Image description

১৭ বছর ধরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে ইতিহাসের বর্বরোচিত নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা, গুম, হামলা-মামলা, গ্রেফতার-কারাবন্দীর শিকার হয়েছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। দলটির প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, বড় ছেলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোসহ কেন্দ্রের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ থেকে ওয়ার্ডের কর্মী-সমর্থকরাও এ থেকে বাদ যাননি। অবর্ণনীয় এসব নির্যাতনের শিকার হয়েও দীর্ঘ এই সময় ধরেই বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ থেকেছেন নেতাকর্মীরা। লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের। শুধু বিএনপি করার কারণে ঘর-বাড়ী ছাড়া হয়েছেন অনেকে, হারিয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য-চাকরিও। দল ত্যাগ করলেই অর্থ-সুন্দর জীবনের প্রলোভন থাকলেও তারা খেয়ে না খেয়ে রাত্রি যাপন করেছেন ক্ষেতে-খামারে। কিন্তু তারপরও দলের শীর্ষ নেতাদের প্রতি আনুগত্য ও আদর্শের প্রতি ছিলেন অবিচল। তাদের এই দুর্দমনীয় বিশ্বাস ও অঙ্গীকারের কারণে স্বৈরাচার আওয়ামী সরকার দেড় দশকে বহুবার বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করলেও সফল হয়নি।

আর আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে নির্বিঘেœ চালিয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য, নিয়েছেন নানান সুযোগ-সুবিধা, সখ্যতা রেখে চলেছেন আওয়ামী নেতা, মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে। ৫ আগস্টের পর তারাই এখন ভোল পাল্টে হঠাৎ বড় বিএনপি হয়ে গেছেন। দলীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে নেতাদের আশপাশে, সর্বত্রই এখন তাদের দৌরাত্ম্য। হঠাৎ গজিয়ে উঠা বসন্তের কোকিল এসব হাইব্রিড বিএনপি’র প্রতাপে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে লড়াই-সংগ্রামে থাকা ত্যাগী নেতাকর্মীরা। ৫ আগস্টের পর শুধু বিএনপি নাম ধারণই নয়, দখল, টেন্ডার, চাঁদাবাজীসহ জড়িয়ে পড়েছেন নানা অপকর্মে। যার দায় বহন করতে হচ্ছে বিএনপিকে। বসন্তের কোকিলদের এসব কর্মকা-ে অনেকটা বিব্রত দুঃসময়ে ত্যাগী নেতাকর্মীরা।

দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দলীয় কার্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন সড়কের অলিগলিতে হাইব্রিড নেতাদের ব্যানার, পোস্টার শোভা পাচ্ছে। বিভিন্ন নেতার বাসাবাড়ি কিংবা অফিসে এসব নেতার পদচারণাও বাড়ছে। ভিড় করছেন বিভিন্ন লবিং-তদবির নিয়ে। অন্যদিকে, দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে যেসব নেতাকর্মী রাজপথে ছিলেন, মামলা-হামলায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, ঘরছাড়া হয়েছেন, তারা এখন অনেকটা ‘অসহায়’। হাইব্রিড নেতাদের চাপে তাদের অনেকেই এখন দলীয় কার্যালয়, নেতাদের বাসাবাড়ি এড়িয়ে চলছেন। অহেতুক মিথ্যা অভিযোগে বহিষ্কার আতঙ্ক নিয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন অনেকে। বিএনপির একাধিক নেতা জানান, ৫ আগস্টের আগে নয়াপল্টনের কার্যালয়ে গুটিকয়েক নেতাকর্মীকে দেখা যেত। কিন্তু পটপরিবর্তনের পর এখন নেতাকর্মীদের ভিড়ে কার্যালয়ে ঢোকাই যায় না।

অথচ নব্য বিএনপি এবং দীর্ঘদিন নিষ্কিয় থাকা কোকিলদের বিষয়ে শুরু থেকেই সতর্ক অবস্থানে রয়েছে দলটি। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বারবার সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে চূড়ান্ত সফলতায় নিতে হলে কেউ দখলদারিত্বে লিপ্ত হবেন না, দখলদারিত্বে সহায়তা করবেননা। কেউ দুর্বলের উপর আঘাত হানবেন না। কেউ আইন নিজেদের হাতে তুলে নেবেন না। প্রতিশোধ প্রতিহিংসা নয় আসুন কার্যকর রাষ্ট্র সংস্কার নিশ্চিত করতে তারুণ্যের কাক্সিক্ষত একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে আমরা প্রত্যেকেই যিনি যার অবস্থান থেকে আরো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীসহ সারাদেশে বিএনপির নামে যেসব চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, দখলের ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগের সঙ্গে জড়িত ৫ আগস্টের পর অনুপ্রেবেশকারী ও দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থেকে পুনরায় সক্রিয় হওয়া হাইব্রিড নেতারা। যাদের আবার অধিকাংশেরই বর্তমানে কোন পদ-পদবী নেই। তবে তাদের অপকর্মের দায় পড়ছে বিএনপির ওপরে।

সারাদেশে হাইব্রিডদের দৌরাত্ম্য নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বিএনপির বর্ধিত সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও। নীলফামারী জেলা বিএনপির নেতা মাসুদ চৌধুরী বলেন, দলের ভেতরে বিশৃঙ্খলা দেখতে পাচ্ছি। কিছু সুবিধাবাদী দেখতে পাচ্ছি। এসব সুবিধাবাদীরা ত্যাগীদের বিতাড়িত করতে চায়। দলের অনেক নেতা ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এই ত্যাগীদের কথা যাতে আমরা ভুলে না যাই।

যশোরের আসাদুজ্জামান মিন্টু বলেন, প্রত্যেক জায়গায় হাইব্রিড ও গ্রুপিং রয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে গ্রুপিং দূর করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিএনপিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় নিতে হবে।
কুষ্টিয়ার জাহিদুল ইসলাম বিপ্লব বলেন, আমরা অনেক মামলা-হামলার শিকার হয়েছি। দলের দুঃসময়ে যারা ছিলেন না, সেসব সুবিধাবাদীরা এখন বিএনপিতে ভালো জায়গায় আছে।
দিনাজপুরের আব্দুস সালাম মিলন বলেন, ৫ আগস্টের পর বিএনপির ভেতরে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। তাদের চিহ্নিত করতে হবে। ত্যাগীদের কোণঠাসা ও বহিষ্কার করা হচ্ছে। পদ স্থগিত করা হচ্ছে। তাদের পদ ফিরিয়ে দিতে হবে। তৃণমূলকে জাগাতে হবে, হাইব্রিডদের ঠেকাতে হবে।

জামালপুরের জহিরুল ইসলাম পিন্টু বলেন, ৫ আগস্টের পর নব্য বিএনপি হয়েছে। তাদের জন্যই বিএনপির বেহাল দশা। আর মসজিদ ও মাদরাসার কমিটি নিয়ে ঝগড়া হয়, এগুলো থেকে সরে আসতে হবে।
নোয়াখালীর দেওয়ান শামসুল আরেফিন শামীম বলেন, বিগত ১৭ বছরে আন্দোলন-সংগ্রামে যাদের ডেকে পাইনি, তাদের দলে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাদের দায়িত্ব দিলে তারা দলের সঙ্গে বেঈমানি করবেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের যেকোন স্থানে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের যেকোন পর্যায়ের নেতাকর্মীই অন্যায়, অপকর্মে জড়িয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বিএনপি। এক্ষেত্রে ছাড় দেয়া হয়নি স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতাদেরকেও। আবার দলের পক্ষ থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ বারংবার সুস্পষ্টভাবে আহ্বান জানিয়েছেন যে, যারাই চাঁদাবাজী, দখলবাজীতে জড়িত হবে তাদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যেন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে দল কোন প্রতিবন্ধকতা নয়, বরং সহযোগিতা করবে।

বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা যায়, যাদের বিরুদ্ধে অপকর্মের অভিযোগ উঠেছে তদন্ত করে প্রমাণ পেলে বহিষ্কার করেছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিএনপি ও অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সাড়ে ৩ হাজারের মতো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মধ্যে বিএনপিরই প্রায় ২ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৭৫০ জনকে কারণ দর্শানো নোটিশ, ৯০০ জনকে বহিষ্কার, ১০০ জনের পদ স্থগিত, অন্তত ১০০ জনকে সতর্ক এবং ১৫০ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও এ পর্যন্ত ৪৫০ জনকে বহিষ্কার ও ৬৬০-এর অধিক নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়েছে। অঙ্গসংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের অন্তত ১২০ জনকে বহিষ্কার ও ১৭০ জনকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছে। যুবদলেরও শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকা- এবং দলীয় শৃঙ্খলার ব্যাপারে খুব কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, হাইব্রিড নেতাদের বিষয়ে তারা সতর্ক রয়েছেন। এরই মধ্যে দল থেকে নেতাকর্মীদের সতর্ক করা হয়েছে। দলে যোগদান অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। এরপরও বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির নাম ভাঙিয়ে অনেকে অনেক অপকর্ম করছেন। যাদের সঙ্গে বিএনপির ন্যূনতম কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তিনি বলেন, বিএনপির দুর্দিনে যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, পরিশ্রম করেছেন-দল তাদের মূল্যায়ন করবে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ বিষয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীকে বিভিন্ন সময়ে আশ্বস্ত করেছেন।

যুবদলের সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না বলেন, পটপরিবর্তনের পর ইতোমধ্যে সুযোগসন্ধানিদের ভীড় বেড়েছে। তবে দুঃসময়ে দল ছেড়ে যারা চলে গেছে তাদের কোনভাবেই প্রশ্রয় দেয়া হবে না। তাদের আর দলে কোন দরকার নেই। এছাড়া দীর্ঘদিন যারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন তাদেরকেও আগামীতে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। যুবদল সভাপতি বলেন, দল অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে জিরো নয়, মাইনাস টরালেন্স। যারাই কোন ধরণের অপকর্মে জড়িত হবে, দলের সুনাম ক্ষুণœ করবে, মানুষের আস্থা নষ্ট করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হচ্ছে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, পট পরিবর্তনের পর নব্যরা ফের সক্রিয় হয়েছে, দলের নতুনদের ভীড় বাড়ছে। তবে মনে রাখতে হবে নিপীড়িতরাই দলের প্রাণ। যারা দেড় দশকে ঘুমিয়ে ছিলেন, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছেন তাদের বিষয়ে তাদের বিষয়ে দল সতর্ক।