Image description

দুই হাজার আঠারো সালের ৩০ ডিসেম্বরের নিশিরাতের ভোটপ্রহসনের নির্বাচনটি কত ভুয়া এবং নিকৃষ্ট ছিল, সেটা নির্বাচন কমিশনার মরহুম মাহবুব তালুকদারই শুধু বলে যাননি, খলনায়ক সিইসি কেএম নুরুল হুদাও স্বীকার করেছেন।

ওই নির্বাচনে ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া সম্পর্কে সাবেক সিইসি নুরুল হুদার উক্তি ছিলÑ‘এ ভোট স্বাভাবিক নয়। শতভাগ ভোট পড়ায় অস্বস্তিতে ছিলাম।’ নৈশভোট সম্পর্কে ২০১৯ সালের ৯ মার্চ নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় তিনি বলেছিলেন, ‘ইভিএম মেশিনে যদি ভোটের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আর নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সভর্তি করার সুযোগ থাকবে না।’ অর্থাৎ নৈশভোট তিনি স্বীকার করে নেন। তেমনি সিইসি হিসেবে অবসর নেওয়ার পর ২০২২ সালের জুনে এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন করা স্পর্শকাতর ও চ্যালেঞ্জিং বিষয়।’ সর্বশেষ গ্রেপ্তার হওয়ার পর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে তিনি স্বীকার করেনÑতার সময়ে নিশিরাতের নির্বাচন হয়েছে। ওই নির্বাচন গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের তত্ত্বাবধানে হয়েছে। তিনি শতভাগ ভোট কাস্ট হওয়ার কথাও স্বীকার করেন।

ওই নির্বাচন সম্পর্কে মাহবুব তালুকদার বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের আগের রাতে ভোট হয়েছে, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। আর ২১৩টি কেন্দ্রে যে শতভাগ ভোট পড়েছে, সেই শতভাগ ভোট কেউই বিশ্বাস করবে না। কারণ নির্বাচনের আগের রাতে বাক্সভর্তি ব্যালটের ছবি বিবিসি প্রচার করেছে।’

শুধু শতভাগ ভোটই নয়, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থীরা অসংখ্য কেন্দ্রে শূন্য ভোট পানÑএমন অবিশ্বাস্য নজিরও স্থাপিত হয়েছে। নির্বাচনটির ছয় মাস পর নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রভিত্তিক যে ফল প্রকাশ করে, সেটা যে কেউ দেখলেই এমন নানা জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়বে।

যে কেউ www.ecs.gov.bd ওয়েবসাইটে ঢুকলে দেখতে পারেন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সারা দেশের কেন্দ্রভিত্তিক ফল। এর বাম পাশেই পাওয়া যাচ্ছে নির্বাচনি ফলাফল। সবাই এতে নিজ নিজ কেন্দ্রের ফলাফল দেখতে পারেন। তাহলে ৩০ ডিসেম্বর ওই কেন্দ্রে কেমন ভোট দেখেছেন আর পরে কেমন রেজাল্ট দেখছেনÑএ দুটো চিত্র মেলাতে পারবেন।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে (অনেকে বলেন ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন) ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন তাজুল ইসলাম। তিনি মন্ত্রী হন, আগেও মন্ত্রী ছিলেন। টকশো করেন, বেশ পরিচিত মুখ। তিনি তার এলাকায় এতটাই জনপ্রিয়(!) যে, সম্মানিত ভোটাররা প্রতিপক্ষের প্রার্থীকে শূন্য রেখে সব উজাড় করে দেন তাজুল ইসলামকে। একটি দুটি নয়, মোট ৯১ কেন্দ্রের মধ্যে অন্তত ৫১টি কেন্দ্রে ধানের শীষ প্রার্থীর ভোট শূন্য! পাঁচটি সেন্টারে একটি করে এবং ছয়টি সেন্টারে দুটি করে ভোট পান ধানের শীষের প্রার্থী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই যে ৯১টির মধ্যে ৬২ সেন্টারে ধানের শীষের প্রার্থী শূন্য বা দুয়েকটি করে ভোট পান, ওই সেন্টারগুলোয় ভোট পড়ার হার অন্য কেন্দ্রের তুলনায় বেশি। ওই কেন্দ্রগুলোর প্রায় সবগুলোতেই ভোট কাস্টিংয়ের হার ৯৪ থেকে ৯৯ শতাংশ। ভেবে দেখার বিষয়, কী জনপ্রিয় নেতা তিনি! ওই কেন্দ্রগুলোর এলাকায় বিএনপির কমিটিতে থাকা নেতারাও যেন কেন্দ্রে গিয়ে নৌকায় ভোট দিয়ে এসেছেন! যদি বিএনপি নেতারা নৌকায় ভোট না দেন তাহলে কী করে প্রায় শতভাগ ভোট পড়ার পরও ধানের শীষ ভোটশূন্য হয়?

নির্বাচনে আরো তুখোড় কারিশমা দেখিয়েছেন আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতা মরহুম মোহাম্মদ নাসিম। সিরাজগঞ্জ-১ আসনে তার প্রতিপক্ষ ধানের শীষের প্রার্থী জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী কনকচাঁপাকে হাজারখানেক ভোট ধরিয়ে দিয়ে তিনি জয়ী হন সোয়া তিন লাখ ভোটে! ওই আসনে ১৬৮ কেন্দ্রের মধ্যে ৮৫টিতে ধানের শীষের প্রার্থী পান শূন্য ভোট। ১১ কেন্দ্রে একটি ভোট করে, ১৩ কেন্দ্রে দুটি করে এবং ছয়টি কেন্দ্রে তিনটি করে ভোট পান ধানের শীষের প্রার্থী কনকচাঁপা। অথচ এসব কেন্দ্রেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতোই ভোট পড়ার হার ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ।

জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা ক্রিকেটার হিসেবে যেমন জনপ্রিয় তেমনি তুমুল জনপ্রিয় রাজনীতিতেও। তা না হলে নড়াইল-২ আসনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষের প্রার্থী অন্তত ২১টি কেন্দ্রে কী করে শূন্য ভোট পেলেন! এখানেও যথারীতি ধানের শীষে শূন্য ভোট পাওয়া কেন্দ্রেগুলোর বেশিরভাগে ভোট কাস্টিংয়ের হার ৯৫ শতাংশের বেশি।

কুমিল্লা-২ আসনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনও অন্তত তিনটি কেন্দ্রে শূন্য ভোট পান। কুমিল্লা-১০ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী তুখোড় ও জনপ্রিয় নেতা মনিরুল হক চৌধুরীকেও অন্তত চারটি কেন্দ্রে দেওয়া হয় শূন্য ভোট। এমনকি বিএনপির একচেটিয়া ঘাঁটি বলে পরিচিত বগুড়া-১ আসনেও অন্তত দুটি কেন্দ্রে ধানের শীষের প্রার্থীর ভাগ্যে জোটে শূন্য ভোট!

লক্ষীপুর-১ আসনটি সব সময়ই বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ওই ঘাঁটিতে ধানের শীষের প্রার্থী টিভি টকশোর জনপ্রিয় মুখ এলডিপি নেতা শাহাদত হোসেন সেলিম পান চার হাজারেরও কম ভোট। আর রাজনীতির মাঠে অপরিচিত নৌকার প্রার্থী পান এক লাখ ৮৫ হাজারেও বেশি ভোট। এখানে ধানের শীষের প্রার্থী অন্তত পাঁচটি কেন্দ্রে শূন্য ভোট পান। তিনি ১০০’র বেশি ভোট পান মাত্র চারটি কেন্দ্রে! এই হলো ইলেকশনের নমুনা।

মাদারীপুর-২ আসনে শাজাহান খানের বিপরীতে ধানের শীষের প্রার্থীও অন্তত ৩৫টি কেন্দ্রে শূন্য ভোট পান। মাদারীপুর-শরীয়তপুর অঞ্চলে ধানের শীষের প্রার্থীর শূন্য ভোটের আধিক্যের সঙ্গে লক্ষণীয় বিষয় হলো, দুয়েকটি কেন্দ্র বাদে তাদের ভোট কোথাও দুই সংখ্যা অতিক্রম করতে পারেনি। বেশিরভাগ কেন্দ্রে দুই-চার ভোট দিয়েই ধন্য করেছে তাদের।

সারা দেশের চিত্র প্রায় একই রকম ছিল। তবে এক্ষেত্রে দেশসেরা জনপ্রিয়! নেতা গোপালগঞ্জ-১ আসনের ফারুক খান। গোপালগঞ্জ-৩ আসনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিপক্ষ ধানের শীষের প্রার্থী ১২৭ ভোট পেলেও ফারুক খানের আসনে পান মাত্র ৫৭ ভোট! এখানে ১৩৩ কেন্দ্রের মধ্যে ১২২টি কেন্দ্রে ধানের শীষের ভোট শূন্য! বাকি ১১ কেন্দ্রে ৫৭ ভোট পান ধানের শীষের প্রার্থী। ফারুক খান পান ৯৯ শতাংশ ভোট। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ ভোট পেলেও তার আসনে ১০৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ধানের শীষ শূন্য ভোট পায় ৮৯টি কেন্দ্রে। বাকি ১৯ কেন্দ্রে ধানের শীষের প্রার্থী পান ১২৭ ভোট। তার মানে হলো, শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার গোপালগঞ্জে শেখ হাসিনার চেয়েও বেশি জনপ্রিয় ফারুক খান!

৯৯ শতাংশ ভোট পাওয়া প্রার্থীর মধ্যে তিনি ছাড়াও আছেন সিরাজগঞ্জ-১ আসনের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মরহুম মোহাম্মদ নাসিম, গোপালগঞ্জ-২ আসনের পলাতক শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মাদারীপুর-১ আসনের পলাতক নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন এবং শরীয়তপুর-১ আসনের ইকবাল হোসেন। এসব আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা ১ শতাংশের কম ভোট পান।

ওই নির্বাচনে বেশিরভাগ আসনে জয়ী প্রার্থীদের সঙ্গে পরাজিতদের ভোটের ব্যবধান লাখের বেশি। সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়ী হন ঢাকা-১৯ আসনে (সাভার) আওয়ামী লীগের প্রার্থী গ্রেপ্তারকৃত ডা. মো. এনামুর রহমান। তার সঙ্গে বিএনপির প্রার্থীর ব্যবধান ছিল চার লাখ ২০ হাজার ৬৪৮ ভোটের।

বিএনপির বড় নেতারাও ওই নির্বাচনে হারেন বড় ব্যবধানে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মরহুম মওদুদ আহমদ নোয়াখালী-৫ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে। ওই আসনে মওদুদ পান ১০ হাজার ৯৭০ ভোট আর ওবায়দুল কাদের পান মোট ভোটের ৯৩ শতাংশ বা দুই লাখ ৫২ হাজার ৭৪৪ ভোট।

নরসিংদী-২ আসনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান পান সাত হাজার ১৮০ ভোট। ওই আসনে আওয়ামী লীগের আনোয়ারুল আশরাফ খান এক লাখ ৭৫ হাজার ৭১১ ভোট পান।

এই যে ধানের শীষের প্রার্থীর শূন্য ভোট আর আওয়ামী লীগের প্রার্থীর এত এত ভোট, সেখানে নতুন মাত্রা যোগ করে দুই শতাধিক কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ে। ওই নির্বাচনে ৪১ হাজারের বেশি কেন্দ্রে ভোট হয়। এতে ২১৩ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ে। সাত হাজার ৬৮৯ কেন্দ্রে ৯০ থেকে ৯৯.৯৯ শতাংশ ভোট পড়ে। সংসদ নির্বাচনে গড় ভোট দেখানো হয় ৭৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা ও পৌর কমিটি মিলে একটি আসনে বিএনপি এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শুধু কমিটিতে থাকা নেতার সংখ্যা অন্তত ১০ হাজার। তাদের পরিবারের সদস্য না হয় বাদই দিলাম, সেখানে এই যে ধানের শীষের শূন্য ভোট ও একটি আসনে সর্বসাকুল্যে ৫৭ বা ১২৭ ভোট পাওয়া, সেটা কি কোনো হিসাবে মেলে? ধরে নিলাম ওই এলাকায় বিএনপির নেতারাও ভোট দিতে যাননি। তাহলে সেসব কেন্দ্রে আবার শতভাগ বা ৯৮-৯৯ শতাংশ ভোট পড়ল কী করে? আর ভোটার লিস্ট হওয়ার পর কেউ বিদেশে, কেউ অসুস্থ, কেউ নির্বাচনি কাজে অন্য এলাকায় থাকাসহ নানাবিধ কারণে শতভাগ ভোট পড়া একেবারেই অসম্ভব। অসংখ্য কেন্দ্রে বিএনপির শূন্য ভোট ও ২১৩ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া ভুয়া ও নিকৃষ্ট নির্বাচনেরই প্রমাণ।

শতভাগ ভোট পড়া নিয়ে গ্রেপ্তারকৃত সাবেক সিইসি কেএম নুরুল হুদাও অবাক হন। তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক মনে হয় না। কিন্তু প্রিসাইডিং ও রিটার্নিং কর্মকর্তা যেহেতু এ বিষয়ে আগে কিছু জানাননি, তাই এখন ইসির কিছু করার নেই। মামলা হলে আদালত যদি নির্বাচন বাতিল করে ফের নির্বাচন দেয়, সেটি আদালতের এখতিয়ার।

নির্বাচন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন ছিলÑভোট গ্রহণে নিয়োজিত কর্মকর্তারা আগে জানাননি কিন্তু ছয় মাস পর তো জানলেন। তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না? আসলে সেই খলনায়ক সিইসি বাহিনী সবই করে জেনে-বুঝে পরিকল্পনামাফিক। সেই সিইসি নুরুল হুদা এও জানেন, নির্বাচনে এই ভয়াবহ জালিয়াতি নিয়ে কেউ আদালতে গেলেও তা নিষ্পত্তি হতে হতে সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। ততদিনে তিনিও হয়তো আর সিইসি থাকবেন না। তাই সাংবাদিকদের কাছে তখন ছিল তার এ কৌশলী উত্তর।