
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বাড়ি বগুড়ায়। দশকের পর দশক এখানে রাজত্ব করেছে তার তৈরি করা দল বিএনপি। মাঝে সাড়ে ১৫ বছর জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে দুঃশাসন চালায় আওয়ামী লীগ। ওই সময় এখানে জাতীয়তাবাদী নেতাদের নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়। জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে ফিরেছে নির্বাচনের পরিবেশ। ভোটযুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছেন অভ্যুত্থানপন্থি সব দলের নেতাকর্মীরা।
জেলার ১২ উপজেলা নিয়ে গঠিত সাতটি আসন। স্বাভাবিক পরিবেশে আসনগুলোর প্রায় সব বিএনপির নিয়ন্ত্রণে থাকত। মাঝে দুবার জামায়াতে ইসলামী দুটি আসন জিতেছিল। নতুন বাংলাদেশে ভোটযুদ্ধ হবে এ দুটি দলের মধ্যেই। তাই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট হবে পুরোপুরি ভিন্ন। বগুড়ার মাটি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এখানে দলটির ভোটবাক্সে সব সময়ই জোয়ার থাকে। এবারও তেমনটাই প্রত্যাশা করছেন জাতীয়তাবাদী দলটির নেতাকর্মীরা। তবে সম্ভাব্য ইসলামপন্থি জোট হলে পাল্টে যেতে পারে হিসাবনিকাশ। বিএনপির জোয়ারের মাঝেও দুয়েকটি আসনে জাগতে পারে চর।
বড় দুটি দলের নেতাকর্মীদের ব্যাপক তৎপরতা থাকলেও খুব একটা সরব দেখা যাচ্ছে না ইসলামী আন্দোলনসহ অন্য ইসলামপন্থি দল এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির। এসব দলের সব শাখায় কমিটিও নেই। তবে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার নিজ এলাকা হওয়ায় একটি আসনে দলটির কিছুটা সক্রিয়তা লক্ষ করা যাচ্ছে।
বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা)
এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী চূড়ান্ত হলেও বিএনপির কয়েকজন নেতা কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আছেন। পাশাপাশি মাঠে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেনÑজেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি একেএম আহসানুল তৈয়ব জাকির, কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী সদস্য সাবেক এমপি কাজী রফিকুল ইসলাম, জিয়া শিশু-কিশোর সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন চৌধুরী, সারিয়াকান্দি উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান হিরু ও কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম টিটু।
জাকির ও রফিকুল বলেন, ‘আমরা যার যার অবস্থান থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করলেও দল যাকে টিকিট দেবে তার পক্ষেই গণজোয়ার তৈরি করে ধানের শীষকে জয়ী করব।’
জামায়াত একক প্রার্থী দিয়ে প্রচার চালিয়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ মো. শাহাবুদ্দিন মনোনয়ন পাওয়ার পরই বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এ আসনে জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে মাঠে নেমেছি। ইতোমধ্যে মানুষের হৃদয় জয় করতে পেরেছি। ফল ভালো হবে ইনশাল্লাহ।
বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ)
বিএনপির প্রার্থিরা এ আসনে বারবার নির্বাচিত হয়েছেন। সে হিসেবে এখানকার মাটি দলটির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এবার মনোনয়ন চাইছেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি এমআর ইসলাম স্বাধীন, শিবগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি মীর শাহে আলম, শিবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মতিয়ার রহমান মতিন, বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার ডা. ফিরোজ মাহমুদ ইকবাল ও সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট একেএম হাফিজুর রহমান।
হাফিজুর, শাহে আলম ও ডা. ফিরোজ বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে মনোনয়ন চাইলেও দলের পক্ষেই আছি। কেন্দ্র থেকে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে তার সঙ্গেই থাকব।’
জেলার একটি মাত্র আসনে তৎপর আছেন নাগরিক ঐক্যের নেতাকর্মীরা। দলটির সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না এ আসনে প্রার্থী হয়েছেন।
জামায়াত এখানে জেলা শাখার শূরা সদস্য ও সাবেক এমপি অধ্যক্ষ মাওলানা শাহাদাতুজ্জামানকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। শাহাদাতুজ্জামান বলেন, ‘দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে। বিগত সময়ে শিবগঞ্জের বিভিন্ন উন্নয়ন করেছি। জনগণ আমাকে অবশ্যই সমর্থন দেবেÑসেই দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে।’
বগুড়া-৩ (দুপচাঁচিয়া ও আদমদীঘি)
বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত এ আসনে ধানের শীষ পাওয়া জন্য যারা তৎপর আছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেনÑজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফজলুল বারী তালুকদার বেলাল, জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও শহর বিএনপির সভাপতি হামিদুল হক চৌধুরী হিরু, আদমদীঘি উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল মহিত তালুকদার, বগুড়া অ্যাডভোকেটস বার সমিতির সভাপতি আতাউর রহমান খান মুক্তা এবং আবদুল মোমেন তালুকদার খোকার স্ত্রী মাসুদা মোমেন।
হামিদুল, ফজলুল ও আতাউর বলেন, ‘দলের নমিনেশন এখনো চূড়ান্ত হয়নি। দল যাকে মনোনয়ন দেবে, আমরা তার পক্ষেই মাঠে নামব।’
জামায়াত ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে যেসব প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে, তাদের অধিকাংশই তরুণ। তাদের মধ্যে অন্যতম গার্ডিয়ান প্রকাশনীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, দুপচাঁচিয়া উপজেলার গুনাহার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা জামায়াতের সদস্য নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘এখানে জনমত আমাদের পক্ষে। এরপরও তরুণ ও যুবশক্তিবান্ধব বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এলাকায় আলোড়ন তৈরি করছি। ভোটারদের ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছি। আমরা জনগণের রায় নিয়েই আগামীতে জয়ের মালা পরব ইনশাল্লাহ।’
বগুড়া-৪ (কাহালু ও নন্দীগ্রাম)
আসনটি মূলত বিএনপি প্রভাবিত এলাকা। এবার দলের টিকিট চাইছেন জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন। পাশাপাশি আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শামিলা রহমানকে প্রার্থী করা হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। মোশারফ বলেন, ‘আগামীতে দল আমাকে মনোয়ন দেবেÑএটা বিশ্বাস করি। আমি যা কাজ করেছি তা থেকে জনগণ ধানের শীষকেই বিজয়ী করবে।’
জামায়াত আগেই ড. মোস্তফা ফয়সাল পারভেজকে প্রার্থী ঘোষণা করায় প্রচারেও রয়েছেন এগিয়ে। তিনি তার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি, পরিচিতি ও প্রভাবের কারণে ভোটারদের আস্থার শীর্ষে রয়েছেন বলে দাবি করেছেন।
বগুড়া-৫ (শেরপুর ও ধুনট)
এ আসনে বিএনপির কান্ডারি হতে চাইছেন দলটি সমর্থিত সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ, কেন্দ্রীয় বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মাহবুবর রহমান হারেজ, জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ধুনট উপজেলা বিএনপির সভাপতি একেএম তৌহিদুল আলম মামুন, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সুপ্রিম কোর্ট শাখার নেতা ব্যারিস্টার আনোয়ারুল ইসলাম শাহীন, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন এবং শেরপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি জানে আলম খোকা।
সিরাজ বলেন, ‘বিগত দিনে শেরপুর-ধুনট থেকে চারবার ও বগুড়া সদর থেকে একবার নির্বাচিত হয়েছি। এ আসনগুলোয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছি। এবারও মনোনয়ন পেলে সর্বোচ্চ ভোটে জেতার সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছি।’
জানে আলম বলেন, দলের জন্য কাজ করেছি। দল থেকে যাকে মনোনয়ন দেবে, তার পক্ষে আছি।
জামায়াত শেরপুর উপজেলা শাখার আমির ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান দবিবুর রহমানকে প্রার্থী করেছে। নানা কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি এলাকার মানুষের হৃদয়ে ভরসার পাত্র হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন বলে দাবি করছেন।
বগুড়া-৬ (সদর)
আসনটি মূলত বিএনপির। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রার্থী হওয়ায় এটিকে ভিআইপি আসন বলা হয়। এবার খালেদা জিয়া প্রার্থী না হলে সম্ভাব্য যারা আলোচনায় রয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট একেএম মাহবুবুর রহমান। এছাড়া বেশ কয়েকজন কেন্দ্রে তদবির করছেন বলে জানা গেছে।
জামায়াতের বগুড়া শহর শাখার আমির অধ্যক্ষ আবিদুর রহমান সোহেলকে প্রার্থী করায় প্রচারে বেশ সুবিধা পাচ্ছেন তিনি। এখানে দীর্ঘদিন সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করায় তার অনেক পরিচিতি রয়েছে। যে কোনো প্রার্থীর জন্য তাকে চ্যালেঞ্জ করা কঠিন হবে বলে তিনি দাবি করেন।
বগুড়া-৭ (গাবতলী ও শাজাহানপুর)
এ আসনও খালেদা জিয়াসহ শীর্ষ নেতাদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। আসনটিতে বিএনপির কে প্রার্থী হবেন, তা নিয়ে কেউ কোনো মন্তব্য করতে পারছেন না। স্থানীয় নেতারা ধরেই নিয়েছেন, এখানে খালেদা জিয়া অথবা তারেক রহমান প্রার্থী হবেন।
চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক এমপি হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু এবং গাবতলী উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোরশেদ মিল্টন বলেন, এটি বিএনপি এবং ধানের শীষের জায়গা। বিগত দিনে সর্বোচ্চ ভোটে দেশনেত্রীকে জয়ী করেছি। এবার আমরা তিনি এবং ধানের শীষের পক্ষে গণজোয়ার তৈরি করব।
এখানে সব সময় হেভিওয়েট প্রার্থী থাকে, সেটি বিবেচনায় নিয়ে মনোনয়ন দিয়েছে জামায়াত। দলটির জেলা শাখার সাবেক আমির গোলাম রব্বানীকে প্রার্থী করায় নতুন করে তাকে পরিচিত করানোর প্রয়োজন হবে না। তিনি সাবেক নেতা হিসেবে এলাকায় বেশ পরিচিত। তিনি বলেন, ‘আমার পরিচিতিই ভোটের মাঠে আমাকে এগিয়ে রাখবে।’