
ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের চেয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরের সংঘাত ভবিষ্যতে বিশ্বমঞ্চে তাদের ক্ষমতার উপর আরও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এই অভ্যন্তরীণ সংঘাতে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় বনাম সরকার, বিদেশি শিক্ষার্থী বনাম নিরাপত্তা শঙ্কা, অভিবাসন নীতি, এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ও একঘরে থাকার প্রবণতার মধ্যে দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে আমেরিকা যেন নিজের সঙ্গেই যুদ্ধ করছে।
যুদ্ধ শেষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হবে—যুদ্ধ করে যা অর্জন করা হয়েছে, তা শান্তির সময় ধরে রাখা যাবে কি না। ইরাক ও আফগানিস্তানে দেখা গেছে, সামরিক বিজয় অর্জনের পরও যুক্তরাষ্ট্র সফলভাবে একটি স্থায়ী মিত্র সরকার গড়তে পারেনি। সাম্রাজ্যের জন্য সামরিক শক্তি দরকার সম্প্রসারণের জন্য, কিন্তু সেই ক্ষমতা টিকে থাকে স্থানীয়দের সহযোগিতার মাধ্যমে।
প্রাচীন সাম্রাজ্যগুলো অল্পসংখ্যক লোক দিয়ে বড় ভূখণ্ড শাসন করত, কারণ তারা স্থানীয়দের নিজেদের দলে টানত। রোমান সাম্রাজ্য এক হাজার বছরের মতো শাসন করেছিল, কারণ তারা বিজিতদের রোমান নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করত। ব্রিটিশরা ভারতে লাখ লাখ মানুষকে শাসন করত হাজার দশেক লোক নিয়ে, কারণ তারা স্থানীয়দের প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রভাবশালী ভিজিরদের অনেকেই ছোটবেলায় দাস হিসেবে তুলে নেওয়া হলেও পরে যোগ্যতার ভিত্তিতে শীর্ষ পদে পৌঁছান।
আমেরিকার তৈরি সাম্রাজ্যটি গড়ে উঠেছে করপোরেট শক্তি, প্রযুক্তি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারার মাধ্যমে। আপনি বুঝতে পারবেন আপনি কোথায় আছেন—রাস্তার সাইনবোর্ড, পোশাক এবং যে মূল্যমালা চারপাশে দেখা যায় তা থেকেই। এই সাম্রাজ্যে সবাই যোগ দিতে পারে। অভিবাসীরা আমেরিকান হয়ে ওঠে, যেভাবে তারা কখনো চীনা বা রাশিয়ান হতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব ছড়িয়েছে শিক্ষা, অভিবাসন এবং বৈশ্বিক মূল্যবোধের মিশনের মাধ্যমে—যেখানে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই ধারণাগুলো প্রাচীন পুরিতান ধর্মীয় চিন্তাধারা থেকে এসেছে, যেখানে শিক্ষার গুরুত্ব ও সবার জন্য সমতা ছিল কেন্দ্রে।
তবে আমেরিকা কখনোই খুব আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী ছিল না। তারা নিজেরাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। এই কারণে দেশটি অনেক সময় হস্তক্ষেপ করে আবার কিছু সময় একঘরে থাকার নীতি নেয়। এক প্রেসিডেন্ট যা করেন, পরের জন এসে তা বাতিল করে দেন।
লেখক নিজে যুক্তরাষ্ট্রে সাত বছর থেকেছেন। তিনি বলেন, সে সমাজের জটিলতা পুরোপুরি বুঝে ওঠা কঠিন। তবে একজন লেবানিজ হিসেবে তিনি বলছেন—এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র ভয়াবহভাবে বিভক্ত, এবং এটা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়।
এই বিভক্তির লক্ষণ আছে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধে। যেমন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিতর্ক, বা ক্যালিফোর্নিয়ায় অভিবাসন বিরোধী নীতির প্রতিবাদ। আজকের যুক্তরাষ্ট্র নিজেই নিজের মিত্র হিসেবে আর নির্ভরযোগ্য নয়, কারণ নতুন প্রশাসন আগের সিদ্ধান্ত উল্টে দেয়।
বিদেশি শিক্ষার্থীদের যদি হুমকি হিসেবে দেখা হয়, তাহলে বোঝা যায় আমেরিকা নিজের সাংস্কৃতিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে। বিদেশি শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রে এসে শুধু পড়াশোনাই করে না, তারা আমেরিকার অংশ হয়ে ওঠে। এমনকি যদি তারা আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করে, তবুও তারা জানে এই দেশের মতো তাদের নিজের দেশে এমন প্রতিবাদ করা সম্ভব নয়।
আজ চীন ও ব্রিকস (BRICS) দেশগুলো আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে। কিন্তু যতদিন শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার জন্য আমেরিকাকে বেছে নেয়, ততদিন আমেরিকার হাতেই বাড়তি শক্তি থাকবে।
সিলিকন ভ্যালি, যা প্রযুক্তির নেতৃত্ব দিচ্ছে, সেটাও অভিবাসীদের প্রতিভার ফসল। সিরিয়া, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা মেধাবীরা আমেরিকান সমাজে জায়গা করে নিয়েছেন। তারা সবাই এই সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে উঠেছেন।
ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র শিয়া ও সুন্নি মিত্রদের হারায়, কারণ তারা জানে না কখন সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যাবে। ওবামা নির্বাচনের আগে সেনা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেন, ফলে ইরাকে ইরান প্রভাব বিস্তার করে। আফগানিস্তানে একই অবস্থা।
এই অবস্থায়, যতই ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক বিজয় আসুক, আমেরিকার শক্তির আসল পরীক্ষা হবে অভ্যন্তরীণ সংঘাতে। এই লড়াইতে হেরে গেলে সামরিক জয়ও অর্থহীন হয়ে উঠতে পারে। [আরব নিউজ থেকে]
✍️ নাদিম শেহাদি একজন অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক উপদেষ্টা। এক্স (Twitter): @Confusezeus