর্কিত স্লোগান স্মরণ করে বলেন, ‘একটা দুইটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’ এমন স্লোগান এখনও শোনা যাচ্ছে। পাশাপাশি ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’ ধ্বনির পুনরাবৃত্তি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি বলেন, এই ধরনের স্লোগান জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করছে। এভাবে সাংস্কৃতিক বিভাজন তৈরি করে বিদেশি সম্প্রসারণবাদ আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।
মাহমুদুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতিযোগিতা হোক রাজনৈতিকভাবে, কিন্তু সেটা যেন একে-অপরের সাংস্কৃতিক যুদ্ধ হয়ে না দাঁড়ায়।
তিনি বলেন, আমাদের এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো আমাদের নিজেদের ন্যারেটিভকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা। না হলে এই কালচারাল যুদ্ধ আমরা হারব। আর কালচারাল যুদ্ধ হারলে আমাদের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে।
তিনি ‘জুলাই বিপ্লব’কে স্বাধীনতার নতুন অধ্যায় হিসেবে অভিহিত করেন এবং বলেন, বায়ান্ন তিপ্পান্ন বছর পরে এসে আমরা একটি ‘জুলাই বিপ্লব’ পেয়েছি। এই বিপ্লবকে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না।
মাহমুদুর রহমান বলেন, যেকোনো জাতির এগিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু নায়ক দরকার। আমরা জুলাই অভ্যুত্থানে আবু সাইদ, ওয়াসিম, মুগ্ধ, আনাসদের মতো অসংখ্য নায়ক পেয়েছি। এই হিরোদের হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না।
তিনি আরও বলেন, আনাস শহীদ হওয়ার আগে যে চিঠি লিখে গেছেন, সেটাই আমাদের সাহিত্য, সেটাই আমাদের সংগীত। আমাদের এইসব স্মৃতিকে একাডেমিক রূপ দিতে হবে, সাহিত্যে রূপ দিতে হবে। তাহলেই আমাদের জাতীয় চেতনা স্থায়ী ভিত্তি পাবে।
মাহমুদুর রহমান সরাসরি অভিযোগ করেন, শাহবাগ আন্দোলন বাঙালি রেনেসাঁর নামে হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা ছিল, যেখানে বাঙালি মুসলমানদের তাদের ধর্মীয় পরিচয় বাদ দিয়ে ঢুকতে হতো। এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান হয়েও তারা সেই তথাকথিত বাঙালিপনার আদলে জায়গা পায়নি।
তিনি বলেন, পাকিস্তান আমল থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে একপ্রকার সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল, যার ধারাবাহিকতায় শাহবাগ প্রতিষ্ঠা পায় এবং শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়।
তিনি দাবি করেন, চব্বিশের রক্তমাখা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও সেই বাঙালিপনা হেজিমোনির পতন ঘটেছে। তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া তরুণদের ভারতীয় আধিপত্যবাদ-বিরোধী স্পষ্ট অবস্থান আমাকে বিস্মিত করে। এটাই আমাদের ভবিষ্যতের পথ দেখাচ্ছে।
তিনি বলেন,বাংলাদেশে ভারতীয় হেজিমোনি এখনও শেষ হয়ে যায়নি। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ধরে নিয়ে ভারতের আধিপত্যবাদীরা আবারও ফিরে আসার চেষ্টা করছে।
তিনি সম্প্রতি সংঘটিত গোপালগঞ্জের ঘটনা ও মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, এই ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে তারা সুপরিকল্পিতভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। সুযোগ পেলেই তারা সক্রিয় হয়ে উঠছে। আমাদের এসব বিষয়ে সতর্ক নজর রাখতে হবে।
আলোচনার শেষভাগে মাহমুদুর রহমান বলেন, যারা একসঙ্গে থেকে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী মসনদ ভেঙ্গে দিয়েছিল, এখন তারাই পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। এটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
তিনি আশা ব্যক্ত করে বলেন, আগামী সময়টা হবে বাঙালি মুসলমানদের। এদেশের তরুণদের হাত ধরেই ভারতীয় আধিপত্যবাদ-বিরোধী মুসলিম রেনেসাঁ আমরা শিগগিরই দেখতে পাবো।