Image description

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় দফার ষষ্ঠ বৈঠকে রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মত-ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে ঐকমত্য হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে কমিশন। এর পরিবর্তে নতুন প্রস্তাব করেছে তারা। 

বুধবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় দফার ষষ্ঠ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি। এ বিষয়ে নতুন একটি প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংবিধানের মূলনীতিতে কী কী থাকবে তা অবশ্যই উল্লেখ থাকতে হবে, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্প্রীতি ও পক্ষপাতহীনতা এই পাঁচ বিষয়কে সমর্থন করেছেন তারা।

জোনায়েদ সাকী বলেন, ভবিষ্যতে অন্তত এই পাঁচ বিষয় সংবিধানে থাকতে হবে এই রকম একটি ঐকমত্যে পৌঁছানোর বিষয়ে তিনি আশাবাদী। 

এ প্রসঙ্গে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনীর সময় অন্তর্ভুক্ত ‘বিসমিল্লাহ’ এবং ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বহাল রাখতে চায়। পাশাপাশি বিএনপি চাইছে, ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতিও সংবিধানে যুক্ত করবে তারা।

এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বসে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা’ ও ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিমের’ সংযোজনের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও। জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, সিপিবি ও দুই-একটি বাম দল ছাড়া বেশির ভাগ দলই এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত। 

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা দলের পক্ষ থেকে বলেছি, রাষ্ট্রের যে মূলনীতি, সেটা দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রাম আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া। গণ আকাক্সক্ষার সাংবিধানিক প্রতিফলন হিসেবে সেটা সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, তারা মনে করেন মূলনীতি অব্যাহত থাকা দরকার। 

কমিশনের প্রাথমিক প্রস্তাবে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও গণতন্ত্র’ প্রস্তাব করেছিল। নতুন করে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি মূলনীতিতে যুক্ত করার প্রস্তাব করে কমিশন। বৈঠকের শুরু থেকেই সংবিধানের চার মূলনীতির কোনো পরিবর্তন করতে দেওয়া হবে না বলে মত দিয়ে আসছে সিপিবি, গণফোরামসহ বাম জোটের নেতারা। গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি এ কে এম জগলুল হায়দার আফ্রিক বলেন, ‘সংবিধানের মূলনীতি ঠিক রেখে নতুন কোনো বিষয় থাকলে সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সংবিধানের মূল নীতিতে হাত দেওয়া যাবে না, সেটা আমরা বলেছি।’
 
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণে শর্তসাপেক্ষে একমত বিএনপি

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন এমন বিধানে শর্তসাপেক্ষে সম্মতি জানিয়েছে বিএনপি। তবে যদি ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ নিয়োগ কমিটি’ গঠিত হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর এই মেয়াদকাল নির্ধারণের প্রস্তাবে বিএনপির পক্ষে একমত হওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, শুধু নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা কমিয়ে রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে চলবে, এমন ধারণা ঠিক নয়। একজন ব্যক্তি একসময় স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিলেন বলে আজীবনের জন্য নির্বাহী ক্ষমতা খর্ব করতে হবে, এমন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। 

সাংবিধানিক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করে তিনি বলেন, বিদ্যমান আইনের ভিত্তিতে কমিশন বা সার্চ কমিটি গঠন করেই নিয়োগ প্রক্রিয়া চালানো যেতে পারে। এর মধ্যেই সংস্কার করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব, যাতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত থাকে। এক্ষেত্রে সংবিধানে নতুন করে একটি আলাদা বডি গঠনের প্রয়োজন নেই। 

এদিকে জোনায়েদ সাকীও জানান, গত কালকের ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে একজন ব্যক্তি কয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, একজন প্রধানমন্ত্রী কত বছর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, সে বিষয়ে একটা প্রস্তাব ছিল ১০ বছরের। এই বিষয়ে মোটামুটি একটা ঐকমত্য তৈরির জায়গা হয়েছে।

‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’ করার প্রস্তাব 

জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর পরিবর্তে ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ কথা জানিয়েছেন। 

আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এনসিসির প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে। নতুন প্রস্তাবিত কমিটির কাঠামোতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এনসিসিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি থাকার যে প্রস্তাব করা হয়েছিল, নতুন প্রস্তাবিত কমিটিতে তারা থাকবেন না। উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের স্পিকার এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। কমিটি শুধু সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করবে। অ্যাটর্নি জেনারেল ও তিন বাহিনীর প্রধানের নিয়োগ এই কমিটির অন্তর্ভুক্ত হবে না। 

আলী রীয়াজ বলেন, এই কমিটি হবে সাত সদস্যবিশিষ্ট, যেখানে সভাপতি থাকবেন নিম্নকক্ষের স্পিকার। প্রস্তাবিত কমিটিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার (নিম্নকক্ষ), স্পিকার (উচ্চকক্ষ), বিরোধীদলীয় নেতা, প্রধান বিরোধী দল ছাড়া অন্য বিরোধী দলগুলোর একজন প্রতিনিধি, রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি (আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত যোগ্যতাসম্পন্ন), প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। সভাপতিত্ব করবেন নিম্নকক্ষের স্পিকার।

বিএনপিরও সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়ার জন্য জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) মতো প্রতিষ্ঠান গঠনের সঙ্গে দলটি একমত নয়। এটিকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা।

সংশোধিত এনসিসির প্রস্তাবের বিষয়ে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, সাংবিধানিক পদের নিয়োগগুলো প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার উভয় পক্ষের সবাই মিলে আলোচনা করবেন; সেখানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধি থাকবেন, এর চেয়ে সুন্দর প্রস্তাব আর হতে পারে না।