
একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা থাকার প্রশ্নে একমত হয়েছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। তারা প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান একই ব্যক্তির থাকার প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে। তবে, গুরুত্বপূর্ণ ওই তিনটি পদে একই ব্যক্তির থাকার বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপে সম্মত নয় বিএনপি। ফলে এ ইস্যুতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আর সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে আলোচনাকালে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে বিএনপি সমর্থন জানালেও ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ (সিপিবি) বাম-প্রগতিশীল দলগুলো। তারা সংবিধানের চার মূলনীতি বহাল রেখেই নতুন প্রস্তাব যুক্ত করার দাবি জানিয়েছে।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার সংলাপের ১৬তম দিনে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। দুপুরের খাবার বিরতির পর বিমান দুর্ঘটনার খবর পৌঁছলে শোক প্রস্তাব গ্রহণের পর সংলাপ মূলতবি করা হয়। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। সংলাপে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
সংলাপের সূচনা বক্তব্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, আমরা এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি কীভাবে? শুরুতে যার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি- সেটা হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। যে মুক্তিযুদ্ধ ব্যতিরেকে আমরা এখানে আসতে পারতাম না। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। আমি, আপনি ও আমরা সবাই যে জায়গায় উপনীত হয়েছি, তার সাফল্য ও ব্যর্থতা সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তিনি বলেন, একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলাম আমরা। এজন্য লাখ লাখ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। শুধু একদিনের সংগ্রামে সেটা হয়নি। একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে কেবল সেটা হয়নি। দীর্ঘদিনের সংগ্রামের মাধ্যমে সেই জায়গায় এসেছি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা এই রাষ্ট্র অর্জন করেছি উল্লেখ করে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, পরবর্তী সময়ে ৫৩ বছর ধরে আমরা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছি। আমরা চেষ্টা করেছি একটি গণতান্ত্রিক জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। সেই সংগ্রাম অব্যাহত আছে। সব রকম ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে সবাই মিলে, সব রকম মতপার্থক্য ভুলে একটা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ জায়গায় এসেছি। এ পটভূমিতে আজকে জাতীয় সনদের প্রশ্ন। সেটা আপনারা বিবেচনায় রাখুন। মুক্তিযুদ্ধ, ৫৩ বছরের সংগ্রাম এবং গত বছরে অভূতপূর্ব গণ অভ্যুত্থান, রক্তপাত ও প্রাণনাশ- সেগুলো আপনারা মনে রাখুন। সেই বিবেচনাগুলো সামনে রেখে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।
কমিশন সূত্র জানায়, বিগত দিনের আলোচনার ধারাবাহিকতায় ‘একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ প্রধান ও দলীয় প্রধান হতে পারবেন না’, এমন প্রস্তাবের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো মতামত তুলে ধরে। সে ক্ষেত্রে অধিকাংশ দল একমত হলেও বিএনপিসহ কয়েকটি দলের আপত্তি নিয়ে পরবর্তী আলোচনা শুরু হয়। সেখানে কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়, ‘সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হবে- সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধমীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’। ওই প্রস্তাব সমর্থন করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তবে আপত্তি জানায় সিপিবি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ, গণফোরামসহ কয়েকটি দল। তারা মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাহাত্তরের সংবিধানের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে কমিশনের প্রস্তাবিত মূলনীতি যুক্ত করার দাবি জানায়।
এ বিষয়ে সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, মহান মুক্তিযদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানের চার মূলনীতি বাতিল করে সংস্কার কমিশন নতুন প্রস্তাব করেছিল, আমরা সে প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছিলাম। আবার নতুন করে প্রস্তাব এনেছে। যে প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে সংবিধানের আগের চার মূলনীতি নাকচ করা হয়েছে। তাই আমরা আপত্তি জানিয়েছি। এ ক্ষেত্রে সমাধান হিসেবে বলেছি, মূলনীতি আরও সুনির্দিষ্ট করতে চাইলে প্রস্তাবটি হতে পারে, ‘সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির সঙ্গে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’ উল্লিখিত হবে। অন্যথায় এটা গ্রহণ করা যাবে না। কারণ বিষয়টা মুক্তিযুদ্ধে মূল চেতনা ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। এ ক্ষেত্রে মেজরিটি সিদ্ধান্তও গ্রহণযোগ্য নয়। সংবিধানের মূলনীতির পরিবর্তন কিংবা প্রতিস্থাপনে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে নয়, শতভাগ ঐকমত্যের ভিত্তিতেই করতে হবে। প্রয়োজনে এটা বন্ধ রাখতে হবে। সিপিবি ক্ষমতায় গেলে একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান থাকবে না বলে জানান তিনি।
এর আগে সংলাপে অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তার দল মনে করে দলীয় প্রধানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়টি উন্মুক্ত থাকা দরকার। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কোনো দলের সংসদীয় কমিটি যদি মনে করে তারা দলীয় প্রধানকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করবে, তাহলে গণতান্ত্রিক এ প্রক্রিয়ার সুযোগ বন্ধ করা ঠিক হবে না। প্রধানমন্ত্রী এবং তার সঙ্গে সংসদ নেতার ভূমিকাটা প্রায় অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত, এই দুই ক্ষেত্রে একত্রে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সংসদ নেতা থাকতে কোনো অসুবিধা নেই। আর সংসদীয় কমিটিতে সিদ্ধান্ত হয় দল কাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করবে। যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয় সংসদে অথবা জোট হয় তারা পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয় কোন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হবেন। এখন সেই ব্যক্তি যদি কোনো একটা দলের প্রধান হন। সে ক্ষেত্রে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয় না বা তার অযোগ্যতা থাকে না। কারণ এটা একটা গণতান্ত্রিক চর্চা। গণতন্ত্রে কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হলে তাকে অপশন হিসেবে রাজনৈতিক দলের প্রধানের পদটা ছাড়তে হবে, এরকম কোনো চর্চা সাধারণত দেখা যায় না। এটা (দলীয় পদ) তার গণতান্ত্রিক অধিকার। দলীয় প্রধানের যাতে তার অধিকারটা পূর্ণ থাকে সেজন্য আমরা বলেছি, এটা উন্মুক্ত থাকা ভালো।
সংলাপ শেষে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আমরা এক ব্যক্তি যাতে একই সঙ্গে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন সে বিষয়ে সংবিধানে নীতি প্রণয়ন করার প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান একই ব্যক্তি হলে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দলীয়করণ কীভাবে রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তা আমরা অতীতে বহুবার দেখেছি। গণভবনে রাষ্ট্রীয় পদ ব্যবহার করে দলের সম্মেলন অনুষ্ঠান করা ও বিভিন্ন জেলা সফরে গেলে রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ব্যবহার করার কারণে সরকারি রাজনৈতিক দল বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়, যা বৈষম্যের নামান্তর।
বিমান দুর্ঘটনায় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ মুলতবি : রাজধানীর উত্তরায় বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমানের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের সংলাপ চলাকালে এ শোক জানানো হয় এবং দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দিনের পরবর্তী অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করা হয়। দুর্ঘটনার পরপরই কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ শোকবার্তা পাঠ করেন। এরপর নিহত সদস্যের আত্মার মাগফিরাত কামনায় এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। কমিশনের পক্ষ থেকে আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করা হয় এবং তাদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হয়। কমিশনের সভায় উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সদস্যরা বিশেষ প্রার্থনায় অংশ নেন। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় আবারও এ সংলাপ বসবে বলে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।