
পারিবারিক কারণ দেখিয়েও রাজনৈতিক বিবেচনায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) পরিসংখ্যান বিভাগে পুনঃভর্তি হয়েছেন শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহবায়ক আনোয়ার পারভেজ। আবেদনে দেওয়া তার পারিবারিক কারণটিও মিথ্যা বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, শাখা ছাত্রদলের নতুন কমিটিতে পদ পাওয়ার জন্য ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতেই নিয়মবহির্ভূতভাবে ভর্তি হয়েছেন তিনি।
অ্যাকাডেমিক শাখা ও বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আনোয়ার পারভেজ পরিসংখ্যান বিভাগের অনার্স ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। অনার্স শেষে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে একই বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন। তবে তখন কোর্স সম্পন্ন করতে পারেননি। ফলে ৫ আগস্টের পর পারিবারিক সমস্যার কারণে কোর্স সম্পন্ন করতে পারেননি উল্লেখ করে বিভাগের সভাপতির মাধ্যমে রেজিস্ট্রারের কাছে পুনঃভর্তির আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগের অ্যাকাডেমিক কমিটির ১৯৩তম সভায় তাকে বিশেষ বিবেচনায় পুনঃভর্তির সুপারিশ করা হয়। পরে সেটি অ্যাকাডেমিক শাখায় গেলে অ্যাকাডেমিক অর্ডিন্যান্সের পুনঃভর্তি ধারা অনুযায়ী এমএসসি ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে পুনঃভর্তির সুযোগ নেই উল্লেখ করে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য উপাচার্য বরাবর প্রেরণ করে। এতে প্রথমে উপাচার্য পুনঃভর্তির অনুমোদন দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্স বহির্ভূত হওয়ায় পরে তা স্থগিত করে দেন।
পরবর্তীতে পারভেজসহ অন্য পাঁচ ছাত্রদল নেতার পুনঃভর্তির বিষয়টি অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভায় উঠলে সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিষয়টি যাচাই বাছাইয়ের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে কমিটির পক্ষ থেকে তাদের ভর্তির জন্য সুপারিশ করা হলে সিন্ডিকেটে তা অনুমোদন হয়।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভর্তি হওয়া অন্য ছাত্রদল নেতাদের প্রকৃত রাজনৈতিক সমস্যা থাকলেও আনোয়ার পারভেজের কোন পারিবারিক ও রাজনৈতিক সমস্যা ছিল না। আওয়ামী আমলে তাকে ক্যাম্পাসে অবাধে চলাচল, আড্ডাসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ড করতে দেখা যেত। বিভিন্ন সময় আন্তঃবিভাগ ও আন্তঃহল ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন তিনি। এমনকি ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলেই থাকতেন। যেখানে সংগঠনটির অন্যান্য নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তার থেকে প্রায় দুই বছর আগেই হল ছাড়তে হয়েছিল। এছাড়া আনোয়ার পারভেজ ২০১৭ সালের পর হলে থাকার সুযোগ না পেলেও তাকে ক্যাম্পাসে চলাফেরা, আড্ডা দেওয়াসহ আন্তঃবিভাগ ও আন্তঃহল ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নিতে দেখা যেত।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে হলে থাকা ও ক্যাম্পাসে খেলাধুলা করার বিষয়গুলো স্বীকার করে আনোয়ার পারভেজ বলেন, ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত হলে থাকতে পেরেছিলাম। যখন হলে ছিলাম তখন অনার্সও শেষ হয়নি। মাস্টার্স তো অনেক পরের কথা। বিভিন্ন সময় ক্যাম্পাসে ছিলাম, খেলাধুলা করা আর নিয়মিত ক্লাস করা এক জিনিস না। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিলাম, কিন্তু কোনো ক্লাস করতে পারি নাই। যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতা ছিল।
পরীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেখানে নিয়মিত ক্লাস করতে পারিনি সেখানে পরীক্ষা তো অনেক পরের কথা।
তবে এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাখা ছাত্রদলের কয়েকজন নেতা বলেন, আমরা আমাদের বিভাগের স্যারদের সহায়তায় ফ্যাসিবাদের আমলে শিক্ষাজীবন শেষ করেছি। শাখা ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির আহ্বায়কও সেই সময়টাতে অনার্স মাস্টার্স শেষ করেছেন। এমনকি তিনি নিয়মিত অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে সান্ধ্যকালীন মাস্টার্সও শেষ করেছেন। বর্তমানেও তার সান্ধ্যকালীন একটি মাস্টার্স চলমান রয়েছে। সে জায়গা থেকে আমরা পারলে সে কেন পারলো না? সে মূলত কমিটিতে আসার জন্য ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতেই তখন পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।
এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মনজুরুল হক বলেন, রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে শিক্ষাজীবন কন্টিনিউ করতে পারেনি শুধু এমন বিষয়গুলোতে কনসিডার করা হয়েছে। এছাড়া অর্ডিন্যান্স বহির্ভূত অন্য কোন বিষয় কনসিডার করা হয়নি। পারিবারিক বা অন্য কারণে পড়ালেখা শেষ করতে পারেনি এমন কারো ভর্তির সুযোগ নেই। আমি শুধু চিঠিটা ইস্যু করেছি। এছাড়া আমার কিছু জানা নেই। কমিটিই ভালো বলতে পারবে।
যাচাইবাছাই কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. নজিবুল হক বলেন, এটা মূলত অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলেই পাস হয়েছিল। আমাদেরকে শুধু যাচাই বাছাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের আলোকেই আমরা সুপারিশ করেছি।
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, পুনঃভর্তির বিষয়ে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল থেকে কমিটি করা হয়েছিল। পরে কমিটির সুপারিশ সিন্ডিকেটে অনুমোদন হয়। পারিবারিক কারণে কারো ভর্তি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে জানান তিনি এবং এ বিষয়ে প্রতিবেদককে কমিটি অথবা রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
উল্লেখ্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক অর্ডিন্যান্সের পুনঃভর্তি ধারা অনুযায়ী পর পর দুই বছর কোর্স সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন এমন শিক্ষার্থীদের নিয়মিত মাস্টার্সে পুনঃভর্তির সুযোগ নেই। তবে অর্ডিন্যান্সের এই নিয়মের বাইরে গিয়ে সম্প্রতি ছয়জনকে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে নিয়মিত মাস্টার্সে পুনঃভর্তি নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, ৫ আগস্টের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেননি এমন শিক্ষার্থীদেরকে নিয়মিত মাস্টার্সে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। একইভাবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে প্রশাসন। অর্ডিন্যান্সের বাইরে শুধু রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে তাদেরকে ভর্তি নেওয়া হয়েছে।