
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে অচেনা ও ভূঁইফোঁড় রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা না হলেও সম্ভাব্য সময় ঘনিয়ে আসতেই একের পর এক নতুন দলের নাম নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা পড়ছে নির্বাচন কমিশনে (ইসি)। ইসির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য ৬৫টি আবেদন জমা পড়ে। তবে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে, গত ২২ জুন পর্যন্ত সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৭টিতে। বিশ্লেষকরা একে দেখছেন ‘রাজনৈতিক ব্যবসা’ কিংবা জোট গঠনের আকাঙ্ক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে।
রাজনীতির মাঠে অচেনা এসব দলের হঠাৎ উত্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এদের অধিকাংশের কোনো আদর্শভিত্তিক কর্মকাণ্ড, সাংগঠনিক কাঠামো বা তৃণমূল পর্যায়ে কোনো উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি নেই। শুধুমাত্র নির্বাচনের সময়কে ঘিরে নিবন্ধনের নামে নতুন নতুন দল গড়ে উঠছে, যা ‘রাজনৈতিক ব্যবসা’, জোট গঠনের আকাঙ্ক্ষা উদ্দেশ্যেই করা হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আবেদন করা দলগুলোর অনেকে নাম প্রচারের জন্য কিংবা অন্যকোন স্বার্থ থেকে এটি করতে পারে। নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে এগুলোর দিকে নজর দেয়া। ভূঁইফোঁড় সংগঠন যেন নিবন্ধন না পায় এটা নিশ্চিত করা। আগে ড্যামি প্রার্থী হতো, এখন হয়ত ড্যামি দল হতে পারে। কোন প্রতিষ্ঠিত দলের সহযোগী হতে পারে।’
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এমন বহু অচেনা নামের দলের অংশগ্রহণ দেখা গিয়েছিল, যারা পরবর্তীতে দৃশ্যপট থেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়। রাজনৈতিক মহলে ধারণা, এবারও সেই প্রবণতা পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
নিবন্ধনের আবেদনকৃত নতুন দলগুলোর তালিকায় রয়েছে ‘বাংলাদেশ সলুশন পার্টি’, ‘বাংলাদেশ সংগ্রামী ভোটার পার্টি’, ‘বাংলাদেশ দেশপ্রেমিক প্রজন্ম ডেমোক্রেসি’, ‘বাংলাদেশ মুভমেন্ট’, ‘বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ’, ‘ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি’, ‘বাংলাদেশ নাগরিক আন্দোলন পার্টি’, ‘বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টি’, ‘বাংলাদেশ পাকপাঞ্জাতন পার্টি’, ‘অহিংস গণ আন্দোলন’, ‘জনতার কথা বলে’, ‘নতুন ধারা বাংলাদেশ’, ‘ভাসানী জনশক্তি পার্টি’-এর মতো বহু নাম। এসব দলের অনেকেরই ঠিকানা ব্যক্তিগত বাসা কিংবা অস্থায়ী কার্যালয়ে, আবার কেউ কেউ পুরানা পল্টন বা মতিঝিলের ভাড়া করা অফিস ঠিকানা ব্যবহার করছে।
নতুন দলের নিবন্ধন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আইন অনুযায়ী, নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত—গঠনতন্ত্র, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি, তৃণমূল পর্যায়ে কার্যকর শাখা, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের নথি খতিয়ে দেখা হবে। কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যারা নিছক নিবন্ধনের কাগজপত্র জমা দিয়ে নির্বাচনকে ব্যবহার করতে চায়, তাদের জন্য সুযোগ থাকবে না। নির্বাচন কমিশন কঠোরভাবে সব কিছু যাচাই বাছাই করবে।’
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আবেদন করলেই নিবন্ধন পাবে এমন গ্যারান্টি নেই। নিবন্ধন পেতে হলে কতগুলো নিয়ম-কানুন আছে, এগুলো পূরণ হলে কমিশন নিবন্ধন দিবে, না হলে দিবে না। আমার তো মনে এখানে যারা আবেদন করেছে, কম দলই নিবন্ধন পাবে। আবেদন করলে করতে পারে, আবেদন করাতো নাগরিকের অধিকার। এসব দল ভোটের রাজনীতিতে বিভাজন তৈরি হবে না, কারণ মানুষ ভোট বুঝেশুনে দেয়।’
ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন যে নিবন্ধন দেয়, নিবন্ধনের জন্য কিছু ক্রাইটেরিয়া রয়েছে, আইনী কতগুলো শর্ত রয়েছে। নিবন্ধনের জন্য আবেদন করলে নির্বাচন কমিশন এগুলো যাচাই বাছাই করে দেখবে। নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা দলগুলোর কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অফিস আছে কি না এগুলো সরেজমিনে দেখবে কমিশন। এখন যাচাইয়ে যদি বাতিল হয়ে যায় তাহলে তো আর কোন কিছু নেই। আর একটা বিষয় এই যে এতগুলো আবেদন, নির্বাচন কমশিনের যে পরিধি তাতে করে একটা বাড়তি পেশার তৈরি হবে। সবগুলো যাচাই না করে তো নিবন্ধন দিতে পারবে না। কাজেই এতগুলো আবেদন যাচাই করতে তাদের একটি বাড়তি সময় প্রয়োজন হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে তো অনেক রাজনৈতিক দল আছে, যারা ব্যবসা করতে পছন্দ করে, অর্থাৎ যারা রাজনীতি নিয়ে ব্যবসা করে। তারা একটা ছোট পার্টি বা দল করতে পারলে দেশের বড় কোন দলগুলো সাথে একটা জোট বা মিত্রতা করে যদি ওই ছোটদলটির কেউ এমপি হতে পারে। এরকম আকাঙ্খা থেকে অনেকে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। আবার এমনও হতে পারে অনেকের দীর্ঘদিন ধরে দল করার ইচ্ছা ছিল। অথবা যেহেতু গত ১৫/১৬ বছর রাজনৈতিক কারণে আসতে পারেনি এখন আসছে।’
আব্দুল আলীম বলেন, ‘আমার মনে হয় না এগুলো ভোট বিভাজনে কোন প্রভাব ফেলবে। কমিশনের হাতে সময় কম, তাদের জনবল যা আছে তা কাজে লাগিয়ে এগুলো (আবেদন যাচাই বাছাই) করতে হবে। তবে অসম্ভব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের নির্বাচন সংস্কার কমিশনের যে সুপারিশ, তার মধ্যে একটা পরামর্শ আছে যে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো পাঁচ বছর পর পর এগুলো মনিটর করবে। দেখা গেল এখন কার্যক্রম করে একটি পলিটিক্যাল পার্টি নিবন্ধন পেল কিন্তু তারপর দেখা গেল, তাদের যে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অফিস সেগুলো নেই। তাহলে তো তাদের নিবন্ধন তো রাখার সুযোগ নেই। এমন ভূঁইফোঁড় রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এমন সুপারিশ করা হয়েছে। যে নির্বাচন কমিশন পাঁচ বছর পর পর এগুলো রিভিও করবে।’