Image description

আওয়ামী আমলে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট খাত থেকে লুটে নেওয়া হয়েছে হাজার কোটি টাকা। নামে-বেনামে বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে কখনো জয় বাংলা কনসার্ট, কখনো লেটস টক উইথ হাসিনা আর উন্নয়নের বানোয়াট গল্পের আড়ালে জনগণের টাকা লোপাট হয়েছে। মূলত ২০১৮ সালের ‘রাতের’ ভোটকে টার্গেটে নিয়েই ২০১৬ সাল থেকে একযোগে সব সরকারি প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয় ও বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোকে আওয়ামী প্রচারে বাধ্য করে দলটির গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)। যার নেতৃত্ব দিয়েছেন হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও রেহানাপুত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি।

 

সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণ সময়ে বছরে যেখানে ইভেন্ট খাতের বাজার এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি নয়, সেখানে হঠাৎ করেই ২০১৬ সালে এসে সরকারি ইভেন্ট এ বাজারকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলে। ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এই খাতের বাজারে নতুন যোগ হয় প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। তবে হাসিনার পলায়নের পর বর্তমান সরকারের আমলে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট বাজার আবার আগের জায়গায় ফিরে গেছে। কেউ কেউ বলছেন, এই খাতে এখন মন্দা চলছে। বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থার প্রতিনিধি, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ও সরকারি-বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে, এই খাতে বিগত এক দশকেই কমপক্ষে তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। হাসিনার আমলে রাষ্ট্রীয় খরচে দেশ-বিদেশে অন্তত চার শতাধিক ইভেন্ট আয়োজন করে বিভিন্ন নামে-বেনামের প্রতিষ্ঠান।

 

ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস ও ক্যাম্পেইন, মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন, জয় বাংলা কনসার্ট, ‘বঙ্গবন্ধু’ ইনোভেশন গ্র্যান্ট, হাসিনা অ্যা ডটারস টেল ক্যাম্পেইন, শতভাগ বিদ্যুতায়ন ও বিদ্যুৎ সপ্তাহ, আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা, পদ্মা সেতু উদ্বোধন, ‘বঙ্গবন্ধু’ টানেল উদ্বোধন, ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড, ডিজিটাল ডিভাইস ইনোভেশন এক্সপো, বিপিও সামিট, রোবট অলিম্পিয়াড, ডিজিটাল বাংলাদেশ ক্যাম্পেইন, শেখ রাসেল দিবস নামে সবচেয়ে বেশি সরকারি অর্থ লোপাট হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

 

সিআরআইয়ের নেতৃত্বে রাজনৈতিক প্রচার

হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক ও নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণার প্রধান ভূমিকায় ছিল হাসিনাপুত্র জয় ও রেহানাপুত্র ববির প্রতিষ্ঠান সিআরআই। মূলত ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট বাছাই করে সরকারি অর্থ লোপাটের ব্যবস্থা করেছে সিআরআই। এ সংস্থার তারুণ্যের প্ল্যাটফর্ম ইয়াং বাংলার উদ্যোগে সবচেয়ে বড় ইভেন্ট ছিল প্রতি বছর ‘জয় বাংলা’ কনসার্টের আয়োজন। এই আয়োজনে অর্থ জোগান এসেছে আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে।

 

অর্থ লোপাটের কৌশল কী ছিল?

অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাসিনার আমলে বড় বড় ইভেন্টগুলোর কোনোটিরই টেন্ডার হয়নি। ছোট কিছু ইভেন্টের টেন্ডার হয়েছে কাজ ভাগবাঁটোয়ার পর, যেখানে কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। সে সময় হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানির প্রতিনিধিদের ডেকে পাঠানো হতো সিআরআই অফিসে। সেখানে ইভেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ নির্বাহী বা তাদের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক হতো। সেই বৈঠকে কাজের ধরন, খরচের খসড়া হিসাব ও খাত বলে দেওয়া হতো। সে অনুযায়ী কাগজপত্র তৈরি করে নিজেদের পরিকল্পনার কথা জানানো হতো সিআরআই বা সরকারের প্রভাবশালীদের কাছে। পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তর খসড়া হিসাবের তালিকা ধরে মন্ত্রী-সচিবের দাপ্তরিক আদেশে অর্থছাড়ের ব্যবস্থা করেছে। বিনা টেন্ডারের এসব কাজের বেশির ভাগই পেয়েছে এশিয়াটিকÑএমন অভিযোগ প্রতিদ্বন্দ্বী আরেকটি বিজ্ঞাপনী ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির এক শীর্ষ কর্মকর্তার।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এশিয়াটিক গ্রুপ, গ্রে বাংলাদেশ, এক্সপ্রেশনস, হাই ভোল্টেজ, এ ফর অ্যাকশন, কে স্পোর্টস, স্পেল বাউন্ড, উইন্ডমিল, ঢাকা লাইভ ও ব্লুজ নামের বিজ্ঞাপন ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোই হাসিনার বানোয়াট উন্নয়নের বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজনে বেশি সক্রিয় ছিল। এসব বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকেই এখন ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পলাতক।

ইভেন্ট আয়োজনে খরচের দিক থেকে তুলনা করে দেখা গেছে, তথ্যপ্রযুক্তি ও আইসিটি মন্ত্রণালয় ছাড়াও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অহেতুক প্রচারে রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচে এগিয়ে ছিল।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান আমার দেশকে জানিয়েছেন, তার মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বা উদ্যোগে হাসিনা সরকারের আমলে যেসব ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে, সবগুলোরই তদন্ত হবে। দোষী কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। বিনা কারণে উন্নয়নের বানোয়াট গল্পের বিজ্ঞাপন বা প্রচারণার রহস্য বের করা হবে। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয় এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম খতিয়ে দেখছে। তিনি এসব বিষয়ে তথ্য আছে, এমন কেউ থাকলে সরাসরি তার কাছে অভিযোগ আকারে প্রদান করারও আহবান জানান।

মুজিববর্ষ আয়োজনে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বেশ কয়েকটি ইভেন্ট করেছিল শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে। এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে গিয়ে দুর্নীতিতে জড়ায় শিল্পকলা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আমার দেশকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেকগুলো সংস্কারকাজে হাত দিয়েছি। সেই সঙ্গে বিগত সময়ে এই মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে একজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ প্রায় চূড়ান্ত। তার নেতৃত্বে কমিটি করা হবে। সেখানে মুজিববর্ষসহ সব ইভেন্ট আয়োজনের অনিয়ম খুঁজে দেখা হবে।’

 

গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আয়োজিত বিভিন্ন ইভেন্ট বিষয়ে বক্তব্যের জন্য লিখিতভাবে প্রশ্ন করা হয় মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলামের কাছে। তবে তিনি এর কোনো উত্তর দেননি। টেলিফোনে তিনি জানান, ‘আমি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে আগ্রহী নই।’ এ বিষয়ে এ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে আমার দেশকে বলেন, বর্তমান সময়ে তারা কোনো দুর্নীতির প্রশ্রয় দিচ্ছেন না। আগের অনিয়ম ও দুর্নীতি বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ কিছু অনুসন্ধান চলছে। অনিয়ম পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

পলকের আইসিটি ছিল বেপরোয়া

ইভেন্ট আয়োজনের নামে আইসিটি মন্ত্রণালয় ও এর অধীন দপ্তরগুলোতে বেশি টাকা লোপাটের কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাতে সংঘটিত দুর্নীতি খুঁজে বের করে শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশ করতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছেন। এ কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আইসিটি খাতে অনিয়ম, অপব্যবস্থাপনার তদন্ত ও গবেষণাপূর্বক শ্বেতপত্র প্রণয়ন করার। সর্বশেষ বৈঠকে শ্বেতপত্র প্রণয়নে নাগরিক ও বিভিন্ন অংশীজনদের সম্পৃক্ত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী আমার দেশকে জানিয়েছেন, তার মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ নিয়ে উচ্চ স্তরের কমিটি কাজ করছে। বিদেশে মিশনগুলোর কাছ থেকেও তথ্য চাওয়া হয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ইভেন্ট আয়োজনে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। কাজের বাইরে পরিবার নিয়ে যারা সেখানে কনসার্ট দেখতে গিয়েছিলেন তাদেরও জবাবদিহির মধ্যে আনা হবে।

আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ইভেন্ট ছিল নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ‘গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ কনসার্ট’। ২০২২ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে এ কনসার্টের আয়োজন করা হয়। ওই বছর ৬ মে কনসার্টের আয়োজক ছিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। সরকারিভাবে এর খরচ প্রায় ৩৪ কোটি টাকা দেখানো হলেও বিজ্ঞাপন ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট আয়োজনে যুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার এ প্রতিবেদককে জানান, এই কনসার্ট আয়োজনে কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যে হিসাব দিয়েছে, প্রকৃত ব্যয় তার তিন-চারগুণ বেশি এবং বাকি অর্থ চাঁদাবাজির মাধ্যমে এসেছে বলেও দাবি করেন তিনি।

কনসার্টে গিয়েছিলেন হাসিনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি ও আমলারা। অভিযোগ আছে কেউ কেউ তাদের কাজের ভুয়াদেরও সরকারি টাকায় নিয়েছিলেন এ অনুষ্ঠানে। অংশ নিয়েছিলেন শতাধিক সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার। শুধু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ৭২ কর্মকর্তা গিয়েছিলেন এ অনুষ্ঠানে।

দুই সপ্তাহের বিদেশ ভ্রমণ ও অনুষ্ঠান আয়োজনের খরচ ৩৪ কোটি ১১ লাখ ৯২ হাজার ৮৬৫ টাকা। এসব অর্থ জোগান দেওয়া হয় বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালকদের মাধ্যমে। সে সময় হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকর্ণ কুমার ঘোষ কনসার্ট বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিলেন। আওয়ামী আমলে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছিল আইসিটি মন্ত্রণালয় ও তার অধীনস্থ অধিদপ্তরগুলো। মূলত তৎকালীন আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ছিলেন দুর্নীতির বরপুত্র। আর এ খাত থেকেই ইভেন্ট আয়োজনে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ হয়েছে। পলক আটক হয়ে কারাগারে থাকায় তার বক্তব্য নিতে পারেনি আমার দেশ।

 

দেশে সবচেয়ে বড় ইভেন্ট মুজিববর্ষ

হাসিনার আমলে সরকারি খরচে দেশে সবচেয়ে বড় ইভেন্ট ছিল ‘মুজিববর্ষ’। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে এক বছরের এ আয়োজন সফল করতে কয়েকশ ইভেন্ট আয়োজন করা হয়। বেশির ভাগ ইভেন্টের কাজ পেয়েছে হাতেগোনা দু-একটি প্রতিষ্ঠান। পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব ও উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি বাস্তবায়নের প্রধান সমন্বয়ক। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে এই আয়োজনে খরচ হয়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। ইতিমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ নিয়ে অনুসন্ধান কাজ চালাচ্ছে। নাসের চৌধুরী আটক হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন।

রাজধানী ঢাকার অনুষ্ঠান আয়োজনেই কয়েকশ কোটি টাকা ব্যয় হয় বলে আয়োজক প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যে জানা গেছে। সরকারি নথি অনুসন্ধানে শুধু গণপূর্ত অধিদপ্তরের (পিডব্লিউডি) ইলেকট্রিক্যাল বিভাগ থেকেই ৯৮ কোটি ৫১ হাজার ৬৭ টাকা প্রদান করা হয় বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও ইভেন্ট আয়োজক এশিয়াটিক গ্রুপকে। এশিয়াটিক মার্কেটিং কমিউনিকেশন এ পরিমাণ টাকা নিয়েছে সংসদ ভবনের সামনে একটি মঞ্চ তৈরি, নায়ক-নায়িকাদের জন্য ছোট আকারের একটি গ্রিন রুম, অতিথিদের বসার ব্যবস্থা এবং একটি ছোট অস্থায়ী তাঁবু দিয়ে অফিস রুম স্থাপনের জন্য। সেই সঙ্গে তিনদিনের অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ সরবরাহ, জেনারেটর ভাড়া ও সিসিটিভি ভাড়াও অন্তর্ভুক্ত ছিল এর মধ্যে।

এ বিষয়ে এশিয়াটিক গ্রুপ এর আগে লিখিত আকারে একটি বক্তব্য পাঠিয়েছিল আমার দেশকে। তারা দাবি করে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি ও মুজিব শতবর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠানের ওয়ার্ক অর্ডারপ্রাপ্তির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি এশিয়াটিক থ্রি-সিক্সটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা ও আইনগত বাধ্যবাধকতা মেনে সম্পন্ন করেছে।

এই আয়োজনে গ্রে বাংলাদেশ প্রায় ৩৪ কোটি টাকার কাজ পেয়েছিল বলে জানিয়েছেন এই প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাওসুল আলম শাওন। আয়োজনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। মুজিববর্ষের আয়োজন সে সময় প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী সরাসরি অনিয়মে জড়িয়ে আলোচনায় এসেছিলেন। ইভেন্ট আয়োজনে আর্থিক অনিয়মসহ তার বিরুদ্ধে আরো বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে ইতিমধ্যে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১ থেকে এ মামলা করা হয়েছে, যার তদন্ত চলমান।

গ্রে বাংলাদেশ বিগত হাসিনার শাসনামলে দুবার ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের ইভেন্ট, দুবার শতভাগ বিদ্যুতায়ন ও বিদ্যুৎ সপ্তাহ, মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন এবং একাধিক বছর জয় বাংলা কনসার্টের আয়োজন করেছে। ২০২২ সাল পর্যন্ত এসব আয়োজন তদারকি করেছেন গ্রে বাংলাদেশ-এর তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বর্তমানে ডটবার্থ বিজ্ঞাপনী সংস্থার ব্যবস্থাপনা অংশীদার গাওসুল আলম শাওন। তার কাছে প্রশ্ন ছিল বিগত হাসিনা সরকারের আমলে আপনাদের বিরুদ্ধে ইভেন্ট আয়োজনের নামে অর্থ লোপাটের অভিযোগ আছে, আপনি এ বিষয়ে কি বলতে চান? জবাবে তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘আমি একসময় এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তবে আমার জানামতে আমরা কোনো অনিয়মের মাধ্যমে ইভেন্ট আয়োজন করিনি। বিদেশি কোম্পানিগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। আমরা চেষ্টা করেছি সব নিয়ম মেনে কাজ করার।’

 

কামাল নাসের ছিলেন মুজিববর্ষের মূল রূপকার

গ্রে বাংলাদেশের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাওসুল আলম শাওন আমার দেশকে জানান, মুজিববর্ষের আয়োজনটি ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির প্রধান ছিলেন কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। মূলত তিনিই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টসহ সবকিছু দেখভাল করেন। তার দেওয়া চাহিদা অনুযায়ী গ্রে বাংলাদেশ একটি প্রস্তাবনা জমা দিয়েছিল। সে প্রস্তাবনা তাদের পছন্দ হওয়ায় আমাদের কাজ দেওয়া হয়। এই ইভেন্টসহ যেসব ইভেন্ট গ্রে বাংলাদেশ করেছে সবগুলোই নিয়ম মেনে টেন্ডারের শর্ত পূরণ করে হয় বলে দাবি করেন তিনি। টেন্ডার প্রক্রিয়া তো প্রতিযোগিতামূলক ছিল না। অভিযোগ ছিল আপনারা আগে কোটেশন বা খরচের সম্ভাব্য হিসাব দিতেন সেগুলোই অনুমোদন দেওয়া হতো। এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ আমাদের বড় বড় ইভেন্ট আয়োজনের আগে ডেকে পাঠানো হয়েছে। যেমন মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন অনুষ্ঠানের আগে সিআরআই ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে আমি দুবার অংশ নিয়েছি। সেখানে আমাদের কাছে কাজের ধরন উল্লেখ করে কোটেশন (সম্ভাব্য খরচ) চাওয়া হয়। পরে আমরা তা উপস্থাপন করি।’ (তিনি যখন গ্রে বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন)। আপনি বলছেন টেন্ডারের শর্ত মেনে গ্রে কাজ করেছিল, তবে কেন আপনি কোটেশন পাঠাতেন? প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, টেন্ডার হয়েছে কয়েকটি ধাপে। আমরা বড় কাজের ক্ষেত্রে আগে কোটেশন দিয়েছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে আমাদের কাজ করার অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে যেসব কাজ টেন্ডার প্রক্রিয়ায় গেলে সময় বেশি লাগবে, সেগুলো আগে কোটেশন নিয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানটি অনেক বড় ছিল। সেখানে কোটেশনের মাধ্যমে বেশির ভাগ কাজ হয়েছে।

বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্লুজের কর্ণধার আবুল খায়ের লিটুর কাছে প্রশ্ন ছিল বিগত হাসিনা সরকারের আমলে আপনারা বহু ইভেন্ট আয়োজন করেছেন, এসব ইভেন্ট আয়োজনে আপনার প্রতিষ্ঠান অনৈতিক ব্যবসা করেছে কি না—আপনারা কীভাবে সরকারি এত কাজ পেলেন? উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠান ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট খাতের সবচেয়ে বড় কোম্পানি। স্বাভাবিক নিয়ম মেনে চললেও বিগত বছরগুলোর ৬০-৭০ ভাগ কাজ আমার একার পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে আমি পাঁচ-দশটি ইভেন্ট আয়োজনের কাজ পেয়েছি। এসব কাজ নিয়মের মধ্যেই করেছি।’ তিনি জানান, আমাদের একটি নিয়মিত আয়োজন ছিল বার্ষিক বেঙ্গল মিউজিক ফেস্টিভ্যাল। কিন্তু বিশেষ কোনো কারণে ২০১৭ সালের পর থেকে আমাদের সেই আয়োজন আর করতে দেয়নি হাসিনা সরকার।

উইন্ডমিলের কর্ণধার সাব্বির রহমান তানিমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের আকার এতটা বড় নয়। আমরা বছরে ১০ কোটি টাকার কাজ করি। কিন্তু ইভেন্ট খাতে অনেক বড় বড় কোম্পানি আছে, যারা বছরে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার কাজ করে। যেমন ব্লুজ। আমরা বর্তমান সরকারের সময়ে কোনো কাজ করিনি। তবে বিগত সরকারের সময় আমরা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অনেক কাজ করেছি। তবে সিআরআইয়ের সঙ্গে বা শেখ রাসেল পরিষদের সঙ্গে কোনো কাজ করিনি। আর যেসব কাজ আমরা বিগত সময়ে পেয়েছি সবই টেন্ডারের মাধ্যমে। সেগুলোতে কোনো অনিয়ম করিনি।’ তবে আমার দেশ অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানটি তথ্যপ্রযুক্তি ও ক্রীড়া খাতের অনেকগুলো বড় ইভেন্ট করেছে। এসব ইভেন্ট হয়েছে প্রতিযোগিতাহীন টেন্ডারে।

স্পেল বাউন্ড দেশের বাইরে বেশকিছু রোডশোর আয়োজন করেছে। মূলত বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বহুল আলোচিত সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সঙ্গে যোগসাজশে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ-আমেরিকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয় বাংলাদেশের পুঁজিবাজার উন্নয়নের নামে এসব আয়োজন হয় স্পেল বাউন্ডের তত্ত্বাবধানে। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে সাবেক সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ এসেছে আমার দেশ-এর কাছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে গিয়ে বর্তমানে তার নাম পাওয়া যায়নি। যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাদেকুল আরেফিনের সঙ্গে। ই-মেইল বা টেলিফোনে তিনি কোনো সাড়া দেননি। বর্তমান সরকারের সময়েও এই প্রতিষ্ঠান সরকারি কাজ করছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। এর মধ্যে আছে প্রধান বিচারপতির অভিষেক অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বিপিএল ২০২৫-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, স্বাধীনতা পদক, বর্ষবরণ কনসার্ট ও ড্রোন শো আয়োজন।

কে স্পোর্টসের বিরুদ্ধে অভিযোগ এই প্রতিষ্ঠান বিগত হাসিনার আমলে ক্রীড়া খাতের প্রায় সব ইভেন্টের কাজ পেয়েছে। এসব কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়া হলেও অনিয়ম ও ক্ষমতার জোরে কাজগুলো পেয়েছে কে স্পোর্টস। বেশির ভাগ ইভেন্ট বাস্তবায়ন হয়েছে বেসরকারি খাতের স্পনসরে। স্পনসর সংগ্রহে বেপরোয়া চাঁদাবাজি বা জোরপূর্বক অর্থ আদায় হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের সাবেক আলোচিত কর্মকর্তা বেনজীর ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের একজন সহযোগী। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী ফাহাদ করিমের কাছে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বিষয়ে লিখিত প্রশ্ন করা হয়। জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনার অভিযোগের উৎস খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে আমি আপনাকে আবার ফোন করব।’ পরে তিনি ফোন করে জানান, ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপ’ আয়োজন ও ‘বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মহিলা গোল্ডকাপ’ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের উদ্যোগে হয়েছে। তবে ফেডারেশন ইভেন্ট আয়োজনে অর্থায়ন করেনি। তিনি নিজে স্পনসর জোগাড় করে এসব আয়োজনে ব্যয় মেটাতেন। তিনি দাবি করেন বিগত সরকারের আমলে সিভিল অ্যাভিয়েশন তাদের কালো তালিকায় রেখেছিল। ১১টি মামলা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তাদের অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছিল।

 

চাঁদাবাজির টাকাও হতো বড় ইভেন্ট আয়োজন

ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট আয়োজনে অর্থের জোগান নিয়ে অনুসন্ধানেও বেরিয়ে এসেছে, এসবের আড়ালে শত শত কোটি টাকার চাঁদাবাজির তথ্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও বিজ্ঞাপনী সংস্থার প্রধান নির্বাহী আমার দেশকে জানান, যেসব আয়োজন অনেক বড় ছিল, কিন্তু সরকারি দপ্তর থেকে অর্থছাড়ের সুযোগ ছিল না, সেগুলোর অর্থ এসেছে ওইসব দপ্তরের ঠিকাদারদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির মাধ্যমে। এসব ক্ষেত্রে টেন্ডার প্রক্রিয়া ছিল নামমাত্র। টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামান্য ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ্যে আনা হলেও বাকি অর্থ প্রদান হতো নগদে বা ভিন্ন পন্থায়।

যেমনÑতিনি উদাহরণ দেন, একটি আয়োজনে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা খরচ হয়, কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো বিজ্ঞাপন বা টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এক থেকে দুই কোটি টাকার কাজ প্রকাশ্যে এনেছে। বাকি অর্থের জোগান আসত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে, যেসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কাজ বাগিয়ে নিত, তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে।

 

সরকারি অর্থ খরচে রাষ্ট্রকে নিয়ম মানতে হবে : টিআইবি

বিজ্ঞাপনী সংস্থা বা ইভেন্ট আয়োজনে যদি সরকার জড়িত থাকে, তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই যথাযথ প্রক্রিয়া ও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র অনুসরণ করতে হবে, এর ব্যত্যয় হলেই ধরে নিতে হবে এখানে দুর্নীতি হয়েছেÑএমন মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, যাকে ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা কাজ দিয়ে অর্থ লুটের সুযোগ করে দেওয়া একটি বড় অপরাধ। সরকারি অর্থ খরচের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে নিয়মের মধ্যে থেকেই করতে হয়। দুর্নীতির সুযোগ করে দেওয়াও বড় দুর্নীতি বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, সরকার চাইলেই কোনো দোকান থেকে পণ্য কিনে আনতে পারবে না, কিন্তু ব্যক্তি চাইলে পারবে। সরকার কিছু কিনতে গেলে যেমন নিয়মের মধ্যে কিনতে হবে, তেমনি অর্থ খরচেরও নিয়ম মানতে হবে।