Image description

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস। সারাদেশে শোরগোল ফেলে দিলো সংবাদমাধ্যমের একটি খবর। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেবছর ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে ইয়ংমেন্স ফকিরাপুল ক্লাব থেকে শুরু। একই রাতে অভিযান চললো ঐতিহ্যবাহী ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র, গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ ক্লাবে। জব্দ করা হয় ক্যাসিনোতে জুয়া খেলার বিপুল পরিমাণ সামগ্রী। গ্রেপ্তার হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া।

পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে হঠাৎ করে কেন এই ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলো? পরে কেন সেটি ছড়িয়ে পড়লো অন্যান্য খাতে? কেন এই অভিযানের জেরে যুবলীগ চেয়ারম্যানের পদ হারালেন ওমর ফারুক চৌধুরী? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ঢাকা টাইমস পেয়েছে এক চমকপ্রদ তথ্য। পারিবারিক বিরোধের আলামত পেয়ে ফুঁসে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা। যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিলেন। ডানা ছেঁটে দিতে চেয়েছিলেন শেখ ফজলুল করিম সেলিমের।

২০১৪ সালে বিরোধী দলবিহীন বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংসদ নির্বাচনে টানা দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এরপরই লাগামহীন বেপরোয়া দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন দলের অনেক নেতা। যেনো এখনই যা পারো দু’হাতে কামিয়ে নাও। আওয়ামী লীগ ছাড়াও তখন যুবলীগ নেতাদের প্রচণ্ড দাপট। কারণ তখনও নেপথ্যে যুবলীগ নিয়ন্ত্রণ করতেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম। সেই সময় যুবলীগের চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ সেলিমের ভায়রা ওমর ফারুক চৌধুরী। তার হয়ে রাজধানীতে টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে ক্যাসিনো জুয়ার সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন বেশ কয়েকজন যুবলীগ নেতা। সাথে ছিলেন শেখ সেলিমের আশির্বাদপুষ্ট আরো কয়েকজন আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্র লীগ নেতা।

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর এই নেতাদের দাপট আরো বেড়ে যায়। রাজধানীতে আওয়ামী লীগের সমান্তরাল শক্তি হিসাবে যুবলীগকে দাঁড় করানোর সাহস দেখান সংগঠনের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট। সিটি কর্পোরেশনের কয়েকজন কাউন্সিলর ও যুবলীগের আরো কয়েকজন নেতা তখন বিভিন্ন ক্লাবে ক্যাসিনো জুয়ার জমজমাট আসর বসিয়ে বিপুল অর্থ আয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন।

২০১৯ সালে একদিন লন্ডনে শেখ রেহানাকে ফোন করেন যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। বোনের বিরুদ্ধে শেখ রেহানাকে উস্কানোর চেষ্টা করেন তিনি। বলেন, বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসাবে শেখ হাসিনা যে সুবিধা পাচ্ছে, শেখ রেহানারও তার ন্যায্য হিস্যা পাওয়া উচিত। আর শেখ রেহানার ন্যায্য হিস্যা আদায়ে তার আত্মীয় স্বজন ও যুবলীগ তার পাশে আছে।

ওমর ফারুক চৌধুরীর টেলিফোন যে ট্যাপ করা হতে পারে সেটা তিনি আন্দাজ করতে পারেননি। ভেবেছিলেন শুধু বিরোধী দলীয় নেতাদের টেলিফোন ট্যাপ করে কল রেকর্ড করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা ছিলো ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের বেশিরভাগ নেতারই ফোন কল রেকর্ড করতো গোয়েন্দা সংস্থা। শেখ রেহানাকে করা ওমর ফারুক চৌধুরীর ফোন কলও রেকর্ড করা হয়। গোয়েন্দা সংস্থা সেই রেকর্ড তুলে দেয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। আর এতেই ফুঁসে উঠেন তিনি।

তবে চট করে যুবলীগ চেয়ারম্যানকে অপসারণের বদলে ভিন্ন কৌশল নেন শেখ হাসিনা। রাজধানীতে ওমর ফারুক চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ও শেখ সেলিমের আশির্বাদপুষ্ট, একই সাথে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত যুবলীগ নেতাদের ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। আর এই ছেঁটে ফেলার জন্য গ্রহণ করেন আগ্রাসী পন্থা। আইন শঙ্খলা বাহিনীকে বিভিন্ন খাতের অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও অবৈধ অর্থের বিরুদ্ধে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরুর নির্দেশ দেন। তবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মূল টার্গেট হবে শেখ সেলিমের আশির্বাদপুষ্টরা। এতে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার হবে। জনগণ বুঝবে সরকার চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। অন্যদিকে শেখ সেলিমের ডাটা ছেঁটে দেয়া যাবে।

এই পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই তখন বেশ কয়েকদিন ধরে সাঁড়াশি অভিযান চালায় পুলিশ ও র‌্যাব। গ্রেপ্তার হয় কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজিব, হাবিবুর রহমান মিজান, ময়নুল হক মঞ্জু, যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, ইসমাইল হোসেন সম্রাট, জি কে শামীমকে। শুরুতে কয়েকজনের গ্রেপ্তার নিয়ে মিডিয়াতে ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া জানান যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। আসলে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পনা আঁচ করতে পারেননি। কয়েকদিনের মধ্যে ওমর ফারুক চৌধুরীকে যুবলীগ থেকে অপসারণের নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। হঠাৎ করেই আকাশ থেকে ধপ করে মাটিতে পড়ে যান ওমর ফারুক চৌধুরী।

ভায়রা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের শক্তিতে ৬২ বছর বয়সে যুবলীগের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন চট্টগ্রামের ওমর ফারুক চৌধুরী। নয় বছর এই পদ আঁকড়ে ছিলেন তিনি। যখন পদচ্যুত হন, তখন তার বয়স ৭১ বছর। পরে শেখ হাসিনা এই সংগঠন করার জন্য সর্বোচ্চ বয়স সীমা বেঁধে দেন ৫৫ বছর। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে শেখ সেলিমের বিরোধী পরিবার থেকে শেখ ফজলে শামস পরশকে যুবলীগের চেয়ারম্যান ঠিক করে দেন। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মনির ছেলে পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে তাদের চাচা শেখ সেলিমের আগে থেকেই সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ ছিলো । চাচার বদলে ফুপু শেখ হাসিনাকে অভিভাবক মনে করতেন পরশ ও তাপস।