
শুরুটা হয়েছিল দারুণ এক স্বপ্ন নিয়ে। ‘প্রতিটি কৃষকের হাতে পৌঁছে যাবে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, বাড়বে উৎপাদন, বদলাবে ভাগ্য’—এই স্লোগানে ২০১৬ সালে শুরু হয় শেখ হাসিনার কৃষি ভাবনা নিয়ে ‘ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষক সেবাকেন্দ্র ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ (পাইলট) (দ্বিতীয় সংশোধিত)’ প্রকল্প। লক্ষ্য ছিল, প্রত্যন্ত এলাকার কৃষকদের হাতে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়া, প্রশিক্ষণ ও তথ্যভিত্তিক কৃষিতে উৎসাহিত করা। শুরুতে প্রকল্পটি প্রশংসনীয় বলে মনে হলেও প্রকল্পের গভীরে প্রবেশ করতেই বেরিয়ে আসে ভয়াবহ গাফিলতি, নজরদারিহীনতা ও দুর্নীতির স্পষ্ট প্রমাণ।
প্রকল্পটির আওতায় দেশের ২৪টি ইউনিয়নে কৃষক সেবাকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। গড় হিসাবে প্রতিটি সেবাকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা। এভাবে ২৪টি কেন্দ্র নির্মাণে মোট ব্যয় হয় প্রায় ৩৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ তিন দফায় ৩৬ মাস বাড়ানো হলে অতিরিক্ত ব্যয় হয় আরো ১২ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
সম্প্রতি প্রকল্পটির প্রভাব মূল্যায়ন করেছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিয়োগ করা আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান এমআরআই অ্যাসোসিয়েটস। তাদের প্রতিবেদনে প্রকল্পটির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
সৌরবিদ্যুৎ অচল, বঞ্চিত কৃষক
প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, দূরবর্তী ইউনিয়নে কৃষকদের জন্য এমন সেবাকেন্দ্র স্থাপন, যেগুলো দুর্যোগের সময়েও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগে সচল থাকবে। এ জন্য প্রতিটি ভবনে সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা রাখা হয়। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শনে দেখা গেছে, ২৪টি সেবাকেন্দ্রের মধ্যে ১৪টি কেন্দ্রের সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা অকার্যকর। এতে প্রায় ৬০ শতাংশ কেন্দ্র দুর্যোগকালে অচল হয়ে পড়ে। এই ব্যর্থতার কারণ হিসেবে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামতের ব্যবস্থা না রাখাকে দায়ী করেছে।
যন্ত্রপাতি চুরি ও ব্যবহারে অব্যবস্থাপনা
প্রতিটি কৃষক সেবাকেন্দ্রে আধুনিক কৃষি তথ্য সেবা প্রদানের জন্য কম্পিউটার, প্রিন্টার, মডেম, ডিজিটাল ক্যামেরা, ফটোকপি ও লেমিনেটিং মেশিন সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ২৪টি সেবাকেন্দ্রের মধ্যে আটটি কেন্দ্রে এসব উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে না। এর মধ্যে কোনোটি নষ্ট, আবার কোনো কেন্দ্র থেকে এসব যন্ত্রপাতি চুরি হয়ে গেছে।
ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুর কৃষক সেবাকেন্দ্র থেকে কম্পিউটার ও প্রিন্টার চুরির ঘটনা ঘটেছে, যার লিখিত অভিযোগও রয়েছে। কিন্তু এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিকার বা নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। এর চেয়েও উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, যেসব সেবাকেন্দ্রে এসব উপকরণ নেই বা নষ্ট, সেখানেও প্রতিবছর ‘ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ’ খাতে বাজেট দেখানো হয়েছে। প্রকল্পে তথ্য সংরক্ষণ ও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা বলা হলেও ডিজিটাল ডকুমেন্টেশন বা তথ্যভিত্তিক সেবা বাস্তবে নেই।
ভবন নির্মাণে মানহীনতা, রক্ষণাবেক্ষণে বাজেট নেই
সেবাকেন্দ্রের ভবন নির্মাণে একদিকে বরাদ্দ করা অর্থের অপব্যবহার, অন্যদিকে ভবিষ্যতে রক্ষণাবেক্ষণে কোনো বাজেট রাখা হয়নি। প্রতিবেদনে এটি প্রকল্পের অন্যতম বড় দুর্বলতা হিসেবে উঠে এসেছে। কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার মধ্যপাড়া কৃষক সেবাকেন্দ্র পরিদর্শনে দেখা যায়, নির্মাণের কয়েক বছরের মধ্যেই দ্বিতীয় তলার রেলিংয়ে মরিচা পড়েছে, ভবনের কিছু অংশে ফাটলও দেখা দিয়েছে। সেখানে স্থাপিত সোলার সিস্টেমও পুরোপুরি অকার্যকর। অফিসকক্ষে তিনটি কম্পিউটার থাকলেও ব্যবহার করা হচ্ছে না।
এ রকম সমস্যার তালিকায় আছে আরো কয়েকটি সেবাকেন্দ্র, যেখানে ভবনের অবকাঠামো দুর্বল হলেও কোনো মেরামত বা সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়নি। কারণ ভবিষ্যতের জন্য এ খাতে কোনো বাজেট রাখা হয়নি।
প্রকল্প প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কৃষকরা নতুন প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণে আগ্রহী, ডিজিটাল তথ্য ব্যবস্থাপনা চালু হয়েছে, সেবাকেন্দ্রগুলোর বহুমুখী ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের বাস্তব চিত্র ভিন্ন। কৃষকদের প্রশিক্ষণে সরঞ্জামের অভাব, ডিজিটাল রেকর্ড বা তথ্যভিত্তিক সেবা নেই, যন্ত্রপাতি নষ্ট বা ব্যবহারহীন, নেই প্রশিক্ষণের পর কার্যকর ফলোআপ।
নিজেদের কাজে নিজেদের মূল্যায়ন
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। বাস্তবায়ন শেষে এর কার্যকারিতা যাচাই বা ফলাফল মূল্যায়নের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে ডিএইকে। এতে কোনো নিরপেক্ষতা বা স্বচ্ছতার সুযোগ থাকেনি।
প্রকল্পটির এই অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে আইএমইডির সচিব মো. কামাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই প্রকল্পের পর্যবেক্ষণগুলো আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে পাঠাব। তারাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শেখ হাসিনার কৃষি ভাবনা হিসেবে পরিচিত এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অদক্ষতা, নজরদারিহীনতা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি প্রকল্পটিকে রূপ দিয়েছে কাগুজে সফলতায়। বাস্তবে এটি ব্যর্থতার এক স্পষ্ট উদাহরণ। প্রকল্পের যেসব তথ্য, সরঞ্জাম ও সুবিধা মাঠ পর্যায়ে পৌঁছানোর কথা, তা পৌঁছায়নি। বরং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার একতরফা মূল্যায়ন, চুরি, রক্ষণাবেক্ষণহীনতা এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যর্থতা মিলিয়ে পুরো কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ। প্রকল্পটির সুষ্ঠু অডিট, নিরপেক্ষ পর্যালোচনা এবং জবাবদিহি চাওয়া না হলে ভবিষ্যতে এমন উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোও হবে নতুন দুর্নীতির আলাদা ক্ষেত্র।