
সাবেক মেয়র ও নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতা শেখ ফজলে নূর তাপসের ঘনিষ্ঠ ছিলেন আরিফ চৌধুরী। তাপসের কাছ থেকে পদ-পদোন্নতি নেওয়া সেই আরিফ চৌধুরীই এখন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়ানোর দাবিতে করা আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ভোল পাল্টে আরিফ এখন নগর ভবনে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ শনাক্তের নামে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি গত ৪০ দিন ইশরাকের আন্দোলনে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী যোগ দেননি তাদের ওপর চড়াও হচ্ছেন। গত দুদিন এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নানাভাবে হেনস্তা করার ঘটনা ঘটেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নগর ভবনে ঢুকতে না দেওয়ার প্রতিবাদে ইশরাকদের আন্দোলনের আরেক সমর্থক গ্রুপের সঙ্গে গতকাল সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত অবস্থায় দুজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। আর কয়েকজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। আহত, প্রত্যক্ষদর্শী, শ্রমিকদল নেতাকর্মী ও প্রশাসনিক বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ইশরাক সমর্থকদের দুপক্ষের সংঘর্ষে মেডিকেলে ভর্তি হওয়া গুরুতর আহত দুজন হলেন মনির হোসেন (৪৫) ও মহিদুল ইসলাম (৩৫)। পরে আহতদের দেখতে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যান ইশরাক হোসেন।

কে এই আরিফ চৌধুরী
নগর ভবনের প্রশাসনিক একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নিজেকে বিএনপি নেতাদের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে অফিস সহকারী থেকে এক লাফে পরিবহন বিভাগের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি পান আরিফ চৌধুরী। চলতি বছরের ৬ মার্চ সচিব বশিরুল হক ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে আরিফকে কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
তাপসের সময়ে সুইডেন আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুল ইসলামকে নিজের খালু পরিচয় দেওয়া আরিফ চৌধুরী বিদ্যুৎ বিভাগের অফিস সহকারী থেকে পদোন্নতি পেয়ে পরিবহন বিভাগে কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক হিসেবে যোগদান করেন। গাড়ি দুর্ঘটনায় ছাত্র নিহত হওয়ার পরে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। ওই গাড়ির চালকের সহযোগীকে তিনি অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে ময়লার গাড়ির চাবি তুলে দেন। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে সাবেক মেয়র তাপস আরিফকে বরখাস্ত করেন। একই সঙ্গে মুগদায় নিহত ছাত্রের জানাজায় উপস্থিত হয়ে জনসমক্ষে তাপসের কাছে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন।
তবে ৫ আগস্টের পরে বরখাস্তের সেই ঘটনাকে রাজনৈতিক কারণ বলে চালিয়ে দেন আরিফ। পরে দ্রুতগতিতে কর্মচারী থেকে কর্মকর্তার পদ পেয়ে যান আরিফ। বর্তমানে তিনি পরিবহনের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কর্মরত।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রেজিস্টার্ড বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের অন্তর্ভুক্ত দলের সভাপতি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন আরিফ। তবে এর কোনো বৈধ কাগজপত্র তাদের কাছে নেই বলেও জানায় নগর ভবন সূত্র। এমনকি সাবেক মেয়র তাপসকে পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ার পরে আরিফ তাকে অভিনন্দন জানান। সেই আরিফ চৌধুরীই বর্তমানে বিএনপি নেতা ইশরাকদের আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
নগর ভবনে সেবার পরিবর্তে আতঙ্ক
প্রচণ্ড আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাধারণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। কারণ, বিএনপির মেয়রপ্রার্থী ইশরাক হোসেনের সমর্থিত ডিএসসিসির কর্মচারীদের দুই গ্রুপ আবার মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। আরিফ চৌধুরীর গ্রুপের লোকজন প্রিন্স গ্রুপের লোকজনকে জোরপূর্বক নগর ভবন থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই ঘটনার পর দুই-তিন দিন ধরে সেখানে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
ইতোমধ্যে গত ২২ জুন সরকার ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে মো. জহিরুল ইসলামকে (যুগ্ম সচিব) নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মো. জিল্লুর রহমানের স্থলাভিষিক্ত হবেন।
জানা গেছে, ইশরাক হোসেনের সমর্থনে আন্দোলনের ৪০ দিনের মাথায় গত সোমবার নাগরিক সেবা পুনরায় চালুর জন্য নগর ভবনের কয়েকটি দপ্তরের তালা খোলা হয়। কিন্তু অধিকাংশ দপ্তরে দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দেখা যায়নি।
এদিন নগর ভবনে ডিএসসিসির জাতীয়তাবাদী শ্রমিক কর্মচারীদের নাম ব্যবহার করে কিছু কর্মচারী হঠাৎ বিএনপি নেতা ইশরাকের সমর্থন আদায়ের পাশাপাশি আধিপত্য বজায় রাখতে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তারা আন্দোলনের পর অফিস খোলার প্রথম দিনই নগর ভবনে শোডাউন করেন। একপর্যায়ে শ্রমিক দলের অপর অংশের নেতা আরিফুজ্জামান প্রিন্স গ্রুপের কর্মচারীদের নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে নগর ভবন থেকে বের করে দেন। এই খবর মুহূর্তে ডিএসসিসির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়লে নতুন করে আতঙ্ক শুরু হয়।
দুপক্ষের সংঘর্ষের সূত্রপাত যেভাবে
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক ইউনিয়নের এক পক্ষের সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান প্রিন্স দলবল নিয়ে নগর ভবনে ঢোকার সময় আরেক পক্ষের সভাপতি আরিফ চৌধুরীর লোকরা তাদের ধাওয়া দেন। পরে উভয় পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া একপর্যায়ে সংঘর্ষে রূপ নেয়। এ সময় দুই পক্ষের কয়েকজন আহত হয়েছেন।
এ সময় সংঘর্ষের ছবি ও ভিডিও ধারণ করার সময় সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়েছেন ইশরাক সমর্থকরা। বেসরকারি টেলিভিশনের রিপোর্টার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান শিশিরের মুঠোফোন ছিনিয়ে নিয়ে সব ছবি ও ভিডিও ডিলিট করে দেন তারা। এ সময় তাকে হেনস্তা করতে দেখা গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দুপুর দেড়টার দিকে শ্রমিক দলের নেতা আরিফুজ্জামানের অনুসারী সন্দেহে নগর ভবনের এক কর্মীকে গণপিটুনি দেওয়া হয়। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত ইশরাকের অনুসারীরা সিটি করপোরেশনের প্রশাসন শাখার কম্পিউটার অপারেটর শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামকে বেদম পেটাতে থাকেন। এ সময় পুলিশ এসে ওই ব্যক্তিকে উদ্ধারের চেষ্টা করলে পুলিশের কাছে তাকে দিতে রাজি হননি ইশরাকের অনুসারীরা। পরে নগর ভবনে আসা আরেক ব্যক্তিকে প্রিন্সের অনুসারী সন্দেহে বেদম মারধর করা হয়। পরে পুলিশ এই দুই ব্যক্তিকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।
জানতে চাইলে আরিফুজ্জামান প্রিন্স আমার দেশকে বলেছেন, গত রোববার থেকে ইশরাক হোসেন নগর ভবনে সেবা চালু করার ঘোষণা দেওয়ার পরও আরিফ চৌধুরীর লোকজন প্রতিদিন এসে মহড়া ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হুমকি দিচ্ছে। যারা ইশরাকের আন্দোলনে অংশ নেয়নি তাদের ‘বিরোধী পক্ষ’ উল্লেখ করে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন তারা। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাদের নগর ভবনে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। এরপরও যারা ঢুকছেন, তাদের গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
আরিফ চৌধুরীর জানান, ‘তারা শান্তিপূর্ণভাবে নগর ভবনে অবস্থান নিয়েছিলেন। বহিরাগতরা এসে তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে আটজনকে গুরুতর আহত করে। এ সময় স্বীকার করেন পরিবহন বিভাগের অফিস সহকারী পদে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে যোগ দিয়েছেন। তিনি দাবি করেন তাকে ২০২৪ সালে রাজনৈতিক কারণেই সাবেক মেয়র তাপস চাকরিচ্যুত করেছেন। এরপরে তাপসের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন করতে গেলে, কল করছি বলে ফোন কেটে দেন।
আন্দোলন দমাতে পরিকল্পিত হামলা- দাবি ইশরাকের
নগর ভবনে নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে নাগরিক সেবা ব্যাহত করে আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পরিকল্পিত হামলার অভিযোগ করেছেন ইশরাক হোসেন। গতকাল মঙ্গলবার বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতদের দেখতে এসে তিনি এই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রকারীদের মূল লক্ষ্য শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলন চিরতরে বানচাল করে দেওয়া। এর পেছনে ষড়যন্ত্রকারী যে বা যারাই হোক তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
ফ্যাসিবাদের দোসররা হামলা চালিয়েছে উল্লেখ করে ইশরাক হোসেন বলেন, আন্দোলনকারীদের অনুরোধ জানিয়ে যখন নাগরিক সেবা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন থেকেই আমার প্রতিপক্ষরা বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করে এটাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা শুরু করে। সব বাধা অতিক্রম করে সেবা চালু করা হয়।