
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে লালমনিরহাটের তিনটি আসনে ইতোমধ্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে লন্ডনে বৈঠকের পর আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হয়। এই ঘোষণার পর থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিচ্ছেন নির্বাচনি প্রস্তুতি। এলাকায় গণসংযোগ, সভা-সমাবেশে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।
এদিকে আগের সংসদ নির্বাচনগুলোকে শুধু সরকার বা দায়িত্ব পরিবর্তনের একটা আনুষ্ঠানিতকতা মাত্র বনে মনে করেন সাধারণ মানুষ। এ কারণে দলীয় প্রার্থীর পরিবর্তে সৎ ও নিষ্ঠাবান যোগ্য প্রার্থীকে চান জেলার বড় অংশের ভোটাররা। তবে নির্দলীয় প্রার্থী হতে কেউ আগ্রহ প্রকাশ করছেন না। এলাকায় যারা সৎ ও যোগ্য প্রার্থী, তারা টাকার খেলায় পেরে উঠবেন না বলে প্রার্থী হতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এ কারণে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অবৈধ টাকার ছড়াছড়ি বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন তারা।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তাদের একক প্রার্থী চূড়ান্ত করছেন। এরপর থেকেই ভোটের মাঠ গোছাতে ব্যস্ত তারা। তবে আসনগুলোতে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী কে হবে- তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ কারণে কোথাও কোথাও একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থীর প্রচারণা দেখা গেছে। এদিকে জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি এখনো গুছিয়ে উঠতে পারেনি। এ কারণে তাদের রাজনৈতিক তৎপরতা চোখে পড়েনি।
লালমনিরহাট-১ (হাতীবান্ধা-পাটগ্রাম)
লালমনিরহাট-১ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন নেতাকর্মীদের দিয়ে ভোটের ব্যালট পেপার চুরি করে ভোট করে চারবার সংসদ সদস্য হন। শেখ হাসিনা পালানোর পর গা-ঢাকা দিয়েছেন সাবেক এই এমপি ও অন্য নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতারা পালিয়ে থাকায় তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী বিভিন্ন দলে যোগ দিচ্ছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার হাসান রাজীব প্রধান বর্তমানে মাঠে ব্যাপক গণসংযোগ করছেন। তিনি বলেন, ‘হাতীবান্ধা পাটগ্রামের তৃণমূল মানুষের আইনি সহযোগিতা দিয়ে আসছি। বিএনপির তৃণমূল থেকে জেলা ও কেন্দ্রীয় সব কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে আসছি। বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী আমার কাছে সমান। বিশেষ করে ৫ আগস্টের আগে যারা গত ১৭ বছর হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন, তাদের প্রতি আমার একটা আলাদা আকর্ষণ কাজ করে।’
রাজিব প্রধানের পাশাপাশি বিএনপির আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা বিএনপির সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সাবেক সিনিয়র সহসম্পাদক ব্যারিস্টার মাজেদুল ইসলাম পাটোয়ারীও ব্যাপক গণসংযোগ চালাচ্ছেন। তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলাম। প্রাথমিকভাবে মনোনয়নও পেয়েছিলাম। আমার পরিবারের প্রায় সব সদস্য আওয়ামী লীগের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেছিল। এবার আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে যারা বিগত স্বৈরাচারী আমলে জেল-জুলুমের শিকার হয়েছে। তাদের প্রতি যেন অবিচার না হয় তা নিশ্চিত করব।’
এ আসনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন দলটির ঢাকা মহানগরী উত্তরের মজলিসে শূরা সদস্য এবং দলের শিল্প ও বাণিজ্য বিভাগের কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট আনোয়ারুল ইসলাম রাজু। প্রতিদিনই তিনি হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। সমাজসেবক, তরুণ উদ্যোক্তা রাজু তার কাজের মাধ্যমে এলাকার মানুষের আস্থা কুড়িয়েছেন। এর আগেও করোনা মহামারির সময় তিনি অসহায় মানুষের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে বাসায় বাসায় পৌঁছে দিয়েছেন। এসব কারণে এ আসনে তাকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হয়। আনোয়ারুল ইসলাম রাজু জানান, তার স্বপ্ন অসহায় মানুষকে নিয়ে কাজ করার।
বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের রাজনীতির মাঠে সরব উপস্থিতি দেখা গেলেও নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনপিসি) তৎপরতা চোখে পড়েনি।
লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী ও কালীগঞ্জ)
আসন্ন নির্বাচন ঘিরে এই সংসদীয় আসনটিতে গণসংযোগ করতে দেখা যাচ্ছে পাঁচ প্রার্থীকে। তাদের মধ্যে জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি রোকনউদ্দিন বাবুল। তিনি ২০১৮ সালে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এই আসন থেকে নির্বাচন করেন।
আসন্ন নির্বাচন ঘিরে ইতোমধ্যে প্রত্যেকটি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার হাটবাজার থেকে শুরু করে গ্রাম থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাপক জনসংযোগ করতে দেখা যাচ্ছে তাকে। রোকন উদ্দিন বলেন, এতদিন মানুষ তাদের প্রত্যাশিত প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেনি। কারণ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। এবার মানুষ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন।
বাবুল ছাড়াও দলের মনোনয়ন চাইবেন সাবেক ইনিয়ন পরিষদ চেয়ারমান ও কালীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বর্তমানে নির্বাচনি এলাকায় ব্যাপক জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘দল যদি আমাকে মনোনয়ন দেয় আর আমি যদি নির্বাচিত হতে পারি, তাহলে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব। বিভিন্ন খেলাধুলার মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরব। বিশেষ করে তিস্তার ভাঙনকবলিত মানুষের তালিকা তৈরি করে তাদের বিশেষ ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করব।
অন্যদিকে নবগঠিত রাজনৈতিক দল ‘জনতার দল’-এর চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শামীম কামালকে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে এই সংসদীয় আসনটিতে জনসংযোগ করতে দেখা যাচ্ছে। তিনি জাতীয় পার্টির মনোনীত সাতবারের (এমপি) মরহুম মজিবর রহমানের দ্বিতীয় ছেলে। বাবার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক পরিচয় এবং অবস্থান ছেলের জন্য রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশের পথ সহজ করে তুলছে বলে অনেকে মনে করেন।
এদিকে জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক মনোনীত প্রার্থী আদিতমারী উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ হায়দার লাভলুকে গণসংযোগ করতে দেখা যাচ্ছে। তিনি আসনটির প্রত্যেকটি ইউনিয়নের বিভিন্ন হাটবাজার থেকে শুরু করে প্রতিটি পাড়া-মহল্লার লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। প্রত্যেক এলাকার মসজিদের মুসল্লিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন। বিগত দিনে তাকে এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। লাভলু বলেন, এই আসনের প্রত্যেকটি ইউনিয়নের গ্রামগঞ্জের মানুষের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে কাজ করতে চাই। আমি নির্বাচিত হলে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মনোনীত প্রার্থী মুফতি মাহফুজুর রহমান এলাকার জনসাধারণের সঙ্গে দেখা করে তাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। এলাকার বিভিন্ন মসজিদে প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের পর মুসল্লিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন। মাহফুজুর রহমান বলেন, এলাকার স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন ও বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে কাজ করতে চাই। তিস্তার ভাঙনরোধ করে এই অঞ্চলের মানুষের ভোগান্তি দূর করে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে চাই। পাশাপাশি তিনি মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে ভূমিকা পালন করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। জয়ের ব্যাপারেও শতভাগ আশাবাদী তিনি।
তবে আসনটিতে এনসিপির কোনো প্রার্থীকে নির্বাচনি প্রচার করতে দেখা যায়নি।
লালমনিরহাট-৩ (সদর)
আসনটিতে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের তিনজন প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। সাবেক উপমন্ত্রী ও বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু এই আসনের একক প্রাথী। তিনি ২০০১ সালের ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে প্রথমে যোগাযোগ উপমন্ত্রী এবং পরে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। বেগম খালেদা জিয়ার ডাল-ভাত কর্মসূচিকে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা দূরীকরণে সহায়ক হিসেবে কাজে লাগান তিনি। এ আসনে তার রয়েছে শক্ত অবস্থান।
তিস্তা বাঁচাও আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী এই নেতা বলেন, এবারে যদি নির্বাচিত হই, তাহলে অতীতের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করার পাশাপাশি আমার প্রথম কাজ হবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে নজর রাখা। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতি গুরত্ব দেন তিনি।
আসনটিতে জামায়াতের মনোনীত প্রাথী প্রভাষক হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, ‘আমার প্রতিশ্রুতি রাষ্ট্রের টাকা আত্মসাৎ বন্ধ করা, বেকারত্ব দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। তিস্তাপাড়ের মানুষের দুর্ভোগ কমাতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা, দেশের গর্বিত নাগরিক হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভাইবোনসহ, সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের মানবিক ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা। সব সন্ত্রাসবাদ ও চাঁদাবাজি বন্ধ করে, বসবাসযোগ্য ও নিরাপদ লালমনিরহাট সদর তৈরি করা।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মোকছেদুল ইসলামও এলাকায় প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। বিভিন্নভাবে এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে ভোটারদের ইসলামের পক্ষে রায় দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে আহ্বান জানাচ্ছেন। বিগত নির্বাচনগুলোতেও ইসলামী আন্দোলনের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন মোকছেদুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমি যদি সংসদ সদস্য হিসেবে জয়ী হতে পারি, তাহলে চাঁদাবাজ ও মাদকমুক্ত একটি সুন্দর সমাজ গড়তে অগ্রণী ভূমিকা পালন করব।
তবে নতুন রাজনৈতিক দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পক্ষ থেকে কোনো ব্যক্তিকে এই আসনে নির্বাচনি প্রচার কিংবা গণসংযোগে দেখা যায়নি। তা সত্ত্বেও দ্রুত জুলাই সনদ দিয়ে মৌলিক সংস্কার শেষ করে তবেই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে তাদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে।