Image description


আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

আযম মীরকে বিলম্বিত অভিনন্দন। ছয় মাস আগে তিনি একটি দৈনিক সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছেন। তার পুরো নাম আযম মীর শাহীদুল আহসান। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং তার বাড়ি উত্তরবঙ্গে দিনাজপুরে। তার আগে টানা ৪৫ বছর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী, বিশিষ্ট ইসলামী থ্রিলার রচয়িতা আবুল আসাদও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং তার বাড়িও উত্তরবঙ্গের রাজশাহীতে। প্রচার সংখ্যা যত যত কমই হোক না কেন, যেহেতু আযম মীর এখন দৈনিকটির সম্পাদক, অতএব, আমার পক্ষে একথা বলা ধৃষ্টতা যে ‘তিনি  আমার সহকর্মী ছিলেন,’ বরং এমন বলাই শোভন  যে, ‘আমি প্রায় ১৫ বছর তার সহকর্মী ছিলাম’। তবে একথা সত্য, বয়সে ও পেশায় আযম মীর আমার কণিষ্ঠ। 


সংবাদপত্রটির নাম দৈনিক সংগ্রাম। ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে দৈনিকটির দ্বিতীয় দফা প্রকাশনার সূচনায় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা হিসেব কাজ শুরু করে পর্যায়ক্রমে স্টাফ রিপোর্টার, সিনিয়র রিপোর্টার, বিশেষ সংবাদদাতা ও বার্তা সম্পাদক হিসেবে সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। কোনো দৈনিকের পরিচালনা পরিষদ যদি সম্পাদকের পছন্দনীয় ব্যক্তির পরিবর্তে অন্য কাউকে বার্তা সম্পাদক বা সংবাদ ব্যবস্থাপনার প্রধান হিসেবে নিয়োগ করেন, তাহলে সম্পাদক যত নিরীহদর্শনই হোন কেন, যত ইবাদত-বন্দেগি করার ভান প্রদর্শন করুন না কেন, তার অন্তরে যে ক্ষোভের অগ্নিশিখা দাউদাউ করে জ্বলবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই ঘটেছিল। আমি কোনো অযোগ্য ব্যক্তির অনুগত হতে পারি না। আমি কবি ইকবালের মতো নিজের ‘আমিত্বের’ মাঝে থাকার লোক। খোদ আল্লাহ যাতে আমাকে প্রশ্ন করেন: “বাতা তেরি রেজা কিয়া হ্যায়” (বলো, তুমি কী চাও?)। বার্তা সম্পাদক হিসেবে আমি সংবাদপত্রের নীতিমালার মধ্যে থেকে স্বাধীনভাবে আমার দায়িত্ব পালন করেছি। 


অন্য কারণও ছিল। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে আমার হাতে ছিল সাংবাদিকতার ওপর জার্মানির একটি ডিপ্লোমা, যুক্তরাষ্ট্রের সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলোশিপ এবং ভারতীয় পার্লামেন্ট সংশ্লিষ্ট ইন্সটিটিউটের আরেকটি ফেলোশিপ। এই পর্যায়েই দৈনিক সংগ্রামের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোচ্চ পর্যায় জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ ব্যক্তির পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসে সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তুতি নেয়ার। এজন্য আমার আমল-আখলাক একটু ঠিক করতে হবে এবং সংগঠনে এগিয়ে আসতে হবে। আমি যদিও মাথা চুলকে, একটু হেসে, ‘দেখি’ বা ‘দেখা যাক’ ইত্যাদি বলে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি এড়িয়ে গেছি, কিন্তু আমার দৃঢ় সিদ্ধান্ত ছিল: “নো”। কোনো ব্যক্তি বা দলের কাছে মাথা বিক্রি করবো না। আমি আমার মর্জির মালিক ছিলাম ও থাকবো।

 
তবে আমি সবসময় সংগ্রামের সম্পাদক পদে পরিবর্তন আবশ্যক বলে ভাবতাম এবং প্রকাশ্যেই সম্পাদকের দ্রুত অপসারণ কামনা করতাম। কারণ সংগ্রামের প্রচার সংখ্যা এত কম ছিল (প্রকৃত প্রচার সংখ্যা ও প্রদর্শিত প্রচার সংখ্যার ফারাক সম্পর্কে ভিন্ন নিবন্ধে আলোকপাত করার ইচ্ছা পোষণ করি।) কাউকে ‘প্রকৃত প্রচার সংখ্যা’ বলতে লজ্জাবোধ করতাম। স্ফীত প্রচার সংখ্যাও বলতে পারতাম না। ইসলামী থ্রিলার রচনায় সদাব্যস্ত একজন সম্পাদকের পক্ষে পত্রিকার প্রচার সংখ্যা বৃদ্ধির বৈধ কলাকৌশল নিয়ে ভাবার সময়ই ছিল না। নব্বয়ের দশকের শুরুর দিকে পত্রিকাটির পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন জামায়াত নেতা মুহাম্মদ ইউনুস। এক সভায় তিনি কীভাবে সংগ্রামের প্রচার সংখ্যা বৃদ্ধি করা যেতে পারে, সে সম্পর্কে উপস্থিত সকলের পরামর্শ কামনা করেন। সম্পাদকও সভায় উপস্থিত ছিলেন। আমার বক্তব্য দেওয়ার সময় আমি জন্মলগ্ন থেকে সংগ্রামের ক’জন চিফ রিপোর্টার, ক’জন বার্তা সম্পাদক, ক’জন ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এমনকি ক’জন চেয়ারম্যান পরিবর্তন হয়েছেন, তার ফিরিস্তি তুলে ধরে বলি যে, ভালোর আশায় সব পদে পদে পরিবর্তন করা হয়ে থাকলে একই কারণে সম্পাদকের পদে পরিবর্তন করা আবশ্যক। আমি সম্পাদক পদ থেকে আবুল আসাদের অপসারণ দাবি করি। চেয়ারম্যান হাসেন। সম্পাদকের মনোভাব কী হতে পারে তা সহজে অনুমেয়। এ নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল না। সম্পাদকের সঙ্গে কুলিয়ে না উঠে মুহাম্মদ ইউনুস চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দেন।


১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের বিপর্যয় বিশ্লেষণ করে আমি ‘নতুন ঢাকা ডাইজেস্টে’ পরপর কয়েকটি নিবন্ধ লিখি। জামায়াতের উচ্চতর পর্যায়ে এর বেশ প্রতিক্রিয়া হয়। এরই সুযোগ নিয়ে বোর্ডের সাথে কোনো আলোচনা না করেই ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসে আমাকে চাকুরিচ্যুত করার সুযোগ গ্রহণ করেন। প্রক্রিয়াটি বেআইনি ছিল। আমি চ্যালেঞ্জ করতে পারতাম। করিনি। সুনীলের কবিতার মতো আমি  “তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে,” অপেক্ষায় ছিলাম। আমার কুকুর দেখার কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। এক সপ্তাহ পর বাংলাবাজার পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে ফোন করি। তিনি আমাকে নভেম্বর মাস থেকে যোগ দিতে বলেন। তার কাছে এখনো আমি কৃতজ্ঞ।


আমি বিস্মিত ও হতবাক হয়েছি, যাদের সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি, বন্ধু ভেবেছি, একসাথে উঠাবসা করেছি, যাদের সাথে কত স্মৃতি জড়িত, আমাকে চাকুরিচ্যুত করায় তাদের কেউ প্রতিবাদ করা দূরে থাক, একটা টেলিফোন করে আমাকে সহানুভূতি পর্যন্ত জানাননি। নি:ন্দেহে তারা ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী কাজ করেছেন। আমার অভিজ্ঞতার ঘড়া কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছিল এবং আমার বিশ্বাসের ভিত আরো দৃঢ় হয়েছিল যে, মানুষ যদি ব্যক্তিগতভাবে ভালো না হয়, তাহলে কোনো আদর্শ এবং সে আদর্শ যদি ইসলামও হয়, তাহলেও তা মানুষকে সিরাতুল মুস্তাকিমে আনতে সক্ষম নয়। অতএব, আমি নিজেই স্বীকার করি যে, আমার বিশ্বাসের ভিতে বিরাট এক ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, যা কখনো পূরণ হবার নয়। এজন্য বিশ্বাসের পথে চলার দাবিদার মর্দে মুমিনরাই দায়ী। কবি আহমদ ফরাজ বলেছেন: 
“বন্দেগি হাম নে ছোড় দি হ্যায় ফরাজ,
কিয়া কারে, লোগ জব খুদা বন জায়ে।”
(ফরাজ, আমি ইবাদত করা ছেড়ে দিয়েছি, 
লোকজন খোদা হয়ে গেলে আমি কি করবো?)
এখন তো নবী-রাসুল আসার সুযোগ নেই। মানুষ তো মানুষই। ফেরেশতা নয়। ভুল করবে, তেল মালিশ কামনা করবে, কদর-তোয়াজ আশা করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মতো একজন ক্ষুদ্র ব্যক্তি কাউকে কোনোদিন তা করবে না। বরং এ ধরনের লোকদের নিয়ে আমার ধারণা এমন:
“ও ক্যায়সে লোগ হ্যায় জিনহে বন্দেগি পছন্দ হ্যায়,
হামে তো শরম দামন-গির হ্যায় খুদা হোতে।”
(ওরা কেমন মানুষ, যারা চায় অন্যেরা তাকে পূজা করুক,
আমি তো খোদার বস্ত্রের প্রান্ত স্পর্শ করতেও লজ্জিত হবো।) 


আযম মীরের ওপর মৃতের মাঝে জীবন সঞ্চারের দায়িত্ব দু:সাধ্য দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে।  কারো পক্ষে কি ঈসা নবীর কাজ করা সম্ভব? তবুও আমি আযম মীরের ব্যক্তিগত সাফল্য ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি।