
অনেকদিন ধরে আমাদের দেশে মেধাভিত্তিক রাজনীতি অনুপস্থিত। এটাকে এখন মেধাভিত্তিক রাজনীতি করতে হবে। এখন বিশ্ব বদলে গেছে, দেশ বদলে গেছে, মানুষ বদলে গেছে, প্রেক্ষাপটও বদলে গেছে। সুতরাং এটা যারা করবে না রাজনীতিও হবে না, দেশ গড়াও হবে না। দেশ গড়তে হলে মেধাবী রাজনীতিবিদ লাগবে।
জাগো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক খালিদ হোসেন।
জাগো নিউজ: আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন না হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ষড়যন্ত্র দেখেন কি না?
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: না না, কেন ষড়যন্ত্র দেখবো? একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে লন্ডনে। একটা জয়েন্ট স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সরকারের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলের জয়েন্ট স্টেটমেন্ট কেউ দেখেছে? জয়েন্ট স্টেটমেন্ট পড়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। আমি তো পড়িনি। সরকারের কমিটমেন্ট না থাকলে উনারা জয়েন স্টেটমেন্টে যেতো? আমি মনে করি না। আমি কেন সন্দেহ করবো? কেন প্রশ্নবিদ্ধ করব? প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো কোনো ঘটনা ঘটেছে?
লন্ডনের বৈঠকে বাংলাদেশের মানুষ স্বস্তি ফিরে পেয়েছে। নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে, নির্বাচন কমিশনও তাদের কাজ শুরু করছে। বাংলাদেশে এখন প্রত্যেক এলাকায় প্রার্থীরা দৌড়াচ্ছে, লন্ডনের মিটিংয়ের পর থেকে। নমিনেশন ফাইনাল হচ্ছে বিভিন্ন দলের ভেতরে ভেতরে।
এখানে বৈঠককে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ তো ঘটে নাই। আমি প্রশ্নবিদ্ধ করব? আমি সোসাইটির সব জায়গায় বলি, ট্রাস্ট থাকতে হবে, ট্রাস্ট ছাড়া একটা জাতি চলতে পারে না। কেউ যদি ট্রাস্ট ভঙ্গ করে তো তার সমস্যা। কিন্তু বিএনপির সমস্যা না। লন্ডনে যে বৈঠক হয়েছে, বৈঠক যে পরিবেশে হয়েছে এবং যে কথাগুলো হয়েছে, যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এটা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মতো কোনো সন্দেহ দেখি না। এটা হাই প্রোফাইল মিটিং হয়েছে, সারা দুনিয়া দেখেছে।
জাগো নিউজ: ইসলামিক দলগুলোসহ ১১টা দল বলছে যে আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট দিতে হবে, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিতে হবে। এটাতে অস্বস্তি দেখছেন কি না?
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: না, কেন অস্বস্তি দেখব? প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের অধিকার আছে তার কথা বলার। সে সেগুলো বলবে, সে চেষ্টা করবে কিন্তু সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণের, তাই না? আমরা যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করি এবং প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলের কথা আমি বলছি, ইনক্লুডিং সবার জন্য বলছি, কেউ যদি রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করে তাহলে জনগণের কাছে আগামী নির্বাচনে এটা নিয়ে যেতে হবে। ইমিডিয়েটলি, জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে হবে আমাদের, তাই না? আমি যদি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পৌঁছতে না পারি, যেখানে জনগণ ভোটাধিকার দিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে, একটি সংসদ করতে পারবে, একটি সরকার গঠন করতে পারবে, যে সরকার তাদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। যেটা এখন অনুপস্থিত বাংলাদেশে।
১৫-১৬ বছর ধরে একই কথা বলছি, বাংলাদেশের মালিক তো জনগণ, মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মালিকের কাছে যেতে হবে। প্রত্যেকটা দলের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা দর্শন থাকবে। আমরা তো আর বাকশালও করতে বসি নাই যে সব এক জায়গায় মিলে যেতে হবে, সব এক জায়গায় মানতে হবে, আমরা যা বলছি তা করতে হবে। তাহলে তো বাকশাল হয়ে গেলো। প্রত্যেক দলের ভিন্নমত থাকবে, দর্শন থাকবে, ভাবনা থাকবে। তারা তাদের কাজ করতেছে। সুতরাং তারা বলবে এবং তাদের প্রতি আমার রেসপেক্ট থাকবে। আমি তার সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করলেও তার প্রতি সম্মান দেখাতে তো অসুবিধা নেই। ভিন্ন মত পোষণ করবে কিন্তু তার মতের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। মত তো ভিন্ন হবে। কারণ সে তো আলাদা পার্টি, সে তো আমার দলের কেউ না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে হবে।
কোনো পাঁচজন-দশজন বিজ্ঞ মানুষ বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশে মানুষের সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার কারও নেই। আমারও নেই। দিন শেষে বাংলাদেশের জনগণ এ সিদ্ধান্ত দেবে বাংলাদেশের আগামী দিনে কী পরিবর্তন আসবে, কী সংস্কার আসবে, কোন দিকে যাবে? এবং যে সরকার নির্বাচিত হবে তারা দায়বদ্ধ থাকবে। শেখ হাসিনা নির্বাচিত না হওয়ার কারণে তার কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না, জবাবদিহিতা ছিল না, যা ইচ্ছে তাই করছে, দিনকে রাত করছে, গুম-হত্যা চালিয়ে গেছে, লুটপাট করে খেয়ে ফেলেছে।
আমাদের প্রথমত নির্বাচনের মাধ্যমে একটা নির্বাচিত দায়বদ্ধ জবাবদিহিতা সরকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করা প্রধান দায়িত্ব। এর মাধ্যমে প্রত্যেকটি দলের অধিকার আছে তারা জনগণের কাছে যাবে, তাদের এজেন্ডা নিয়ে যাবে, জনগণের সমর্থন নিয়ে তারা সংসদে আসবে, সংসদে সেটা বিতর্ক হবে, তর্ক হবে, আলোচনা হবে, সেটা পাস হবে অথবা পাস হবে না। ওদিন পাস না হলে আগামীতে আবার পাস হতে পারে, এটা তো একটা কারেকশন প্রসেস ডেমোক্রেসি, একটা কারেকশন প্রসেস, একটা ফিল্টারেশন প্রসেস। এই প্রসেস তো অব্যাহত না থাকার কারণে দেশ আজকে এখানে গর্তের মধ্যে। আমাদের এই প্রসেস শুরু করতে হবে, অব্যাহত রাখতে হবে এবং সকলের কথা বলার, জনগণ কাছে যাওয়ার অধিকার থাকবে, ফ্রিলি। কাউকে আমি বাধাগ্রস্ত করতে পারব না। কারো প্রতি বিদ্রুপ কিংবা অন্যরকম এই যে একটা টক্সিক পরিবেশ সৃষ্টি করা- এটা কিন্তু দেশের জন্য ভালো না। যত হাজার রিফর্ম করেন না কেন কোনো লাভ হবে না, যদি আমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান না থাকে। দ্বিমত পোষণ করুক, আমার তাকে সম্মান দিতে হবে। এই জায়গায় আসতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হবে, মন-মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের যে মনোজগতে পরিবর্তন আসছে, এটা বুঝতে হবে, ধারণ করতে হবে, ওইভাবে চলতে হবে।
জাগো নিউজ: বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সন্তানেরা যারা রাজনীতিতে জড়িত—আগামী নির্বাচনে তাদের মনোনয়নের ব্যাপারে দল কি ভাবছে?
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: অবশ্যই ভাবছে। যাদের যোগ্যতা, দলীয় কাজে অবদান ও সুনাম আছে—তাদের সামনে আনা হবে। ইয়াং জেনারেশনকে নেতৃত্বে আনতেই হবে। আমরা তো আর সারাজীবন রাজনীতি করতে পারি না।
জাগো নিউজ: তাহলে তরুণরাই প্রার্থী হিসেবে বেশি এগিয়ে থাকবে?
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: বেশি কমের ব্যাপার না—যাদের মেধা, শিক্ষা, যোগ্যতা ও জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, তারাই মনোনয়ন পাবে। বিএনপি চায় কোয়ালিটি সংসদ—যেখানে প্রতিটি প্রতিনিধি যুক্তি ও কাজ দিয়ে অবদান রাখতে পারে।
আমরা তো আগে থেকেই বলেছি, রাজনীতির মানোন্নয়নের জন্য ‘আপার হাউস’ দরকার—এটাই আমাদের প্রস্তাব ছিল আট বছর আগে।
জাগো নিউজ: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন যোগ্যতা কী হবে?
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: যোগ্যতার মধ্যে সবকিছু বিবেচনায় আসে। কেউ পিএইচডি করছে, আবার কেউ হয়তো কম লেখাপড়া করলেও তার অনেক গুণাবলী আছে। জনগণের জনসেবায় তার গুণ আছে, তার রাজনীতিতে অবদান আছে এবং তার সততা আছে, এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা আছে। অনেক দেশের প্রাইম মিনিস্টারও হয়েছে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট। বেগম খালেদা জিয়ার মতো যোগ্য প্রাইম মিনিস্টার আজকে বাংলাদেশের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য জননেত্রী। বেগম খালেদা জিয়া উনার কী কোয়ালিফিকেশন লাগবে? উনার কোয়ালিফিকেশন তো উনার কাজ।
গভর্মেন্ট সিভিল সার্ভিসে এখানে জয়েন্ট সেক্রেটারি হবে, তারপর অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি হবে, তারপর সেক্রেটারি হবে। পলিটিক্স হচ্ছে তোমার যোগ্যতা, তোমার জনগ্রহণযোগ্যতা, তোমার সততা, তোমার মেধা এগুলোর ওপর রাজনীতি হবে। অনেকদিন ধরে আমাদের দেশে মেধাভিত্তিক রাজনীতি অনুপস্থিত। এটাকে এখন মেধাভিত্তিক রাজনীতি করতে হবে। এখন বিশ্ব বদলে গেছে, দেশ বদলে গেছে, মানুষ বদলে গেছে, প্রেক্ষাপটও বদলে গেছে। সুতরাং এটা যারা করবে না রাজনীতিও হবে না, দেশ গড়াও হবে না। দেশ গড়তে হলে মেধাবী রাজনীতিবিদ লাগবে।
মেধাবী রাজনীতিবিদ ছাড়া দেশ গড়া যাবে না। দেশ চালাতে হলে মেধাবী রাজনীতিবিদ লাগবে। আগের মতো আমি লাইন ধরে কিছু মন্ত্রী বানিয়ে দিলাম-এগুলো হবে না।
জাগো নিউজ: আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট হতে যারা সহায়তা করেছে তারা যদি বিএনপির সঙ্গে থাকার চেষ্টা করে বা সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চান তাদের ক্ষেত্রে দলের অবস্থান কী?
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: প্রশ্নই আসে না। বিএনপির চেয়ে বড় ভুক্তভোগী আর কেউ আছে? আমাদের চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কোনো দল আছে? আমাদের ৬০ থেকে ৭০ লাখ নেতাকর্মী মামলার আসামি। আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী গুম-খুনের শিকার, জেলের মধ্যে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে, পুলিশের হেফাজতে মারা গেছে, বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়েছে, চাকরি হারিয়েছে। পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে।
জাগো নিউজ: নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা কতটুকু?
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: এই মুহূর্তে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হলে তখন এ নিয়ে আলোচনা হবে।
জাগো নিউজ: আপনি কিছুদিন আগে বলেছিলেন যে তারেক রহমানের দেশে ফেরার প্রস্তুতি চলছে। আমার প্রশ্ন উনার দেশে ফেরার ক্ষেত্রে কোনো আইনগত বা রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ দেখেন কিনা?
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: না, না কোনো চ্যালেঞ্জ কী? চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উনার সিদ্ধান্ত উনি নেবেন, উনার সময় মতো। কারণ এত বছর বাইরে থেকেছেন, সুবিধা-অসুবিধা আছে, পারিবারিক, রাজনৈতিক অনেক বিষয় আছে। এটা উনার চেয়ে ভালো কেউ বুঝবেন না।
আমি যতটুকু বলতে পারব উনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন যে কোনো সময় আসার জন্য। উনি যেদিন ডিক্লেয়ার করবেন এটা আমরা সবাই জানতে পারব, এই সিদ্ধান্ত উনাকে দিতে হবে।
জাগো নিউজ: তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা আছে কিনা?
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: আমি শঙ্কার কথা বলছি না। কিন্তু উনার লেভেলের একজন নেতার নিরাপত্তা বিষয়ে তো বিবেচনা রাখতে হবে। উনি ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে সারাদেশের লোক মবিলাইজড করেছেন, আন্দোলন করেছেন। উনার লেভেলে বিশেষ নিরাপত্তা থাকা স্বাভাবিক।
জাগো নিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।